Robbar

গানের ভিতর ক্রিকেট, ক্রিকেটের ভিতর গান

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 8, 2025 5:21 pm
  • Updated:December 8, 2025 5:21 pm  

ক্রিকেটের কাছে ফেরা মানে ফিরে আসা রাণাঘাটের সেই ছেলেটির কাছেই। যে চেতন চৌহানের চোখ দিয়ে দেখে ফেলবে গাভাসকরের একের পর এক সেঞ্চুরি। নন-স্ট্রাইকিং এন্ড থেকে আমাদের চিনিয়ে দেবে বসন্ত কাল। কানে কানে বলবে, খেলোয়াড়ের অবসর হলেও, কীভাবে টিকে থাকে দর্শক– তার অবসর নেই, উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রথম লাইনের মতো ফিরে ফিরে আসে। বারে বারে মাঠের পাশে বসে থাকা আর ব্যাট না পেয়ে ফিরে আসার মাঝখানে যে সন্ধে হয়ে যাওয়া, যেখানে ক্রমশ ফিকে হয় মারোয়া রাগ, বিলম্বিত থেকে দ্রুত লয়ে, সেখানেই আসলে ক্রিকেট ভেসে ওঠে, অনেকদিন আগে পানাপুকুরে ডুবে যাওয়া ক্যাম্বিস বলের মতো।

অর্পণ গুপ্ত

নবাঙ্কুর ক্রিকেট ক্লাব। রাণাঘাট। রোগা-পাতলা ছেলে। হাতে ব্যাট। যেন আস্ত পৃথিবী চ্যাপ্টা হয়ে ঢুকে পড়েছে। কাঠগুড়ো-ফেভিকল। ঢলঢলে ব্লেড-হাতলের ওপর তেকোণা স্টিকার। ভারী। ক্রিকেট খেলতে চেয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে সে। আকাশের ওপর কালো পাখির ঝাঁক। যেন রেনকভারের মতো ঢেকে দিচ্ছে আস্ত একটা বিকেল। যারা ব্যাট পায়নি কোনওদিন, তাদেরই দলে ও। আমাদের মতোই। অথচ ওর সারা শরীরে চিনা ঘাস। সদ্য ক্যাচ নিয়ে ওঠা ফিল্ডার যেন। যার ক্রিকেট খেলা হয় না, ক্রিকেট তাকেই যেন গিলে খায় সবচেয়ে বেশি। আর এই ব্রাহ্মমুহূর্তে ক্রিকেট আর খেলা হয়ে থাকে না কিছুতেই। ইচ্ছে হয়ে যায়। মিডব্যাটের ওপর বলের ছোঁয়া নিতে চাওয়ার ইচ্ছে। অনেকদিন পর বাথরুম সিঙ্গারের আচমকা গুনগুনে একটা ঠিকঠাক সুর লাগিয়ে ফেলার ইচ্ছে। এককালে যে ক্যাচটা অনেকটা দৌড়ে ফ্লাইট জাজ করে ফেলা যেত তাকে ফের ধাওয়া করার ইচ্ছে।

মিডব্যাটের ওপর বলের ছোঁয়া নিতে চাওয়ার ইচ্ছে

এমন ইচ্ছের প্রকারভেদ আছে বটে। যেমন এক প্রকার ইচ্ছের নাম জুবিন গর্গ। যে-সব ইচ্ছেরা স্টেজে উঠে পড়ে স্বপ্নে– তারপর ভাবে, কৈশোরের কোনও একটা চুন্নি করে দেওয়া স্টাম্পার বলের মতোই সে ধুলো ধুলো করে দেবে আজও। ব্যাট হাতে বনবন করে ঘোরায় গ্রিপ। পাক্কা ব্যাটারের মতো। মাইক্রোফোন স্ট্যান্ড থেকে হাতে তুলে নেয়। পারে না। দম আটকে আসে। গলা কেঁপে যায়। আউট অফ টাচ ব্যাটার– নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে চেষ্টা করে একটা বল ছুঁতে, একটা সুর ছুঁতে। খাবি খায়। চোখে জল এলে মনে হয় জ্বলছে তার চোখদুটো। চ্যাপলিনের বৃষ্টির ভেতর কান্না মনে পড়ে। সঞ্চারী থেকে স্থায়ীর সুরে ফিরতে গিয়েও ফিরতে পারে না কিছুতেই।

ইচ্ছের নাম জুবিন গর্গ

আবার এমন একটা ইচ্ছের নাম ধরা যাক, আন্দ্রে রাসেল। ট্যারেন্টিনোর ছবির চরিত্রদের মতোই রঙিন। বব ডিলানের গানের মতো বেপরোয়া। ফার্স্ট ক্লাস খেলার বদলে যে কেবলই খেলতে চায় টি-টোয়েন্টি। তিনটে ফার্স্ট ক্লাস খেলে কাটিয়ে দেবে আস্ত জীবন। মাঠে নামার আগেই গুস্তাখি মাফ। একদিন এই ইচ্ছে সফলও হবে দিব্বি। অন্য নামে,অন্য ঢঙে। এরিক ক্ল্যাপটনের গিটার স্ট্রিং-এর ওপর আঙুল চালানোর মতো ইচ্ছে নিয়ে সে দেদার ব্যাট ঘোরাবে। নিয়মকে থোড়াই কেয়ার। নিয়ম ভাঙতে ভাঙতে একটা নিয়ম গড়ে নেবে অজান্তেই। যেমন মজার ছলে গাইতে গাইতে দেশ রাগের ছোঁয়া পেয়ে যায় চন্দ্রবিন্দুর ‘গীত গোবিন্দম’!

ইচ্ছে আসলে বড্ড রঙিন, ঠিক যেন আন্দ্রে রাসেল

ক্রিকেট যে কেবল ইচ্ছে নয়, অসহ্য অভ্যেস, তা প্রথম বুঝিয়েছিলেন আমার তবলার গুরু। পণ্ডিত কুমার বোসের বাড়ি যাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল এককালে। গুরুজির কাছে গল্প শুনেছেন, বেনারস ঘরের তবলা রেওয়াজের গল্প, হাতের কড়া দিয়ে বিচার হত তিন তালের ঠেকার মাধুর্য। ঠিকঠাক একটা ‘তে টে’ পড়লে যেন ঘোড়ার ক্ষুরের মতো কানে লাগে! পড়ন্ত বেলার বিরাট কোহলিকে এমন এক জানলা সারাইয়ের মিস্ত্রি মনে হয় আজকাল। আলো নিয়ে আসার জন্য লোকটা ছুটছে, ইচ্ছে হাওয়ায় অনিচ্ছের ব্যাট উঁচিয়ে মাঝে মধ্যে এক আধটা সেঞ্চুরির জানানও দিচ্ছে। কিন্তু মায়া নেই, কায়া নেই, ছায়া নেই; ‘নাহি ক্ষয় নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্য লেশ’-এর মাঝামাঝি জায়গায় জর্জ বিশ্বাসের ভিজে যাওয়া গলার কাছে বিরাট কোহলির ফেলে আসা কেরিয়ার। যেখান থেকে থমকে আছে সবকিছু। এক অনাবিল শূন্যতায় হাত-পা নেড়ে চলেছে সবাই।

ইচ্ছা হাওয়ায় ব্যাট হাতে স্বপ্ন গড়েন বিরাট কোহলি

জেমিমা রডরিগেজ গান করেন। গিটার বাজিয়ে। আবার সুনীল গাভাসকরকে প্রস্তাব দেন ডুয়েটের। কৈশোরে দেখেছি বীরেন্দ্র শেহবাগকে। ছোট কাগজে তরুণ কবির প্রথম কবিতা, হেলমেটের ভিতর ভরে আনেন কিছু বিস্ফোরক আর কিছুটা কিশোরকুমার; কামরান আকমলের সামনে গুনগুন করেন, ‘চলা যাতা হু, কিসি কি ধুন মে’-এর সুর। যেমনটা করতেন ব্রেট লি-ও। এসব গানের ভিতর ক্রিকেট। আবার ক্রিকেটের ভিতর গানও আছে পুরো দস্তুর।

ব্যাট যেন জেমিমার ইচ্ছে-গিটার

২০০৩। বিশ্বকাপ চলছে। শচীন কাঠের বল সুতোয় ঝুলিয়ে ব্যাটের একই জায়গা দিয়ে আলাদা আলাদা দূরত্বে থাকা অবস্থায় বলটাকে মারছেন। ক্রীড়া সাংবাদিকরা জানালেন, শচীন মগজে ভরে নিচ্ছেন লয়টা, তালটা। বোলারের গতির তারতম্য এলেও যাতে মগজের রিফ্লেক্স চলে আসে পেশিতে। শচীন নিশ্চিত চেনেন না কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। জেমিমা রডরিগেজ নিশ্চিত দেখেননি ‘দিশি গান বিলিতি খেলা’ বইয়ের প্রচ্ছদ। প্যাড-গ্লাভস পরিহিত ব্যাটারের হাতে তানপুরা।

ক্রিকেটের কাছে ফেরা মানে ফিরে আসা রাণাঘাটের সেই ছেলেটির কাছেই। যে চেতন চৌহানের চোখ দিয়ে দেখে ফেলবে গাভাসকরের একের পর এক সেঞ্চুরি। নন-স্ট্রাইকিং এন্ড থেকে আমাদের চিনিয়ে দেবে বসন্ত কাল। কানে কানে বলবে, খেলোয়াড়ের অবসর হলেও, কীভাবে টিকে থাকে দর্শক– তার অবসর নেই, উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রথম লাইনের মতো ফিরে ফিরে আসে। বারে বারে মাঠের পাশে বসে থাকা আর ব্যাট না পেয়ে ফিরে আসার মাঝখানে যে সন্ধে হয়ে যাওয়া, যেখানে ক্রমশ ফিকে হয় মারোয়া রাগ, বিলম্বিত থেকে দ্রুত লয়ে, সেখানেই আসলে ক্রিকেট ভেসে ওঠে, অনেকদিন আগে পানাপুকুরে ডুবে যাওয়া ক্যাম্বিস বলের মতো।

ক্রিকেট তখন খেলা নয়। ইচ্ছে নয়। অভ্যাস নয়। প্রবল বিক্ষোভে ফিরে আসা সুমনের গানও নয়। সন্ধেবেলা, মায়ের আপনমনে গুনগুন করতে থাকা– ‘আমার যা আছে আমি সকল দিতে পারিনি তোমারে নাথ…’-এর মতো এক বিপন্নতা।

…………………………

রোববার.ইন-এ পড়ুন অর্পণ গুপ্ত-র অন্যান্য লেখা

…………………………