
উর্দিপরা বেয়ারার আনাগোনা, রেস্তোরাঁর বিলিতি ‘টুং টাং’-য়ের বড়লোকি বাদ্যি শুনতে-শুনতে জীবনে বহু মদ খেয়েছি। কিন্তু খাল-বিলের ধারে উবু হয়ে বসে মাল টানা শ্রেণির সঙ্গে অদ্যাবধি সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়নি। আর মরার পর শাস্ত্রমতে স্বর্গ না নরক কোথায় যাব যখন জানি না, তাই ফোকটে নরকদর্শনের সুযোগ ছাড়ার মানেও হয় না। তাছাড়া মদের ‘পাতাললোক’ না দেখলে, বারবেলা নামক সুরা সফর অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যে! সে অসমাপ্ত দিস্তেখাতা লোকে পড়বেই বা কেন?
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
৭.
‘বারবেলা’ বড়ই বিদঘুটে ব্যারাম। অবশ্যি ব্যারাম না বলে ইহাকে ব্যায়ামও বলা যায়! তন-মনকে তন্দরুস্ত রাখার জবরদস্ত ব্যায়াম। কোথাও কিছু নেই, দিব্য ভ্যারেন্ডা ভাজছি। শাখে শাখে পাখি ডাকছে। খাচ্ছি-দাচ্ছি। বাঁশি বাজাচ্ছি। নিত্য হাজিরা দিয়ে অফিসকে কৃতার্থ করছি। আচমকা টান! প্রথমে শরীর জুড়ে আনচান, তারপর একেবারে রগেরগে টান! হেঁ হেঁ, বুঝলেন না তো? সেই!
এ ব্যথা কী যে ব্যথা
বোঝে কি আনজনে
উপশম হবে শুধু
দেদার মদ্যপানে!
কিন্তু বাই উঠলেই কটক যাওয়া যায় না। মদও খাওয়া যায় না। তার জন্য শাগরেদ লাগে। যথাযথ। মদ-মনস্ক। আমাদের আপিসেই একখানা জবরদস্ত টিম রয়েছে, যেখানে অধিকাংশই সুরা-সেবক। গেল হপ্তার দুপুরে দিলাম তাদের ধরে টান। যে যার ডিপার্টমেন্টে ‘নিকুচি করেছে’ বোর্ড ঝুলিয়ে বেরিয়ে তো পড়লাম। মুশকিল হল, রাস্তায় বেরিয়ে। যাব কোথায়? কোন চুলোয়? ওদিকে সময় বেশি নেই। ফিরে এসে দিনগত পাপক্ষয়ে বসতে হবে। ভেবে দেখলাম, ছোট-বড় বিবিধ বারে পূর্ণ ও অস্তমিত যৌবন পার করলেও, এক জায়গায় ইহজীবনে কখনও যাওয়া হয়নি। বাংলার ঠেকে!
খবর ছিল, ওয়েলিংটনের কাছে একখানা আছে। দেশি মদের দোকান। একবার ঘুরে এলে মন্দ হয় না। উর্দিপরা বেয়ারার আনাগোনা, রেস্তোরাঁর বিলিতি ‘টুং টাং’-য়ের বড়লোকি বাদ্যি শুনতে-শুনতে জীবনে বহু মদ খেয়েছি। কিন্তু খাল-বিলের ধারে উবু হয়ে বসে মাল টানা শ্রেণির সঙ্গে অদ্যাবধি সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়নি। আর মরার পর শাস্ত্রমতে স্বর্গ না নরক কোথায় যাব যখন জানি না, তাই ফোকটে নরকদর্শনের সুযোগ ছাড়ার মানেও হয় না। তাছাড়া মদের ‘পাতাললোক’ না দেখলে, ‘বারবেলা’ নামক সুরা সফর অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যে! সে অসমাপ্ত দিস্তেখাতা লোকে পড়বেই বা কেন?
অগত্যা, বুকে বল এনে ওয়েলিংটন গেলাম। দেশি মদের দোকানে ঢুকলাম। সমস্ত দেখলাম। এবং দেখেটেখে সোজা ছিটকে গেলাম!

অ্যাদ্দিন জানতাম, মদ হল শান্তির দুপুর-কেদারা। বা দুপুরের শান্তি-পুকুর। মন ভালো থাকলে মানুষ মদ খায়। মন খারাপ থাকলে খায়। প্রেমে পড়লে খায়। প্রেম ভাঙলে খায়। অতি ঘনিষ্ঠ কাউকে কাউকে দেখেছি, দিন-রাত্তির খায়। কাউকে কাউকে আবার মদই দিবারাত্র খায়! নিঃসন্দেহে, সুরা অতীব সুন্দর। নারীর ঠোঁটের মতোই গোলাপি। তবু কিছুতে সে আবশ্যিক বা ‘নেসেসিটি’ নয়, কখনও ছিল না। ক্ষুধার আগুন, ভাতের খিদে কখনও মদে নেভে না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এ যাবৎ যা জানতাম, ভুল জানতাম। বলতে গেলে, মদ নিয়ে এত দিন কিছুই জানতাম না, কিস্যু না। তাই যা লিখেছি এ পর্যন্ত, সব জঞ্জাল! ফালতু! বকওয়াস!
মানুষ কতটা নিরুপায় হলে বমির পাশ থেকে বাংলার বোতল তুলে নেয়? কতটা অসহায় হলে সে ভ্রুক্ষেপ করে না প্রস্রাবের ‘সুবাস’? কতটা হিতাহিতশূন্য হলে তার চোখে পড়ে না আবরণের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা আরশোলার শুঁড়?
নাহ্, এক পাত্তরও সেদিন ওয়েলিংটনের ঝুরঝুরে দোতলা বাড়িতে বসে খেতে পারিনি। না আমি, না আমরা। খাওয়া সম্ভব ছিল না। আদর-আপায়্যান-সোহাগে কোনও ত্রুটি ছিল, চরম শত্তুরেও বলতে পারবে না। শশব্যস্ত কর্মীরা দেখামাত্র বুঝে গিয়েছিলেন, ‘এনারা’ সব ‘ইলিংশ বাবু’। ভরপুর বোঁটকা খোশবুওয়ালা বাংলা মালের খদ্দের নয়। কাউন্টার থেকে হাঁক পেড়ে একজন বললেনও যে, ‘বাইরে থেকে ইলিংশ পাবেন। যা ইচ্ছে নিয়ে, ওপরে চলে যান স্যর।’ দেশি মদের দোকানেও যে এহেন শ্রেণি বিভাজন চাক্ষুষ করব, ভাবিনি! অবশ্যি নিচের দশা যে দারুণ খোলতাই ছিল, তা নয়। টিমটিমে দু’খানা টিউবলাইট। ক্ষীণ শক্তি নিয়ে যারা শেষ দুপুরের মরা আলোয় প্রাণ সঞ্চারের প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। টেবিল-চেয়ারের বালাই নেই। টানা কাউন্টার থেকে বাংলা কেন। কিনে মাটিতে বসে পড়ো। দু’-একজনকে দেখলাম, ইতিমধ্যে লটকে পড়ে নাক ডাকছে। চুল ভিজিয়ে নেশা করলে, যা হয় আর কী! কয়েক জন গোল করে বসে নেশা সহযোগে গজল্লা করছে। সবই দিন আনি দিন খাই শ্রেণি। তখনই নজরে পড়ল, একজনের লুঙ্গির ফাঁক দিয়ে ফুরফুরিয়ে বেরিয়ে আসছে একখানি আরশোলা। শহুরে বাবুদের আঁতকে ওঠার মতো দৃশ্য বটে!
কী জানি কী মনে হল, সদলবলে চললাম ওপরে। দোতলায়। মনুষ্য প্রস্রাবের স্রোতস্বিনী নদী পেরিয়ে! আরে, বিয়ার নিয়ে বসি না বসি, বসার জায়গাটা তো দেখে আসি। জরাজীর্ণ সিঁড়ি চড়ে যে অঞ্চলে পৌঁছলাম, এক লহমায় তাকে জেলখানা বলে ভুল হবে! পরপর গোটা কতক বেঞ্চি। সহস্র বছরের ধুলোর গয়না পরে যা চটুল দৃষ্টিতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। মাথার উপর ফড়ফড় করছে চার-পাঁচখানা পাখা। এক পাশে কাউন্টার। তার গায়ে পরপর খিলান। অবিকল জেলখানার ‘আর্চ’। পুরনো দিনের হিন্দি সিনেমায় যেমন দেখা যেত। মনে হচ্ছিল, এখনই ওয়ার্ডেন ঘণ্টা বাজাবে। আর যারা ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে মদ গিলছে, সব সুড়সুড়িয়ে ফিরে যাবে গরাদের ওপারে। আর নিচতলার ‘আসুন-বসুন’-এর বিন্দুমাত্র এ তল্লাটে নেই। বেশ দেখলাম, কয়েক জোড়া রক্তাভ ভাঁটার মতো চোখ চার মক্কেলকে জরিপ করছে। সে দৃষ্টির ভাষাও অনায়াসে পড়া যায়– শ্লা ফোট! বিলিতি মাল গেলা পাবলিক যত! বাংলার ঠেকে ন্যাকামি মারতে এসেছ শ্লা!

