
পাহাড়-প্রীতির কারণেই হয়তো কখনও প্লেনে কাঠমাণ্ডু যাওয়ার পথে ককপিটে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা মাকালু এভারেস্ট গৌরীশংকর ধবলগিরি আর আরও অনেক চেনা-অচেনা পাহাড়চূড়া হিমালয়ের প্রায় অন্দরমহল থেকে দেখে এসেছিলেন সত্যজিৎ রায় নিজে। আর সেই দৃশ্য তোপ্সের চোখ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন ফেলুদার গল্পের পাঠকদের। পাহাড়-প্রমাণ ব্যক্তিত্ব আর প্রতিভাসম্পন্ন মানুষটির পর্বত-প্রীতির এর থেকে বড় নমুনা বোধহয় আর পাওয়া যাবে না।
‘সে আপনার নীলগিরি বিন্ধ্য আরাবল্লী ওয়েস্টার্ন ঘাট্স– যাই বলুন না কেন, পাহাড়ের মাথায় যদি বরফ না থাকে তাকে আমি পাহাড়ই বলব না’– বলেছিলেন প্রখ্যাত রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে ‘জটায়ু’। ফেলুদার কাঠমাণ্ডুর অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির তখন প্রথম পরিচ্ছেদও পার হয়নি, থ্রি-মাস্কেটিয়ার্সের নিজেদের মধ্যে জল্পনা চলছে কোথাও একটা বেড়াতে যাওয়ার। তার ঠিক আগের বছর পুজোয় ফেলুদার যে উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে, তার অকুস্থল পুরীতে হলেও সেই মামলার বিভিন্ন সূত্রের বা চরিত্রের সঙ্গে নেপালের ব্যাপারটা এমনভাবে জড়িয়ে থেকেছে যে, তোপ্সে তো একবার বলেই ফেলল ‘নেপালটা কীরকম বারবার এসে পড়ছে, তাই না?’ আর ১৯৭৯ সালে সেই গল্প লেখার ঠিক এক বছরের মাথায় সত্যজিৎ রায় যখন আবার পুজো-সংখ্যার জন্য ফেলুদার নতুন উপন্যাস লিখলেন, সেই গল্পের অকুস্থল ধার্য হল খোদ কাঠমাণ্ডু শহরে।

একটা কথা হয়তো সকলেই মেনে নেবেন যে, সত্যজিৎ রায় বেড়াতে বা সিনেমা তুলতে যেখানে গিয়েছেন, পরে কখনও সেসব জায়গায় ফেলুদাকেও নিয়ে গিয়েছেন। এর মধ্যে জয়সলমীরের মরুভূমি, কাশী বা পুরীর মতো স্থান-মাহাত্ম্যওয়ালা জায়গা, হংকং বা লন্ডন, ইলোরার গুহা, লখনউ বোম্বাই আর শহর কলকাতা থাকলেও পাহাড়ের প্রতি তাঁর আকর্ষণটা যেন একটু বেশি ছিল বলে মনে হয়। ফেলুদার শুরুটাই পাহাড় থেকে। আর সেই পাহাড় বাঙালির নিজস্ব হিল স্টেশন দার্জিলিং ছাড়া কী বা হতে পারে!

সেবার দার্জিলিঙে কাঞ্চনজঙ্ঘা প্রথমটা দেখা যায়নি। কিন্তু যেদিন দিনটা একটু পরিষ্কার পাওয়া গেল, ঘুম থেকে উঠেই ফেলুদা হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল। গোয়েন্দাগিরির পরিসরে দার্জিলিং শহর, সেখানকার হোটেল, ম্যাল, কিউরিও দোকান, চড়াই-উতরাই থাকলেও কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সেভাবে দেখানোর সুযোগ সেই গল্পে হয়ে ওঠেনি লেখকের। হয়তো সেই জন্যই ২১ বছর পর ফেলুদা তোপ্সে জটায়ুকে আবার দার্জিলিং নিয়ে গেলেন সত্যজিৎ রায়। আর সেবার ফেলুদাকে দিয়ে বলালেন প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখার অনুভূতির কথা আর জটায়ুর চোখ দিয়ে পাঠক কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখল।

কাঞ্চনজঙ্ঘা যে সত্যজিৎ-এর একটি প্রিয় এবং পছন্দের বিষয়ে সে কথা শুধু তাঁর নির্মাণ করা বিখ্যাত ছায়াছবি দিয়ে নয়, জানা যায় স্মৃতিচারণ থেকেও। পিতামহ উপেন্দ্রকশোরের আঁকা কাঞ্চনজঙ্ঘার একটি ছবিও হয়তো কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রতি সত্যজিৎ-এর আকর্ষণের একটি কারণ। আর ‘অয়ি কাঞ্চনজঙ্ঘে’ দিয়ে শুরু সেই ‘গ্রেট পোয়েম’খানা যে বৈকুণ্ঠ মল্লিকের বকলমে তিনিই লিখেছিলেন, তাও তো জানা কথা। সেই পদ্যে না হয় ‘কাঞ্চনজঙ্ঘে’র সঙ্গে ‘উত্তরবঙ্গে’ বা ‘প্রভাতে’র সঙ্গে ‘তাতে’র অন্ত্যমিল দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু মজা তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ, কিন্তু ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে গুপি আর বাঘার হিমালয় দর্শনের সময়েয় দুর্লঙ্ঘ দুর্জয় হিমালয়, গর্বিত বীর, চির তুষারমণ্ডিত শির, অতি ধীর, গুরুগম্ভীর আখ্যা দিয়ে যে গানখানি লিখলেন তাকে তো বৈকুণ্ঠ মল্লিকের পদ্যের মতো ছেলেখেলা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

শুধু দার্জিলিং নয়, সিকিমের গ্যাংটক থেকে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘার কথাও পাওয়া গিয়েছে ফেলুদার গল্পে। এক সকালে রোদে ঝলমল কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখে তোপ্সের মনে হয়েছিল ‘দার্জিলিঙের মতো হয়তো অত সুন্দরও না, কিন্তু তাহলেও চেনা যায়, তাহলেও কাঞ্চনজঙ্ঘা’।
জটায়ুকে দিয়ে যতই সত্যজিৎ বলান, পাহাড়ের মাথায় বরফ না থাকলে তাকে তিনি পাহাড় মনে করবেন না, প্রফেসর শঙ্কুকে কিন্তু একেবারে গোড়ার দিকের এক গল্পে তিনি নিয়ে ফেলেছিলেন নীলগিরি পাহাড়ের এক প্রত্যন্ত এবং দুর্গম অঞ্চলে। অবশ্য সেই গল্পে বিপদ-সংকুল আরণ্যক আবহের যতখানি প্রয়োজন ছিল, পাহাড়ের দরকার ততটা ছিল না।

শঙ্কু-কাহিনিতে পাহাড় সবচেয়ে বিশদে এবং সবরকম প্রতিকূলতা নিয়ে দেখানো হয়েছে ‘একশৃঙ্গ অভিযান’ কাহিনিতে। তিব্বতের লোমশ কুকুর, খরস্রোতা নদী, মাইলের পর মাইল বিস্তৃত ঊষর মরুভূমির মতো রুক্ষ জমি, বরফ ঢাকা পাহাড়, খাম্পা ডাকাত, চমরি গাই, শক্ত মাখনের ডেলা, বৌদ্ধ মঠ, হাড়ের বাঁশি, মৌনি লামা, জপ যন্ত্র, ওঁ মণিপদ্মে হুম প্রভৃতি নিয়ে হিমালয়ের উত্তর দিকের দুর্গম মালভূমি এই কাহিনিতে পাঠককে মনে মনে পৌঁছে দেয় কাহিনির অকুস্থলে। সেখানকার নিখুঁত বর্ণনায় কাহিনির অনুষঙ্গে চলে আসা থেকে এখানে দুর্জয় শীত হলেও দুপুরের দিকে তাপমাত্রা চড়ে গিয়ে কখনও আশি-নব্বই ডিগ্রি ফারেনহাইটে পৌঁছে যাওয়ার ব্যাপার বা মেঘদূতে মানস সরোবরের রাজহাঁসের উল্লেখ থাকলেও প্রোফেসর শঙ্কুর ওখানে বুনো হাঁস ছাড়া আর অন্য কিছু দেখতে না পাওয়া কিংবা মানস সরোবরের খানিক আগে সামনে মাথা তুলে থাকা গুর্লা মান্ধাতা শিখরের বিবরণ ইত্যাদি প্রমাণ করে তিব্বত সম্পর্কে কত পড়াশোনা এই কাহিনির লেখককে করতে হয়েছিল।

