Robbar

সারা বছরের দূষণকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় শীত

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 4, 2025 5:30 pm
  • Updated:December 4, 2025 5:30 pm  

কাজেই বোঝা যাচ্ছে, বায়ুদূষণ কোনও একটি ঋতুর বিষয় নয়। আবার বায়ুদূষণ রোধের লড়াইও এক দিনের বিষয় নয়। এটি একটি ধারাবাহিক লড়াই। উপরের বাতাসে ধূলিকণার সংখ্যার গড় হয়তো শীতকালে বেশি, কিন্তু গড় মান পুরো বছরে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না– এই কথাটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই প্রত্যেক শহর, অলিগলি, বস্তি, শিল্পাঞ্চলে মনোনিবেশ করতে হবে। শ্বাসযোগ্য বাতাস আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। যেমন নদীর জল সব সময় পরিষ্কার রাখতে হয়– তেমনই আবশ্যিক বায়ু সংস্কার, এবং সেই কাজ শুধু শীতে নয়– সারাবছর, প্রতিদিন।

সুপ্রতিম কর্মকার

বাতাসের দূষণকে আমরা অনেকে এখন ‘ঋতুভিত্তিক’ একটি ঘটনা বলে ভাবতে ভালোবাসছি। বিশেষ করে, শীতকাল এলেই সংবাদমাধ্যম, প্রশাসন, আদালত– প্রত্য়েকেই হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে। অথচ দূষণ কখনও কোনও ঋতুতে সীমাবদ্ধ নয়, কোনও দিন ছিলও না। সারা বছরের এক চলমান, জটিল ও মানুষের তৈরি সংকট। শীতের সময় দূষণ ‘দৃশ্যমানভাবে’ বেড়ে ওঠে ঠিকই। কিন্তু তার জন্য শীতকে দূষণের প্রকৃত উৎস বা প্রকৃত সময় হিসেবে ধরা উচিত হবে না। লেপ মুড়ি দেওয়া শীতকাল কেবল উপস্থিত সমস্যাগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সেই সমস্যাগুলোকে জেনেও আমরা বাকি বছরের দীর্ঘ সময় ধরে উপেক্ষা করি।

শীতের দিল্লির আকাশ ঢেকে গিয়েছে দূষণে

শীতের সময়, বায়ুমণ্ডলের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল ‘টেম্পারেচার ইনভারশন’। এই অবস্থায় ঠান্ডা বাতাস মাটির কাছে আটকে থাকে এবং তার ওপর উষ্ণ বাতাসের স্তর তৈরি হয়। ফলে দূষিত কণাগুলি উপরে উঠতে পারে না, নিচেই থমকে থাকে। কলকারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের নির্গমন, ইটভাটার ধূলিকণা– সব মিলিয়ে দূষণ জমা হয় ঘন কুয়াশার পরতের মতো। তাই শীতে দূষণ বেশি মনে হয়; কিন্তু দূষণের উৎপত্তি হচ্ছে অন্যান্য ঋতুতেও সমানভাবেই।

প্রশাসনিক মনোভাবও একটি বড় সমস্যা। কারণ আমরা দূষণকে ‘শীতের সমস্যা’ মনে করি বলেই, বছরের বাকি সময়ে আমাদের প্রস্তুতি থাকে না। দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের নজরদারিতে শীতকালে তৎপরতা বেশি, কিন্তু গ্রীষ্ম বা বর্ষায় একই উৎসগুলো অবাধে দূষণ ছড়াতে থাকে। দূষণ যখন সারা বছরের সমস্যা, সমাধানও হওয়া উচিত সারাবছরব্যাপী। শীতকালে মানুষ দূষণ বেশি অনুভব করে, কারণ চোখে দেখা যায়, ঘ্রাণে ধরা পড়ে, শ্বাসের কষ্ট বাড়ে। 

প্রতীকী চিত্র। সূত্র: ইন্টারনেট।

২০২৪-’২৫ শীতকালে, দিল্লি শহরে গড় PM2.5 ছিল 159 µg/m³, যা NAAQS-এর মাত্রার প্রায় চার গুণ এবং WHO-র সুপারিশকৃত মাত্রার (5 µg/m³) প্রায় ৩২ গুণ। সত্যি বলতে, এই তথ্য রীতিমতো আশঙ্কার বিষয়। প্রসঙ্গত, আইনের পথে মহামান্য আদালতের কিছু মামলার কথা আপনাদের মনে করিয়ে দিই। তাতে আমাদের এই মুহূর্তের অবস্থানটাকে বুঝতে সুবিধা হবে।

এম. সি. মেহতা বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া, বেশি পরিচিত ‘তাজ ট্র্যাপিজিয়াম কেস’ নামে। এই মামলায় তাজমহলের আশেপাশে শিল্পদূষণের কারণে মার্বেলের ক্ষয়ক্ষতি রোধের জন্য আবেদন করা হয়েছিল। মহামান্য আদালতের নির্দেশে, দূষণকারী শিল্পগুলিকে হয় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণ কমানোর জন্য স্থানান্তরিত করতে বলা হয়, না-হয় বন্ধ করে দিতে বলা হয়। এই রায়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আদালতের সক্রিয় ভূমিকার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রতীকী চিত্র। সূত্র: ইন্টারনেট।

আবার, এম. সি. মেহতা বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়ার আরেকটি মামলার কথাও স্মরণ করা যায়। দিল্লির এই দূষণ মামলাটি ছিল দিল্লির ব্যাপক বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের প্রেক্ষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। এই মামলায় আদালতের নির্দেশে দিল্লিতে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সিএনজি (CNG) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়, যা বায়ুদূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সাহায্য করেছে। এছাড়াও, যানবাহনের জন্য ইউরো নির্গমন মান (Euro Emission Norms)-এর মতো কঠোর মাত্রা নির্ধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আবার ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানো (Stubble Burning) সংক্রান্ত মামলাতে প্রধানত দিল্লি সংলগ্ন রাজ্য, যেমন– পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশে নাড়া পোড়ানো নিয়ন্ত্রণে সুপ্রিম কোর্টের সক্রিয় ভূমিকা নির্দেশ করে। সুপ্রিম কোর্ট বারবার এই রাজ্য সরকারগুলিকে ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানো বন্ধ করার জন্য প্রো-অ্যাক্টিভ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে; এবং কৃষকদের ফসল পরিচালনার জন্য আর্থিক সহায়তা ও বিকল্প প্রযুক্তি সরবরাহের ওপর জোর দিয়েছে।

ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানোর দরুন বায়ুদূষণ

বায়ু (প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন, ১৯৮১ [The Air (Prevention and Control of Pollution) Act, 1981] বায়ু দূষণ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং হ্রাস করার ব্যবস্থা করে। এটি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডকে (CPCB ও SPCB) বায়ু দূষণের মান নির্ধারণ ও তা কার্যকর করার ক্ষমতা দেয়। আর সেই ক্ষমতার প্রয়োগ না হলে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তোলে। সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় রাষ্ট্র একেবারেই এড়াতে পারে না।

কাজেই বোঝা যাচ্ছে, বায়ুদূষণ কোনও একটি ঋতুর বিষয় নয়। আবার বায়ুদূষণ রোধের লড়াইও এক দিনের বিষয় নয়। এটি একটি ধারাবাহিক লড়াই। উপরের বাতাসে ধূলিকণার সংখ্যার গড় হয়তো শীতকালে বেশি, কিন্তু গড় মান পুরো বছরে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না– এই কথাটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই প্রত্যেক শহর, অলিগলি, বস্তি, শিল্পাঞ্চলে মনোনিবেশ করতে হবে। শ্বাসযোগ্য বাতাস আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। যেমন নদীর জল সব সময় পরিষ্কার রাখতে হয়– তেমনই আবশ্যিক বায়ু সংস্কার, এবং সেই কাজ শুধু শীতে নয়– সারা বছর, প্রতিদিন।

…………………….

রোববার.ইন-এ পড়ুন সুপ্রতিম কর্মকার-এর লেখা

…………………….