‘কী রে, এখানে বসে বিয়ার খাবি নাকি?’ মিহি গলায় সহকর্মী উত্তর দিল, ‘না’। ভয় হল, যা শান্তশিষ্ট-ভদ্রসভ্য ছেলেটা, এরপর না মদ খাওয়ার ইচ্ছেই চিরতরে চলে যায়! আমি নিজেও সাহস পাইনি। বলা যায় না, নেশা চড়লে আবার কী থেকে কী হয়ে যাবে! ফালতু ক্যাচালে দরকারও বা কী? সরসরিয়ে নেমে আসার সময় অন্তিম ধাক্কাটা খেলাম। নিচে দেখি, কার যেন বমি ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। আর তার পাশ থেকে বাংলার বোতল তুলে নিচ্ছে আর একজন! অবলীলায়। নির্বিকার মুখে।
দেখামাত্র একখানি ছবি মনে পড়ে গেল। চাঁদনি চকের ‘ব্রডওয়ে’ বার-কাম-রেস্তোঁরার এক ছবি। তার দেওয়ালে টাঙানো বাংলার মন্বন্তরের ছবি। যেখানে ক্ষুধার অসীম তাড়নায় ছটফটানো মানুষ দোরে-দোরে ‘ভাত দাও, ফ্যান দাও’ হাহাকারে আকাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে। বাতাসে অদৃশ্য কুণ্ডলী পাকিয়ে মিশে যাচ্ছে তার পাকস্থলীর পোড়া ধোঁয়া।

ঘামছিলাম, ঘামছিলাম খুব। হনহনিয়ে হাঁটছিলাম ‘ছোটা ব্রিস্টলের’ দিকে (সে গল্প লিখব পরের দিন)। আসলে জীবনে অকাতর নেশা করেছি। নেশা দেখেছি। শুধু দেখিনি, জ্বলন্ত নেশায় নাইকুণ্ডলী ভিজিয়ে মানুষের অন্তর্জলীযাত্রা। দেখিনি, তার নৃশংস সর্বগ্রাসী দহন। কেন জানি না মন বলছিল, এরাও অমন। ব্রডওয়ের ছবিরই মতো। এরা ভাত বলতে মদ বোঝে, ডাল বলতেও মদ বোঝে। আর হাত থেকে বোতল কেড়ে নিলে, এরাও ধেয়ে আসবে ছবির কঙ্কালসার শবদেহের মতো। বোধ-বুদ্ধি-ণত্ব-ষত্ব-মনুষ্যত্ব সমস্ত বিসর্জন দিয়ে। মরা মাছের দৃষ্টি আর প্রলাপের বুলি নিয়ে।
মদ দাও, মদ দাও, আমাদের দু’-এক ফোঁটা মদ দাও!
… পড়ুন বারবেলা-র অন্যান্য পর্ব…
৬. সে টাওয়ারে মাতালরা আর কানেকশন পায় না
৫. যে পানশালার প্যাঁচালো সিঁড়ি, খোলা জানালা, লাল মেঝে-খসা পলেস্তারায় পুরনো প্রেমিকার মায়া
৪. একসময় কুকুর আর ভারতীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল নিউ ক্যাথে রেস্তোরাঁ-কাম-বারে
৩. ‘চাংওয়া’-র কেবিনই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাসরঘর!
২. মহীনের ঘোড়াগুলির প্রথম ‘আস্তাবল’ ডিউক
১. তেতাল্লিশের মন্বন্তরে ‘বার’ থেকে ‘রেশন সেন্টার’ হয়ে উঠেছিল ব্রডওয়ে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved