Robbar

দেশজুড়ে বিএলও মৃত্যু, সরকারের ভ্রান্ত নীতিই কি দায়ী?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 1, 2025 8:51 pm
  • Updated:December 1, 2025 8:51 pm  

যেহেতু সরকারি চাকরি করেন, তাই তাঁদের কোনওরকম আপত্তি বা ‘অজুহাত’-কে মান্যতা না দিয়েই বেছে নেওয়া হয়েছে এই ‘বিএলও’দের। সেই ব্যক্তি কতটা আজকের প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে পারদর্শী, আদৌ তিনি মোবাইলের সমস্ত অ্যাপ্লিকেশন চালাতে পারেন কি না, বাড়িতে তাঁর কোনও নির্দিষ্ট সমস্যা আছে কি না– সেইসব যুক্তির তোয়াক্কা না করেই, তাঁদের বেছে নিয়ে এই কাজে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ, অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে– এই দুই সাঁড়াশি চাপে পড়ে বিএলও-দের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা খারাপ! ফল যা হওয়ার, তাই হয়েছে। তাই আজকে আমরা সারা দেশে এই বিএলও’দের মৃত্যুর খবর পাচ্ছি।

সুমন সেনগুপ্ত

বাংলা-সহ ১২টি রাজ্যে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনী শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে যাঁরা মাঠে নেমে এই কাজটা করছেন, তাঁদের বলা হচ্ছে– ‘বুথ লেভেল অফিসার’ বা ‘বিএলও’। সরকারি শিক্ষা দফতরের প্রাথমিক, মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিক স্তরের থেকে শিক্ষকদের বেছে নেওয়া হয়েছে বুথ লেভেল অফিসার হিসেবে কাজ করার জন্য। বেশ কিছু আশা কিংবা অঙ্গনওয়ারী কর্মীও আছেন আর আছেন পার্শ্বশিক্ষক। তাঁদের কাজ, নির্দিষ্ট অঞ্চল এবং বুথের ২০২৫ সালের যে ভোটাররা আছেন তালিকা ধরে ধরে তাঁদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত ইনিউমারেশন ফর্ম দেওয়া। সম্পূর্ণ বিষয়টা ভোটারদের বোঝানো, তারপর সেই ফর্ম ফেরত নেওয়া। এই অবধি কাজ করতে হবে বলে তাঁদের এই কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল। পরে কমিশন জানায় যে-ফর্ম ওই বিএলওরা ভোটারদের থেকে ভরা অবস্থায় ফেরত নিচ্ছেন, সেই তথ্য ২০০২ সালের ভোটার তালিকার তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে কমিশনের ওয়েবসাইটে আপলোডও করতে হবে, নির্দিষ্ট মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে।

প্রতীকীচিত্র

যেহেতু সরকারি চাকরি করেন, তাই তাঁদের কোনওরকম আপত্তি বা ‘অজুহাত’-কে মান্যতা না দিয়েই বেছে নেওয়া হয়েছে এই ‘বিএলও’দের। সেই ব্যক্তি কতটা আজকের প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে পারদর্শী, আদৌ তিনি মোবাইলের সমস্ত অ্যাপ্লিকেশন চালাতে পারেন কি না, বাড়িতে তাঁর কোনও নির্দিষ্ট সমস্যা আছে কি না– সেইসব যুক্তির তোয়াক্কা না করেই, তাঁদের বেছে নিয়ে এই কাজে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ, অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে– এই দুই সাঁড়াশি চাপে পড়ে বিএলও-দের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা খারাপ! ফল যা হওয়ার, তাই হয়েছে। তাই আজকে আমরা সারা দেশে এই বিএলও’দের মৃত্যুর খবর পাচ্ছি। কেউ আত্মহত্যা করছেন। কেউ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। বাংলার এক বিএলও, যিনি নিজে একজন পার্শ্বশিক্ষিকা, তিনি মারা যাওয়ার আগে তাঁর সুইসাইড নোটে লিখেছেন, ‘আমি বাঁচতে চাই, আমার সংসারে কোনও অভাব নেই। কিন্তু এই সামান্য চাকরির জন্য এরা আমাকে এই ভাবে ভরাডুবির মাধ্যমে মরতে বাধ্য করল। আমার এই পরিণতির জন্য নির্বাচন কমিশন দায়ী, আমি কোনও রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করি না। খুবই সাধারণ মানুষ। কিন্তু এই অমানুষিক কাজের চাপ আমি নিতে পারছি না। আমি একজন পার্শ্বশিক্ষিকা। বেতন পরিশ্রমের তুলনায় খুবই কম। কিন্তু এরা আমাকে ছাড় দিল না। অফলাইন কাজ আমি ৯৫ শতাংশ শেষ করে ফেলেছি কিন্তু অনলাইন আমি কিছুই পারি না। বিডিও অফিসে এবং সুপারভাইজারকে জানানো সত্ত্বেও কোনও ব্যবস্থা করল না।’

সম্পূর্ণ সুইসাইড নোটটি পড়লে যে কোনও সংবেদনশীল মানুষের অস্বস্তি হতে বাধ্য। কিন্তু আমরা এতটাই অমানবিক হয়ে গিয়েছি যে, আমরা রিঙ্কুকেই দোষারোপ করছি, বলছি সে ‘অযোগ্য’, কিন্তু এই অযোগ্য মানুষটিকে তো বেছে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সুইসাইড নোটের শেষের দিকে মৃত রিঙ্কু তরফদার এটিও পরিষ্কার করেছেন যে, তাঁর এই মৃত্যুর জন্য তাঁর পরিবারের কেউই কোনওমতেই দায়ী নয়। প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, এইরকম একটি সুইসাইড নোট প্রকাশ্যে আসার পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত কেন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কোনও স্বতঃপ্রণোদিত মামলা শুরু করবে না? কেন তাঁর মৃত্যুর দায় নেবে না কমিশন?

গত ২৬ দিনে প্রায় ২০ জন বিএলও মারা গিয়েছেন। এখনও অবধি যা খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মধ্যপ্রদেশেই ৯ জন বিএলও মারা গিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশে এখনও অবধি ৪ জন মারা গিয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম বিপিন যাদব। যিনি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করার আগে বলেছেন, তাঁর কাছে ওপরমহলের চাপ ছিল গরিব, প্রান্তিক মানুষদের নাম খসড়া তালিকায় যাতে না থাকে। বাংলার ভোটার সংখ্যা আনুমানিক ৭.৬৫ কোটি। বাংলার জন্য যদি একমাস সময় দেওয়া হয়, তাহলে যে রাজ্যের ভোটার সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি, সেই উত্তরপ্রদেশের জন্যও কি একই সময়সীমা ধার্য হতে পারে? এটা কোনও বাস্তব সমাধান?

একজন শিক্ষকের কাজ শিক্ষাদান করা। তাঁকে দিয়ে নির্বাচন কমিশন জোর করে এই বুথ লেভেল অফিসারের কাজ করাচ্ছে। তাঁর একটু ভুলে যে কোনও মানুষের নাম বাদ যেতে পারে! তাঁর ফোন নম্বর সবাই জানে। নাম বাদ গেলে কোনও ব্যক্তি ছেড়ে কথা বলবেন না। রাজনৈতিক দলগুলোও রেয়াত করবে না, সাধারণ মানুষের ক্ষোভ এসে পড়বে ওই বিএলও-দের ওপর। কেউ তখন শুনবেন না যে, ওই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি এক্কেবারে দুচ্ছাই! যে সংস্থা ওই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি বানিয়েছে, তা টিসিএস। প্রতিদিন ওই অ্যাপ্লিকেশনটির নানা রকমের সমস্যা হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। কোনও দিন সম্পাদনার সুযোগ থাকছে, পরের দিন সেই সুবিধা উধাও! বহু মানুষ একসঙ্গে ওই অ্যাপ্লিকেশনটি খুলছেন, ফলে ব্যান্ড উইদথ কম, ফলে ঘুরেই চলেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা! কে কাকে চালাচ্ছে– সেটাই বিচার্য। যদি মানুষ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে, তাহলে তার এক ধরনের পরিণতি হয় আর যদি প্রযুক্তি মানুষকে চালনা করে, তার ফলাফল হয় অন্যরকম। খবরে প্রকাশ– ২০০২ সালের তালিকা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ডিজিটাইজ করা হয়েছে। ফলে বিভিন্ন প্রকারের সমস্যা রোজ তৈরি হচ্ছে। দোষ পড়ছে অঞ্চলের বিএলও’দের ওপর। এটাই স্বাভাবিক, কারণ সবারই উৎকণ্ঠা আছে।

ওদিকে সমাজের একাংশের মানুষ অনবরত বলে চলেছেন, এই বিএলওরা অকর্মণ্য– ওঁরা কাজ জানেন না। ওঁদের অযথাই সরকার বসিয়ে বসিয়ে মাইনে দেয়, ওঁদের নাকি শরীরে জং ধরে গিয়েছে। আমার একটাই প্রশ্ন:আপনি বা আপনারা সব কাজ জানেন? যে কোনও ব্যক্তি যিনি বেসরকারি ক্ষেত্রে কাজ করেন, তিনি যদি সরকারি শিক্ষক না-ও হন, বেসরকারি স্কুলেও পড়ান, তাঁকে দিয়ে কি অন্য যে কোনও কাজ করানো যাবে, না উচিত? কোনও কাজই ছোট নয়, কিন্তু এই সমস্যা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। অথচ নির্বাচন কমিশনের দিকে কেউ আঙুল তুলছেন না। এই নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল, বেশ কিছু ৫জি ফোন কিনে, ওই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি ঠিকঠাক হয়েছে কি না, তা দেখে, তারপরে কাজে হাত দেওয়া। কিন্তু সেটা তো হওয়ার নয়। তাঁরা তো কাজটা সুষ্ঠুভাবে হোক, তা চান না, তাঁরা চান সমাজে অরাজকতা তৈরি হোক।

নির্বাচন কমিশনের দিকে আরও নানা কারণে আঙুল তোলা যেতে পারে। যে বিএলও’দের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল কমিশনের, সেই কমিশন কি তাঁদের কোনওরকম সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে? ২০০২ সালেও যে পদ্ধতিতে ভোটার তালিকায় সংশোধন হয়েছিল, সেই সময়েও কি এই সমস্ত বিএলওর নম্বর অঞ্চলের সবাই জানত? আসলে আজকে যাঁদের সবচেয়ে বেশি সুরক্ষার প্রয়োজন ছিল, তাঁদের হাতে কোনও ঢাল-তলোয়ার না দিয়ে যুদ্ধে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আসলে যে সরকার মনেই করে না– যাঁরা তাঁকে ভোট দিয়ে নির্বাচন করেছে, তাঁরা নাগরিক। তাঁদেরকেই আবার নাগরিকত্বের পরীক্ষা দিতে দাঁড় করায়! সেই সরকারই বিএলও’দের সুরক্ষার ব্যবস্থা করবে– এই ভাবনাটাই তো বাতুলতা।

আমাদের বর্তমান সরকারের একটাই লক্ষ্য, মানুষকে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণের সংগ্রামে ব্যস্ত রাখা, যাতে সেই মানুষটি একদিন সকালে উঠে মনে করে, সে যে তাঁর পরিচয় নিয়ে বেঁচে আছে, সেটাই অনেক। সেই সরকার তাঁর নাগরিকদের থেকে কোনও প্রশ্ন শুনতে রাজি নয়, সে বিএলও’দের অন্য কিছু ভাবে না। বিহারের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে– বহু বিএলও অভিযোগ করেছেন, নাগরিকত্বের যে তথ্য প্রমাণ দিতে বলা হয়েছে, তাঁর বেশিরভাগই তাঁদেরও নেই। যেখানে একজন সরকারি কর্মচারী, যাঁকে বিএলও করা হয়েছে, তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে, তাঁর ওপর রোজ চাপ তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে সাধারণ মানুষ যে এখনও বেঁচে আছেন, সেটাই কি যথেষ্ট নয়? প্রতিটি বিএলও’র মৃত্যুর জন্য সরকারের এই ভ্রান্ত নীতিকেইকে দায়ি করা উচিত নয় কি?

……………………….

রোববার.ইন-এ পড়ুন সুমন সেনগুপ্ত-র অন্যান্য লেখা

……………………….