ফেলুদাদের লন্ডন যাত্রার সময় তোপ্সে লিখেছিল বরফে ঢাকা আল্পস পর্বতমালার উপর দিয়ে উড়ে না গেলে নাকি বিমানযাত্রায় সারা পথে কিছুই দেখার থাকত না। প্লেন থেকে পাহাড় দেখার ঘটনা সত্যজিৎ আগেও লিখেছেন ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চারে। কিন্তু তার থেকেও বেশি গুরুত্বের ব্যাপার হল প্রোফেসর শঙ্কুকে কিন্তু বহুবার দেখা গিয়েছে ইউরোপে আল্পসের আনাচে-কানাচে অবস্থিত বহু শহরে নানা অভিযানে শামিল হতে। বিজ্ঞান আর অ্যাডভেঞ্চার মেশানো সেই অভিযানগুলির সময়ও কিন্তু পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শঙ্কুর দৃষ্টি এড়ায়নি।
সুইডেন ও নরওয়ের সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত সুলিটেলমা শহরটির একটি অংশের অবস্থান সুইডেনে। অন্য অংশ নরওয়েতে, যেখানে শঙ্কু গিয়েছিলেন ‘আশ্চর্য পুতুল’ সংক্রান্ত অভিযানে। সেখানে ভয়ংকর বিপদের মধ্যেও বিখ্যাত সুলিটেলমা শৃঙ্গের কথা শঙ্কু ডায়েরিতে লিখে রাখতে ভোলেননি। আবার ‘আশ্চর্য প্রাণী’ গল্পে সুইজারল্যান্ডের সেন্ট গ্যালেন শহরে গিয়ে একটি কঠিন এক্সপেরিমেন্ট আর সঙ্গে সহযোগী বৈজ্ঞানিকের মাৎসর্য সামলাতে হয়েছিল শঙ্কুকে। আল্পস পাহাড়ের ২৫০০ ফুট উচ্চতার শহরটিতে রাস্তায় বরফ পড়ে থাকা, বার্চ গাছের বনের সৌন্দর্য, সেখান থেকে কনস্ট্যান্স লেকের দৃশ্য প্রভৃতি ডায়রিতে শঙ্কু লিখেছিলেন। একইরকম ব্যাপার ঘটেছে ‘রোবু’র অভিযানে হাইডেলবার্গ বা ‘ডক্টর শেরিং-এর স্মরণশক্তি’ কাহিনিতে সুইজারল্যান্ডের জ্যুরিখ থেকে কিছু দূরে ছোট্ট শহর ওয়ালেনস্টাটে। শেষোক্ত অভিযানে এক পাহাড়ি রাস্তা থেকে প্রায় সাড়ে ৩০০ ফুট নীচের খাদে সরু নদী, সুইস গরুর গলায় বাঁধা ঘণ্টার দূরাগত শব্দ আর ঝাউ বিচ বা অ্যাশ গাছের ডাল থেকে বরফ খসে পড়ার ঝুপ-ঝুপ আওয়াজের এক অদ্ভুত বিবরণ শঙ্কুকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ডক্টর শেরিং-এর কাহিনি রচনার বছরখানেক বা বছর-দুই আগে লেখা ‘বাক্স-রহস্য’তেও খুব কাছ থেকে গাছের ডাল থেকে বরফ পড়ার শব্দের রোমাঞ্চ সত্যজিৎ যেমন পাঠকদের অনুভব করিয়েছিলেন, তেমন ওই শব্দ নিয়ে কৌতুক সৃষ্টি করতেও ছাড়েননি। ‘বাক্স-রহস্য’র বরফাবৃত অকুস্থল ফেব্রুয়ারির সিমলা শহর এবং উপকণ্ঠ। সমগ্র কাহিনির দশটি অধ্যায়ের প্রথম সাতটির ঘটনাস্থল কলকাতা, দিল্লি এবং দিল্লি-কালকা পথে রাতের ট্রেন। শেষ তিনটির সিমলা। কিন্তু সেইটুকু অংশের সিমলা শহরটিকে সত্যজিৎ এমনভাবে দেখালেন যে ‘বাক্স-রহস্য’ আর সিমলা প্রায় সমার্থক হয়ে উঠল।

রাজা চোগিয়ালের আমন্ত্রণে সিকিমের উপর তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। হিমালয়ের কোলে অবস্থিত রাষ্ট্রটির সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় সেই সময়ে। আর তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’ উপন্যাসে। সেই কাহিনিতে গোয়েন্দা ফেলু মিত্তির তার বুদ্ধিমত্তার তারাবাজি যেমনই দেখাক, ধূর্ত শশধর বোস, মজাদার নিশিকান্ত সরকার, জার্মান হেলমুট উঙ্গার, রহস্যময় ডক্টর বৈদ্য প্রভৃতিকে ছাপিয়ে গিয়ে সিকিমের পাহাড়ি সৌন্দর্য যেন কাহিনির এক বিশেষ চরিত্র হয়ে গিয়েছিল। শশধর বোসের ‘ছোটখাট লেকচারে’ সিকিমের বৈশিষ্ট্য, গ্যাংটক শহরের রাস্তাঘাট, জিপ, টিবেটান ইনস্টিটিউট, রুমটেকে লামাদের নাচ আর পেমিয়াংচির না-দেখা সৌন্দর্য রহস্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক অন্য জগতে, হয়তো সিকিমেই, পৌঁছে দিয়েছিল পাঠককে। ফেলুদার জিপ যখন বাগডোগরা থেকে পাঁচ ঘণ্টার পথ পার হয়ে গ্যাংটকে পৌঁছল, সেই বর্ণনার মিলিটারি ক্যাম্প, ফুলের টব সাজানো কাঠের বারান্দাওয়ালা দোতলা বাড়ি, রঙিন ডোরাকাটা পোশাক পরা কাঁধে বাচ্চা নেওয়া পাহাড়ি মেয়ে, বাহারের টুপি আর রংবেরঙের জামা পরা সিকিমি নেপালি ভুটিয়া তিব্বতি পুরুষ প্রভৃতি পাঠককে বাধ্য করে তার স্মৃতি থেকে কোনও হিল স্টেশনে পৌঁছনোর দৃশ্য ফিরিয়ে নিয়ে এসে নতুনভাবে মুগ্ধ হতে।

