Robbar

এসআইআর বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে খোলা চিঠি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 15, 2025 5:38 pm
  • Updated:November 15, 2025 5:38 pm  

একটি গণতন্ত্রের সাফল্য শুধু এটা দিয়ে বোঝা যায় না যে, ব্যবস্থাটা কত দক্ষভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে হিসেবের মধ্যে আনতে পারে, ভুলে যাওয়া অল্প কয়েকজনকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সেই ব্যবস্থাটা কতটা সৎ সেটাও বিবেচ্য। নাগরিকত্ব কখনও ভৌগোলিক অবস্থান বা সম্পত্তি দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে না। বরং যারা এই দুটোই হারিয়েছে– ত্যক্ত, স্থানচ্যুত, সেরে ওঠার প্রক্রিয়ায় থাকা মানুষদের কাছে পৌঁছতে পারাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। যদি ভোটাধিকারই রাষ্ট্রের কাছে আমাদের দৃশ্যমান করে তোলার শর্ত হয়, তবে অদৃশ্যতা এক নাগরিক ক্ষত।

আলোকচিত্র: সিদ্ধার্থ পাল

রত্নাবলী রায়

প্রতি
মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার
ভারতের নির্বাচন কমিশন
নির্বাচন সদন, নয়াদিল্লি

মাননীয় মহাশয়,

ভোটার তালিকা কেবল একটি প্রশাসনিক নথি নয়, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য এটি তাঁর ব্যক্তি-অস্তিত্বের স্বীকৃতি। এর প্রতিটি নাম, মানে পছন্দ-অপছন্দের অধিকার নিয়ে একজন ব্যক্তিমানুষের অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা, তালিকাভুক্ত না হওয়া মানে মুছে যাওয়া। বর্তমানে ভারতের নির্বাচনী তালিকার বিশেষ নিবিড় পর্যালোচনা চলাকালীন, আমরা– মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, আশ্রয়কেন্দ্র ও রাস্তায় বসবাসরত মানুষের সঙ্গে কাজ করা সংগঠন ও নাগরিকরা, কিছু জরুরি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি– যেগুলো সাংবিধানিক নাগরিকত্বের মূল বোঝাপড়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলেই আমাদের মনে হয়েছে।

দেশজুড়ে হাজার হাজার নাগরিক– গৃহহীন মানুষ এবং মানসিক অসুস্থতার ইতিহাস থাকা মানুষ– যাঁরা মানসিক হাসপাতাল, হাফওয়ে হোম ও নাইট শেল্টারের আশ্রয়ে রয়েছেন– এই পর্যালোচনা প্রক্রিয়া হয় তাঁদের কাছে পৌঁছচ্ছে না বা তাঁরা নিজেদের তালিকায় খুঁজে পাচ্ছেন না; এবং না পেলে কী করতে হবে– সেটা নিয়েও কোনও পরিষ্কার বোঝাপড়ার হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। এই মানুষদের এরকম মুছে যাওয়া নেহাতই আকস্মিক নয়, কাঠামোগত একটি সমস্যা বলেই মনে হচ্ছে।

বাস্তবে, ভোটার তালিকা ধরে নেয় একটি স্থায়ী ও প্রমাণযোগ্য বাসস্থান। কিন্তু যাঁদের জীবনই সংজ্ঞায়িত হয় স্থান থেকে স্থানান্তরে সরে সরে যাওয়া দিয়ে– যাঁরা উড়ালপুলের নিচে, হাসপাতালের ওয়ার্ডে, বা অস্থায়ী আশ্রয়ে রাত কাটান– তাঁদের কী হবে? যখন কোনও সরকারি আধিকারিক জিজ্ঞেস করবেন, ‘আপনার নিয়মিত বাসস্থান কোথায়?’, তখন আশা-র মতো কেউ, যে গত দুই বছরে পাঁচ জায়গায় থেকেছে– কী উত্তর দেবে? ‘বাড়ি মানে দেওয়াল, তাই তো?’ পাল্টা প্রশ্ন করে আশা হেসে ফেলে, ‘আমাদের তো শুধু আকাশ আছে।’

এইরকম গল্প প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে আছে, যেগুলো বোঝায়, সংবিধানের ৩২৬ অনুচ্ছেদ ও ১৯৫০ সালের Representation of the People Act-এর অধীনে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের প্রতিশ্রুতি কীভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে, আর তা নিয়ে কোনও কথাও হচ্ছে না। এই ফাঁকটি খুব যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত– এমন হয়তো নয়, তবে উদ্ভাবনী কল্পনার অভাব। আর আজ আমরা কমিশনের কাছে সেই উদ্ভাবনী কল্পনার আবেদন রাখছি।

কমিশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নসমূহ

১. যেহেতু ২০২১ সালে কোনও জাতীয় জনগণনা হয়নি, তাহলে এই SIR চলাকালীন জনসংখ্যার ভিত্তি ও বাদ-পড়া নাম নির্ধারণে কোন তথ্যসূত্র ব্যবহার করা হচ্ছে?

বিশ্বাসযোগ্য কোনও জনগণনা ব্যতিরেকে স্থায়ী ঠিকানা বা নথিপত্রহীন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে নাম মুছে দেওয়াটা যে ন্যায়সংগত হল– সেটা প্রতিষ্ঠা করা হবে কীভাবে?

২. মানসিক হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র বা হাফওয়ে হোমে থাকা ব্যক্তিদের ভোটাধিকার রক্ষার জন্য কী নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে? বিশেষত যাঁদের পরিবার নেই, অথবা যাঁদেরকে ‘অজানা’ (unknown) হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে?

৩. মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির বিধি-বন্দোবস্ত সম্পর্কে কি নির্বাচন কমিশন কোনও নির্দেশিকা জারি করেছে? করে থাকলে, কীভাবে তারা নিশ্চিত করছে যে নিবন্ধন প্রক্রিয়া ভোটারের সচেতন সম্মতি অনুযায়ীই হচ্ছে, অভিভাবকত্ব-মূলক বা প্রতিনিধিত্ব-মূলক নয়?

৪. যাঁদের কাছে ১২টি অনুমোদিত পরিচয়পত্রের একটিও নেই, হয়তো চুরি হয়েছে বা বলপূর্বক বা আকস্মিক কোথাও থেকে উৎখাত হয়েছেন বলে হারিয়ে গিয়েছে, বা মানসিক অসুস্থতার কারণে হারিয়েছেন– তাঁদের পরিচয় যাচাইয়ের জন্য কী ব্যবস্থা আছে?

৫. যাঁরা দীর্ঘমেয়াদে কোনও প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন তাঁদের ‘বসবাসের ঠিকানা’ কীভাবে নির্ধারিত হবে? সরকারি মানসিক হাসপাতাল ও নিবন্ধিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে কি আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটার নিবন্ধনের ঠিকানা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব?

৬. প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে বা স্থানান্তরের পর ভোটার তালিকায় একজনের ধারাবাহিকতা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? পুনর্বাসিত ব্যক্তিদের নাম নতুন জায়গার ভোটার লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য রাখার জন্য কোনও ট্র্যাকিং ব্যবস্থা আছে কি?

৭. সবশেষে, প্রতিষ্ঠানিক পরিবেশে থাকা ব্যক্তিদের ভোটদান যেন সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবী ও কোনও প্রশাসনিক চাপমুক্ত হয়, কমিশন তা কীভাবে নিশ্চিত করবে?

আমাদের সুপারিশ

প্রতিষ্ঠানকে বৈধ বাসস্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক: মানসিক হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র ও হাফওয়ে হোমকে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সচেতন সম্মতির ভিত্তিতে ভোটারের বৈধ ঠিকানা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।

ভ্রাম্যমাণ গণনা দল নিয়োগ করুন: মানসিক স্বাস্থ্য-প্রতিষ্ঠানগুলিতে ও গৃহহীন মানুষদের রাত্রিবাসের জায়গাগুলিতে বুথ-স্তরের আধিকারিকদের সঙ্গে, মানবাধিকার সংগঠন ও মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ দল প্রেরণ করা হোক।

অভিভাবক-কেন্দ্রিকতা মুক্ত যাচাইকরণ ব্যবস্থা গড়ুন: যাঁদের পারিবারিক যোগাযোগ ভেঙে গিয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে অনুমোদিত কমিউনিটি কর্মী বা ওয়ার্ড অফিসারের শংসাপত্রে যাচাইয়ের সুযোগ দিন।

অন্তর্ভুক্তি রেজিস্টার বজায় রাখুন: প্রতিটি জেলায় প্রতিষ্ঠান থেকে ফিরে আসা বা স্থানান্তরিত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি ও ধারাবাহিকতা ট্র্যাক করার রেজিস্টার তৈরি করা হোক।

নৈতিক তদারকি নিশ্চিত করুন: প্রতিষ্ঠানের হেফাজতে থাকা মানুষদের জন্য নাম নথিভুক্তকরণের প্রক্রিয়ায় যাতে প্রত্যেকেই নিজস্ব পছন্দ স্বাধীনভাবে অনুশীলনের সুযোগ পান, তার জন্য স্বাধীন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হোক।

কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?

একটি গণতন্ত্রের সাফল্য শুধু এটা দিয়ে বোঝা যায় না যে, ব্যবস্থাটা কত দক্ষভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে হিসেবের মধ্যে আনতে পারে, ভুলে যাওয়া অল্প কয়েকজনকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সেই ব্যবস্থাটা কতটা সৎ সেটাও বিবেচ্য। নাগরিকত্ব কখনও ভৌগোলিক অবস্থান বা সম্পত্তি দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে না। বরং যারা এই দুটোই হারিয়েছে– ত্যক্ত, স্থানচ্যুত, সেরে ওঠার প্রক্রিয়ায় থাকা মানুষদের কাছে পৌঁছতে পারাটাই বড় চ্যালেঞ্জ।

যদি ভোটাধিকারই রাষ্ট্রের কাছে আমাদের দৃশ্যমান করে তোলার শর্ত হয়, তবে অদৃশ্যতা এক নাগরিক ক্ষত।

প্রশ্নটা এটা নয় যে তাঁরা ভোট দিতে চান কি না! রাষ্ট্র কি অবশেষে তাঁদের ভোটার হিসেবে দেখতে চায়?– সেটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমাদের আবেদন, এটা যেন সাংবিধানিক কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারও প্রতি কারও কোনও দয়ার দান নয়।

কারণ ভোটাধিকারের শুরুটা ব্যালট থেকে হয় না, শুরু হয় তালিকার একটি নাম থেকে।

ইতি,
রত্নাবলী রায়
গৃহহীন ও সেরে-ওঠা মানসিক স্বাস্থ্য-সংকটে থাকা মানুষের পক্ষে কাজ করা এক নাগরিক