Robbar

মাতালকে ঈশ্বর বারবার বেনিফিট অফ ডাউট দেন না

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 8, 2025 9:18 pm
  • Updated:November 8, 2025 9:18 pm  

মদ পেটে খেয়াল হল ক্লাস্টার হেড ব্যাঙ্কে আমার চেয়ে বছর সাতেক আগে জয়েন করলেও চাকরির অভিজ্ঞতায় আমি ওর চেয়ে এগিয়ে– তাই সবার সামনেই ওকে বলেছিলাম, ‘তুমি যখন লিকুইড ফর্মে, আমি তখন ইউনিফর্মে। বেশি চাপ নিও না।’ সহকর্মীদের হাসি শুনে বেকুব হয়ে অবাঙালি ক্লাস্টার হেড আমার কথার মানে জানতে সার্কেল হেডের কাছে দৌড়েছিল। সার্কেল হেড হেসে নাকি বলেছিলেন, ‘পিনাকীটা ভীষণ দুষ্টু হয়েছে!’

পিনাকী ভট্টাচার্য

এক বিজ্ঞ বন্ধু কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়ে বলেছিল মদ্যপান বা নেশা করলে মোটর নার্ভসেলগুলো একটু রিল্যাক্স করে, মনে পুলক জাগে– তাই মদ্যপান করলে ‘চিয়ার্স’ বা ‘উল্লাস’, বা বড় তামাকের নেশা করলে ‘জয়গুরু’ বলতে হয়। আরও বলেছিল যে, নেশা করলে অনেক শক্ত কাজও অনায়াসে করা যায়। গুলমার্গের পথে একটা চড়াইয়ে বসে আমি হাঁপাচ্ছিলাম, আর পাশে বসে এইসব তত্ত্বকথা শোনাচ্ছিল। এমন সময় হইহই করে একটা পাঞ্জাবি পরিবার তড়তড় করে সামনের চড়াই ভেঙে হেঁটে এগিয়ে গেল– পুরুষ নারী নির্বিশেষে সোনালি পানীয় ভর্তি গ্লাস হাতে। চোখ নাচিয়ে সেই বিজ্ঞ বন্ধু বলেছিল, ‘দেখলি, কী বলেছিলাম!’

বিজ্ঞ মানুষদের কথা শিরোধার্য করে নেশার জগতে পা ফেললাম। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বুঝলাম– আমি, বা আমার মতো বঙ্গসন্তানরা, যারা মন্দিরের ঘণ্টার মতো জীবনযাপন করে (যে-পারে বাজিয়ে চলে যায়), আমাদের পেটের মধ্যে প্রতিবাদ ভরভর করলেও আপস করে নিয়ে থাকি, নেশা করলেই চিত্তির– মোটর নার্ভসেল রিল্যাক্স করলেই ইরা, পিঙ্গলা, সুষুম্না– সব্বাই জেগে উঠে কুলকুণ্ডলিনীকে ধাক্কা মারতে শুরু করে। নেশার মধ্যে সাহস দেখালে সেটাকে পরে সামাল দিতে কালঘাম ছুটে যায়– আর যদি সামাল না দিতে পারা যায়, পরে এই নিয়ে অনেক কেস-গোলমাল-হট্টগোল হয়, অনেক বাক্যবাণের মুখোমুখি হতে হয়, শাস্তিও পেতে হয়। সবাই না হলেও, আমি আর আমার মতো বঙ্গসন্তানদের ক্ষেত্রে অবশ্যই! নেশার সময় সাহসিকতার ক্ষেত্রে ‘রাত গয়ি, বাত গয়ি’ প্রবাদটা ভুলে যদি পরে ‘রেফারেন্স টু দ্য কনটেক্সট’ হয়ে ব্যবহার করা হয়, তাহলে কেলেঙ্কারি!

একবার শাশুড়ি ঠাকরুন তাঁর মেয়েকে নিয়ে তাঁর বোনের বাড়ি গিয়েছেন, আর সেটা উদযাপন করতে সন্ধেবেলায় শ্বশুরমশাই আর আমি বৃদ্ধ সাধুর ভজনায় মেতেছি। শ্বশুরমশাই ভজনায় মত্ত হয়ে তাঁর মনের দুঃখ প্রকাশ করতে শুরু করেন। বৃদ্ধ সাধুর ভজনায় শ্বশুরমশাই পৌরোহিত্য করছেন আর তাঁর বুকে এত দুঃখ, সেটা জেনে তন্ত্রধারক হিসাবে আমার একটা দায়িত্ব থেকে যায়। আর সেই দায়িত্ব থেকে আমিও আমার দুঃখ-কষ্টের কথা ব্যক্ত করলাম, আর পরিশেষে বললাম, ‘আপনার বিয়ে করাই ঠিক হয়নি। তাহলে আপনারও বউ থাকত না, আমারও বউ থাকত না– না রহেগা বাঁশ, না বাজেগি বাঁশুরি।’ শ্বশুরমশাই উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন আমার কথায় আর দু’জনের জন্য পাতিয়ালা পেগ ঢাললেন। কিন্তু কেলো করলেন যখন কয়েকদিন বাদে শাশুড়ির সঙ্গে বিসম্বাদের সময় আমাকে উদ্ধৃত করলেন। শাশুড়ি বাকরহিত, গিন্নি ক্রন্দনরত– এই পরিস্থিতিতে কোনও আব্বুলিশই কাজ দেয় না। কিন্তু ওই যে আপ্তবাক্য আছে– ‘মদের খেয়ালে, মুতেছি দেওয়ালে’– সেই বেনিফিট অফ ডাউটে ঈশ্বর বোধহয় আমাকে রক্ষা করেছিলেন।

ঈশ্বর একবার বাঁচান, বারবার বাঁচান না। আগে ব্যাঙ্কে মাঝেমাঝে পার্টি লেগে থাকত। সারাদিন ধরে রগড়ে সন্ধেবেলায় মদ, কাবাব– লা জবাব। আমরা সারাদিনের ঝাড় আর তিক্ততা ভুলে সহকর্মীদের (সবাই ঝাড় খেত) আর সহমর্মীদের (বসেরা গেলাস হাতে সহমর্মী হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে) বেশ খানিক হ্যা-হ্যা-হি-হি করে হুল্লোড় করে বাড়ির দিকে রওনা দিতাম; আর একপেট মদ নিয়ে অবচেতন মনে সারাদিনের খাওয়া ঝাড় কীভাবে অধস্তন কর্মীদের মধ্যে ‘পার্কোলেট’ করে, তাদের দৌড় করিয়ে ব্যাঙ্কের ব্যবসা বাড়ানো যায়, সেই মতলব ভাজতাম। এইরকম এক সন্ধেয় যখন বেশ স্ফূর্তি করছি, আমার ক্লাস্টার হেড এসে ব্রাঞ্চের ব্যবসা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান শুরু করল। ঘটনাচক্রে প্রায় প্রত্যেক বছর টার্গেট করে ফেলতাম বলে যেখানে সার্কেল হেড বেশ স্নেহ করতেন, এই মূর্তিমান আপদ মৌতাতের দফারফা করতে বদ্ধপরিকর। মদ পেটে খেয়াল হল ক্লাস্টার হেড ব্যাঙ্কে আমার চেয়ে বছর সাতেক আগে জয়েন করলেও চাকরির অভিজ্ঞতায় আমি ওর চেয়ে এগিয়ে– তাই সবার সামনেই ওকে বলেছিলাম, ‘তুমি যখন লিকুইড ফর্মে, আমি তখন ইউনিফর্মে। বেশি চাপ নিও না।’ সহকর্মীদের হাসি শুনে বেকুব হয়ে অবাঙালি ক্লাস্টার হেড আমার কথার মানে জানতে সার্কেল হেডের কাছে দৌড়েছিল। সার্কেল হেড হেসে নাকি বলেছিলেন, ‘পিনাকীটা ভীষণ দুষ্টু হয়েছে!’ জল পেটে পড়লে যে মাত্রা-জ্ঞানের সীমারেখা মাঝেমাঝেই টুনিবাল্বের মতো জ্বলে আর নেভে, আর ওই নিভে থাকার সময়ে আবার একটা কেস করলাম পরের মাসেই। সুন্দরবনের এক রিসর্ট ভাড়া নিয়ে সেবার ব্যাঙ্ক এক পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠান করেছিল ফেব্রুয়ারি মাসে– উদ্দেশ্য ভালো-মন্দ খাইয়ে তার সঙ্গে সেই নিরিবিলি পরিবেশে টার্গেট রিভিউ আর ব্যবসা নিয়ে কমিটমেন্ট নেওয়া। সেই অনুষ্ঠানে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিলো দুটো লঞ্চে, একটা বড় লঞ্চ, আরেকটা অপেক্ষাকৃত ছোট। আর সেই লঞ্চগুলোতে ছিল এলাহি খানা-পিনার আয়োজন। বড় লঞ্চটায় পুরস্কার প্রাপক ব্রাঞ্চ ম্যানেজাররা আর সেই ব্রাঞ্চের একজন করে অফিসার, আর অন্য লঞ্চে সার্কেল হেড, সার্কেল অফিস আর ব্যাঙ্কের সহযোগী সংস্থার কর্তারা। মাতলা নদীর ওপরে দুটো লঞ্চ পাশাপাশি চলেছে, মাঝে একটা পাটাতন পেতে এই লঞ্চ থেকে অন্য লঞ্চ যাতায়াত হচ্ছে। সার্কেল অফিসের জনগণ মাঝেমাঝে এসে দু’-এক পাত্তর চড়িয়ে ফেরত যাচ্ছে অন্য লঞ্চে। নদীর ফুরফুরে হাওয়ায় জল পেটে জলে ভেসে তূরীয়ানন্দ মুডে এক লুজ্‌ বল খেললাম আবার, ঘোষণা করলাম– এখানে ‘লাইফ অফ পাই’ ছবির দ্বিতীয় ভাগের শুটিং হচ্ছে– আমি ‘পাই’ আর সার্কেল হেড ‘রিচার্ড পার্কার’ নামের বাঘের রোলে। খানিক বাদে এক সহকর্মী খবর দিল যে, আমার মন্তব্য ঘোষণা সার্কেল হেডের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী আমার ওপরে বেশ হম্বিতম্বি করল এইসব বেফাঁস কথা বলার জন্য। কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। সন্ধের অনুষ্ঠানে প্রাইজ হাতে গলা অবধি পানীয়তে ডুবে সার্কেল হেডের কাছে পৌঁছলাম। তিনি তখন সার্কেল অফিস আর সেন্ট্রাল অফিসের অফিসারদের সঙ্গে ব্যস্ত। তাঁকে গিয়ে অকুতোভয় চিত্তে বিনম্রভাবে জানিয়েছিলাম, ‘স্যর ক্ষমা করবেন, সকালে আমি ভুল বলেছি। আমি পাই আর আপনি রিচার্ড পার্কার নন, আমি মুংলি আর আপনি শের খান।’ এর দুই মাস বাদে এপ্রিল মাসে আমাকে ছত্তিশগড়ে ট্র্যান্সফার করা হয়। সম্ভবত সাহসিকতার পুরস্কার হিসাবে।

শহরের এক মেডিকেল কলেজের হস্টেলে আড্ডা দিই শুনে, নয়ের দশকের এক আড্ডায় সেই কলেজের প্রাক্তনী কিংবদন্তি শল্যচিকিৎসক জানিয়েছিলেন যে, ১৯৫০ সালে ওঁর ছাত্রাবস্থায় সেই হস্টেলে তিনি বারকতক গিয়েছিলেন আর তখনই বাড়িটা পুরসভার বিপজ্জনক বাড়ির তালিকায় ছিল। আদপে দু’টি বাড়ি মিলিয়ে ছিল হোস্টেল, পেছনের বাড়িটা প্রায় ভগ্নস্তূপ, কিন্তু সব ভেঙে গেলেও অদ্ভুতভাবে তার ছাদের টয়লেটটা বহাল তবিয়তে বিরাজমান। হস্টেলবাসীদের দুটো বাড়ির ছাদের মধ্যে একটা কাঠের বিম ফেলে সেটা দিয়ে হেঁটে গিয়ে পাশের বাড়ির ছাদের টয়লেট ব্যবহার করতে দেখে শিউরিয়ে উঠতাম ভয়ে। একদিন রাতে একটু বেশি ‘জলচিকিৎসা’ হয়ে যাওয়ায় হস্টেলে রাতে থেকে গিয়েছি। মাঝরাতে পেট কামড়ালে উঠে বসলাম যখন, তখনও ভরপুর নেশা। কোথায় যাব, ভাবতে মনে পড়ল– পাশের বাড়ির ছাদের টয়লেটের কথা, আর কাউকে ঘুম থেকে না তুলে গটমট করে সেই বিমের ওপর দিয়ে পাশের ছাদে চলে গেলাম। দাস্থের সঙ্গে নেশাও নেমে গিয়েছে বেশ কিছুটা, ফেরার সময় এসে থমকে গেলাম। কী সর্বনাশ! পুরনো তিনতলা বাড়ির ওপরে ছাদ– মানে আজকের দিনের পাঁচতলা বাড়ির সমান উঁচু দুটো বাড়ি, মাঝখানে একটা এক ফুট চওড়া বিম দুই বাড়ির মধ্যেকার যোগসূত্র, পা স্লিপ করলে সপাটে একতলায়, হাসপাতালের এমারজেন্সিতে অবধি নিয়ে যেতে হবে না, স্টেপ জাম্প করে সোজা মর্গে– আর এই পথ দিয়ে পাশের ছাদে এসেছি! ফিরব কীভাবে! সারারাত ওপারে বসে থেকে ভোরের আলো ফুটতে সেই বিম আঁকড়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঊর্ধ্বপানে চেয়ে ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর’ আওড়াতে আওড়াতে (চোখের দৃষ্টি বারবার নিচের দিকে যাচ্ছিল আর মাথা ঘুরছিল) কোনওমতে ফেরত এসেছিলাম।

শেষে বলি, অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার কথা। আমার এক আত্মীয়ের জীবনের এক ঘটনা (নাম বলছি না, কারণ চলচ্চিত্রের অভিনয়ের গুণে তাকে অনেকেই চেনেন)। সে বাজে কথা বলার মানুষ নয়, তাই ঘটনাটা সত্যি বলেই মনে হয়। একবার এক শুটিংয়ের সূত্রে এক রাজবাড়িতে গিয়েছিল, থাকার ব্যবস্থাও হয়েছিল রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে। রাজবাড়ির কিছু দুর্নাম থাকার জন্য বলা হয়েছিল, শুটিং সন্ধে সাতটার মধ্যে শেষ করে নিতে আর শুটিংয়ের পর ঘর থেকে না বেরতে। শুটিংয়ের পর অন্য এক অভিনেতার ঘরে বসে আড্ডা দিয়ে আমার সেই আত্মীয়ের ঘরে ফিরতে রাত ন’টা বেজে যায়। সে ঘর শেয়ার করছিল আরেক অভিনেতার সঙ্গে, তাই তার জন্য দরজা খোলা রেখে সে বাথরুমে ঢোকে মেকাপ তুলতে আর স্নান করতে। যখন সে স্নান করছে, বাইরে থেকে তার রুম পার্টনারের গলা পায়– সে বলছে, ‘স্নান করে নিচের লনে চলে এসো, আমরা সবাই সেখানে যাচ্ছি– একটু গানবাজনা হবে।’ আমার সেই আত্মীয় ফ্রেশ হয়ে নিচের লনে যায় আর দেখে পরিচালক আর বাকি কলাকুশলীরা সবাই গোল হয়ে বসে রয়েছে, মদ্যপান আর গান দুটোই চলছে পুরো কদমে। তাদের মধ্যে গিয়ে বসে পড়ে আর ‘জলচিকিৎসা’ চালাতে থাকে। তার আবার পেটে মদ পড়ে ভালোভাবে সেটল করে গেলে গান পায়, তাই একসময় গাইতে শুরু করে। সে রীতিমতো ভালো গান গায়, সবার বাহবার মধ্যে মশগুল হয়ে একের পর এক গান গেয়ে চলে আর এক সময় লনের ঘাসেই গা এলিয়ে দেয়। যখন তার ঘুম ভাঙে, আশপাশে কেউ নেই। ওকে কেউ ডেকে নিয়ে যায়নি বলে রাগে-দুঃখে-নেশায় মাখামাখি হয়ে ঘরে ফেরে। রুমমেট দরজা খুলে ‘এত রাত অবধি কোথায় ছিলে?’ বলে শুয়ে পড়ে। আমার আত্মীয়ও কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়ে। সকালবেলা রুমমেটকে চেপে ধরে, আমাকে না নিয়ে ফেরত চলে এলি কাল রাতে?’ রুমমেট হতভম্ব হয়ে জানায় যে, কাল রাতে সে ঘর থেকে বেরয়ইনি। তার কথা বিশ্বাস না করে সে অন্যান্য ঘরে যায় যারা রাতের মেহফিলে উপস্থিত ছিল, সবাই একই কথা বলে। পরিচালক তার সঙ্গে এ-ও বলে যে, ‘শুরুতেই তো বলে দেওয়া হয়েছিল যে রাতে কেউ যেন বাইরে না যায়, জায়গাটার বদনাম আছে। কেউ বেকার যাবে কেন?’ আমার আত্মীয় আজও জানে না সেদিন রাতে ও কাদের গান শুনিয়েছিল মদের ঘোরে, কিন্তু এরপর ও যখনই সেই রাজবাড়িতে শুটিং করতে গিয়েছে, একদিন রাতে এক পেট মদ খেয়ে লনে বসে গান গেয়ে আসে।

লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত কার্টুনগুলি শিল্পী বিনয় বসুর আঁকা এবং
সচিত্র শিশির পত্রিকা থেকে সংগৃহীত