এই উপন্যাসেই নর্থ সিকিম হাইওয়ের কাছ থেকে নীচের পাহাড়ের ঢালে ফসলের খেত কিংবা শহরের পূর্বদিকে বহুদূরে বয়ে যাওয়া নদী, মাল নিয়ে যাওয়ার রোপওয়ে প্রভৃতির বর্ণনা বুঝিয়ে দেয় সত্যজিৎ-এর মনে পাহাড়ি সৌন্দর্য কতখানি প্রভাব ফেলেছিল।
ফেলুদার গল্প-উপন্যাসের রচনাকালের যেমন হিসেব সন্দীপ রায় দিয়েছেন, তার ভিত্তিতে যদি বলা হয় ১৯৮৩ থেকে ’৮৭ ফেলুদাকে ‘পাহাড়ে পেয়েছিল’, তাহলে হয়তো খুব ভুল হবে না। ওই সময়ে বছরে একটি করে ফেলু-কাহিনি লিখেছিলেন সত্যজিৎ। চুরাশিতে লেখেননি। তিরাশিতে ‘এবার কাণ্ড কেদারনাথে’, ছিয়াশিতে ‘দার্জিলিং জমজমাট’, সাতাশিতে ‘ভূস্বর্গ ভয়ংকর’। ফেলুদার গল্পের রীতি অনুসারে রহস্য রোমাঞ্চ গোয়েন্দাগিরির সঙ্গে মন্দাকিনী নদী, পাহাড় ভেদ করে চলে যাওয়া বন কেটে তৈরি রাস্তা, গাছপালা সরে গিয়ে সবুজ পাহাড়, ছবির মতো গ্রাম কিংবা বৈকুণ্ঠ মল্লিকের বকলমে ছড়া কেটে কেদার যাত্রার বর্ণনা, দেও-দেখ্নি, গান্ধী সরোবরের ভয়ংকর-সুন্দর পথ, পাহাড় থেকে আসা সূর্যের প্রথম আলোয় বরফের রং লাগা; কিংবা দার্জিলিঙের শিশির কুয়াশা ঝাউবন কাঞ্চনজঙ্ঘা কেভেন্টার্স রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে ম্যালের ভিড়; আর কাশ্মীরের ভয়ংকর পরিবেশে ডাল লেক গুলমার্গ খিলেনমার্গ আর পহেলগামের সৌন্দর্য এসে এক ঝলক আরামের ছোঁয়া পৌঁছে দেয় গোয়েন্দা কাহিনির পাঠকের মনে। কখনও ফিরিয়ে নিয়ে আসে অতীতের ভ্রমণ-স্মৃতি।

সত্যজিৎ-এর কলমে দার্জিলিং ফিরে এসেছিল ‘বাতিকবাবু’ গল্পে। সেখানকার পাকদণ্ডী পথ, কুয়াশা, পথের পাশের গাছ, খাদের পাশের বাড়িঘর আর অন্য অনেক বৈশিষ্ট্য গল্পকে আমোদিত করেছিল। তারিণীখুড়োর মার্তণ্ডপুর ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলার গল্পে উত্তরপ্রদেশের উত্তরদিকে তিন হাজার ফুট এলিভেশনে যে ক্রিকেট খেলার মাঠের কথা বলা হয়েছিল, তার বর্ণনায় মাঠটিকে যে কোনও ক্রীড়ামোদী চিনে ফেলবে হিমাচল প্রদেশে অবস্থিত চেইল-এর মাঠের কাল্পনিক চেহারা হিসেবে। পাহাড়, বিশেষ করে হিমালয়ের তুষারাবৃত শৃঙ্গগুলি সত্যজিৎকে আকর্ষণ করেছে বরাবর। না হলে, কেন প্লেনে কলকাতা থেকে দিল্লি আসার সময়ে অন্নপূর্ণা শৃঙ্গ তোপ্সের চোখে পড়বে, কেনই বা অত জায়গা থাকতে কাঠমাণ্ডুর ৮০ কিলোমিটার আগে সাড়ে সাত হাজার ফুট হাইটের দামন ভিউ টাওয়ার লজের ছাদে, যেখানে হিমালয়ের যত বিখ্যাত চূড়া তাদের ঘিরে রেখেছে, সেখানে বসে রহস্যের জট ছাড়াবে ফেলুদা; কীভাবেই বা ফেলুদা হরিদ্বার ঋষিকেশ আর লছমনঝুলা এই তিন জায়গায় গঙ্গার তিন রকম চেহারার ব্যাপারটা বোঝাবে তপেশকে!

এই পাহাড়-প্রীতির কারণেই হয়তো কখনও প্লেনে কাঠমাণ্ডু যাওয়ার পথে ককপিটে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা মাকালু এভারেস্ট গৌরীশংকর ধবলগিরি আর আরও অনেক চেনা-অচেনা পাহাড়চূড়া হিমালয়ের প্রায় অন্দরমহল থেকে দেখে এসেছিলেন সত্যজিৎ রায় নিজে। আর সেই দৃশ্য তোপ্সের চোখ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন ফেলুদার গল্পের পাঠকদের।
পাহাড়-প্রমাণ ব্যক্তিত্ব আর প্রতিভাসম্পন্ন মানুষটির পর্বত-প্রীতির এর থেকে বড় নমুনা বোধহয় আর পাওয়া যাবে না।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved