
“…আমার চিন্তার জগতে ওঁর চেয়ে আপনজন আমার আর কেউ নেই। যখন মারা গেলেন, তখন আমি বঙ্গবাসী কলেজের সেকেন্ড ইয়ার আইএসসি-র ছাত্র– ১৭ বছরের তরুণ। সারা কলকাতা ভেঙে পড়া সেই মৃতদেহের প্রোসেশন দেখলাম, আর লাউড স্পিকারে বাজছিল তাঁর কণ্ঠের ‘বহুদিন মনে ছিল আশা/ ধরণীর এক কোণে/ রহিবে আপন মনে’। আমি একটা বাড়ির রকে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম। সেই আমার সচেতন জীবনের প্রথম আত্মীয় বিয়োগ।…”
অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী ‘জীবন উজ্জীবন’-এ এক জায়গায় সলিল চৌধুরী লিখছেন–
‘…রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনে যখন এলেন, তখন আমি ক্লাস VIII-এর ছাত্র। স্কুলে প্রাইজ পেয়েছিলাম সঞ্চয়িতা আর গল্পগুচ্ছ দু’খণ্ড। রবীন্দ্রনাথ পড়ার পর মনে হল এতদিন যা পড়েছি সব জোলো। তাঁর কবিতা আবৃত্তি করেই আমি Recitation-এ ফার্স্ট হয়েছি বহুবার। পাগলের মতো এর-ওর-তার থেকে চেয়ে কিংবা লাইব্রেরি থেকে জোগাড় করে অনেক রাত জেগে জেগে পড়তাম।… এক একটা কবিতা বার বার পড়ে খুঁজতে চাইতাম যেন ওঁর জাদুটা কোথায় লুকিয়ে আছে। তখন আমি তেরো-চোদ্দ বছরের কিশোর, তবু তাঁর অসম্ভব পরিশীলিত refined মনকে যেন বুঝতে পারতাম। কেন জানি না, তাঁকে আমার পরমাত্মীয় মনে হত।… জীবনে যদিও কোনোদিন তাঁকে কাছ থেকে দূরে থাক, দূর থেকে দেখারও সৌভাগ্য হয়নি, মনে হত আমার চিন্তার জগতে ওঁর চেয়ে আপনজন আমার আর কেউ নেই। যখন মারা গেলেন, তখন আমি বঙ্গবাসী কলেজের সেকেন্ড ইয়ার আইএসসি-র ছাত্র– ১৭ বছরের তরুণ। সারা কলকাতা ভেঙে পড়া সেই মৃতদেহের প্রোসেশন দেখলাম, আর লাউড স্পিকারে বাজছিল তাঁর কণ্ঠের ‘বহুদিন মনে ছিল আশা/ ধরণীর এক কোণে/ রহিবে আপন মনে’। আমি একটা বাড়ির রকে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম। সেই আমার সচেতন জীবনের প্রথম আত্মীয় বিয়োগ। কাউকে না বলে এক মাসের অশৌচ নিলাম। তখনো দাড়িগোঁফ ভালো করে ওঠেনি– কামাবার প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু খালি পায়ে কলেজে আসতাম, মাছ-মাংস খেতাম না।… তখন আমি গ্রাম থেকে ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করতাম। বেলেঘাটা (শিয়ালদহ সাউথ) স্টেশন থেকে খালি পায়ে হেঁটে বঙ্গবাসী কলেজ পর্যন্ত কলকাতার পিচগলা রাস্তায় আসতে পায়ের পাতায় ফোসকা পড়ার মতো হত, কিন্তু ওটুকু কষ্ট আমার সবচেয়ে প্রিয়জনের জন্য করছি ভেবে ভালো লাগত। মনে আছে, দিদিমা বা মামারা কেউ আমাকে কিছু বলেননি।* শুধু অবাক হয়ে বোঝবার চেষ্টা করতেন কী দুঃখ আমার জীবনে ঘটল। সে কথা তাঁদের বোঝাবার আমার কোনো উপায় ছিল না…’

রবীন্দ্র-উত্তর পর্বের একদম গোড়ার দিকে শিল্প-সাহিত্যের সৃজনবোধে জারিত তরুণ বঙ্গমননে তাঁর মোহাচ্ছন্নতা একরকম স্বাভাবিক নিয়মেই এসে দাঁড়িয়েছিল। সলিল চৌধুরীও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে ‘পরমাত্মীয়’ মেনে ‘অশৌচ’ পালন হয়তো খানিক ব্যতিক্রমীই। রবীন্দ্রনাথের পরলোক গমনের দু’-বছরের মাথায়, অর্থাৎ ১৯৪৩-এ সলিল চৌধুরী ছোট্ট একটি নোটবইয়ে লেখালেখি শুরু করেন, প্রায় ডায়েরি লেখার ঢঙে। পারিপার্শ্বিক দেশকাল তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও মহামন্বন্তরের ধাক্কায় এলোমেলো। বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ততদিনে শামিল হয়ে গেলেও কলেজ-ছাত্র সলিল আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গণনাট্য’-এর কর্মী হয়ে ওঠেননি।

সক্রেটিস-এর ‘Virtue is knowledge’-এর উদ্ধৃতির ব্যবহারে তাঁর ‘রত্নকোষ’ (নোটবইয়ের শিরোনাম) আরম্ভ হলেও, এক্ষেত্রেও নিজের মননকে একান্তভাবে গড়ে তোলার এই অনুশীলনে সলিল চৌধুরী একদম সূচনায় সেই রবীন্দ্রনাথেই মিশিয়েছেন নিজেকে। ফাউন্টেন পেনে গুরুদেবের রেখাচিত্র আর তাঁর প্রতি চার-পঙ্ক্তির এক নিবেদনে। স্পষ্টতই যেন তা সৃজন-উন্মুখ এক সত্তার অপার প্রশ্রয়প্রাপ্তির স্বীকারোক্তি। যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন– ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,/ বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া…’, তেমনই সমগোত্রীয় বিশ্ববোধে উদ্বুদ্ধ সলিল উত্তরকালে লিখবেন– ‘এবার আমি আমার থেকে আমাকে বাদ দিয়ে/ অনেক কিছু জীবনে যোগ দিলাম…’।
*সেই সময় সলিল চৌধুরী পড়াশোনার সূত্রে থাকতেন হরিনাভিতে, মাতুলালয়ে
…….
কৃতজ্ঞতা: অন্তরা চৌধুরী, অপু দে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved