
মেসিকে ঘিরে এই শহরে বিশ্রী রকমের বিশৃঙ্খলা ঘটে গেল। ফুটবল পাগল পশ্চিমবঙ্গ হয়তো উন্মাদনা দমিয়ে রাখতে পারেনি। কলকাতার আর্জেন্টিনা উন্মাদনার সামাজিক মনস্তত্ত্ব আসলে এক সামষ্টিক পরিচয়ের আকাঙ্ক্ষা। দূরের এক দেশের ফুটবলকে ঘিরে বাঙালি এমন এক অনুভূতির জগৎ তৈরি করেছে, যেখানে অচেনা মানুষও এক পতাকার রঙে হঠাৎই আপন হয়ে ওঠে। মারাদোনার বিক্ষুব্ধ প্রতিভা হোক বা মেসির নীরব সংগ্রাম, বাঙালি তাদের গল্পে নিজেরই জীবনযুদ্ধের ছায়া দেখতে পায়।
নীল-সাদা রঙের সঙ্গে বাঙালি দু’ভাবে অভ্যস্ত। প্রথমটা পশ্চিম বাংলার প্রশাসনিক দফতর চেনার আদর্শ উপায় আর দ্বিতীয়টা ফুটবল স্বর্গরাজ্যের জাতীয় পতাকার জন্য! যদিও ২০১১ সালের আগে পর্যন্ত বাংলায় নীল-সাদা রং বললেই বলা হত, আর্জেন্টিনার সমর্থক। কারণ নীল-সাদা রং মানেই ছিল সেই স্বপ্নের দেশ। যে দেশের সঙ্গে বাঙালির সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই, যোগাযোগ নেই তবুও বাঙালি মনে মনে ওই দেশে একটা বসতি গড়ে তুলেছে। যে বসতি শুধুমাত্র নীল সাদা রঙের জন্য কত রাত জান কবুল করেছে। কত রাত দুরুদুরু বুকে প্রার্থনা করেছে একটা গোলের জন্য। যে দেশ বাঙালিকে বারেবারে উদ্বুদ্ধ করেছে। পায়ের ভেলকি নিয়ে এগিয়ে যেতে বলেছে বহুদূর। উদাসী দুপুরে একলা বালক খোলা ছাদে একা একাই একটা মায়াজালে বল জড়িয়েছে। ‘হ্যান্ডস অফ গড’ থেকে ‘গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম’-এর তকমা ওই দেশের ফুটবল ভগবানেররা পেয়ে এসেছেন। সেই দেশের সঙ্গে এই শহরের কি নাড়ির টান? নীল-সাদা রং বাঙালির মণিকোঠায় বারবার কি জাদুবাস্তবতার জন্ম দিয়েছে? যে দেশের সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব প্রায় ১৬,৫৩০ কিলোমিটার, সেই কলকাতা তো প্রতিদিন একটু একটু করে আর্জেন্টিনা হয়ে ওঠার চেষ্টা করে।

শুক্রবার মধ্যরাতে কলকাতা শহরে পা রেখেছেন মেসি। খাতায় কলমে শনিবার। সে যাই হোক, এই রাতের উন্মাদনা কোনও নববর্ষের চেয়ে কম নয়। এ যেন অসংখ্য নক্ষত্রের রাত। গভীর হাওয়ার রাত। এই রাত যেন শেষ না হয়। এই রাত নেশাতুর করে দিক সিটি অফ জয়কে। বিশ্বকাপ জয়ের পর প্রথম শহরে পা রেখেছেন ফুটবল-ভগবান। তাও সর্বসাকুল্যে সাড়ে ১২ ঘণ্টার জন্য। শহরের সব রাস্তাই যেন মেসিমুখী ছিল। ১১ বছর পর শহরে পা রাখছেন তিনি। গত ১৪ বছরে এই শহর আমূল বদলে গিয়েছে। সাবালক সিটি অফ জয়, এখন পরিণত হয়েছে। শুধু একটা ব্যাপারই এক রয়ে গিয়েছে। নীল-সাদা রঙের প্রতি বাঙালির পাহাড় সমান আবেগ। এখনও মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলা হলে অনেকেই তো নীল-সাদা জার্সি পরে উদযাপন করে। মেসির ছবি নিয়ে লাফালাফি করে। দেওয়ালে, কার্নিশে, বাড়ির ছাদে আর্জেন্টিনার পতাকা, মেসির ছবি, মারাদোনার ছবি নিয়ে এই কলকাতা উন্মাদ হয়ে যায়। বাজি ফাটানো হয়। মিষ্টি বিলি হয়। আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় শহরটা। কলকাতায় উন্মাদনার চিত্রটা অনেকটা এইরকম।

সল্টলেক স্টেডিয়ামের অদূরে, একটি হাউজিং কমপ্লেক্সে তৈরি করা হয়েছে ‘হোলা মেসি ফ্যান জোন’। সেখানে শুরুতেই মায়ামির বাড়ির আদলে মেসির বাড়ির প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছে। সেই বারান্দায় বসে রয়েছেন মেসি, তাঁর স্ত্রী আন্তোনেয়া রোকুজো এবং তিন ছেলে মাতেয়ো, থিয়াগো এবং সিরো। শুধু তাই নয়, মাঝের জায়গাটি সাজানো হয়েছে ৮৯৬টি ফুটবল দিয়ে। ফুটবল জীবনে এখনও পর্যন্ত এতগুলো গোল করেছেন মেসি। দেওয়ালে থাকছে ২০০ মিটার লম্বা এলইডি স্ক্রিন, যেখানে মেসির ফুটবল খেলার বিভিন্ন দৃশ্য দেখানো হবে। এটা কি উন্মাদনার চেয়ে কম কিছু?

এই শহরেই বসেছে মেসির বিরাট মূর্তি, লেকটাউনের যে অংশে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিগ বেন, সেখানেই এবার থেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে ফুটবল রাজপুত্রের মূর্তিকে। এর উচ্চতা ৭০ ফুট। এখানেই ইতিমধ্যে রয়েছে মারাদনার একটি স্ট্যাচু। কী প্রয়োজন এইসবের? মারাদোনা কি জানত কলকাতা নামে একটা শহরে তার মূর্তি রয়েছে? মেসিও কি কোনও দিন অবসরে ভাববে এই শহরে কেন তার এত বিরাট মূর্তি বসল? যে দেশটা ফুটবল বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি এখনও পর্যন্ত, সেখানে মেসির মূর্তি কি আদতে বিলাসিতা? নাকি ফুটবল প্রেমের চিহ্ন? নাকি কলকাতা ভিতরে এক টুকরো আর্জেন্টিনা খুঁজে নেওয়ার প্রয়াস?

কলকাতার আর্জেন্টিনাপ্রীতি আসলে কোনও আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের ওপর দাঁড়িয়ে নয়, দাঁড়িয়ে আছে স্মৃতি, আবেগ ও উত্তরাধিকারের ওপর। প্রতি বিশ্বকাপেই দেখা যায়, ছাদের কার্নিশে উঠেছে নীল-সাদা পতাকা, ঘরের দেওয়ালে টাঙানো মারাদোনা বা মেসির পোস্টার। এ কাজটা নিছক সমর্থনের প্রকাশ নয়। বরং পরিবার থেকে পরিবারে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা এক ধারাবাহিক পরিচয়ের চর্চা। বাঙালি যেমন নিজের সাহিত্য-ঐতিহ্যকে আপন করে নেয়, যেমন দাদুর মুখে শোনা গল্পকে নিজের ইতিহাস বানিয়ে ফেলে, তেমনই আর্জেন্টিনাকে সে নিজের স্মৃতির ঘরে জায়গা দিয়েছে।

মারাদোনা এই শহরে কেবল এক ফুটবল কিংবদন্তি নন, তিনি এক লোককথার নায়ক। যার জীবনের উত্থান-পতন, অসম্ভব প্রতিভা, বিদ্রোহী মেজাজ বাঙালিকে বারবার নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে সাহায্য করেছে। অন্যদিকে মেসি একেবারে ভিন্ন চরিত্র। চুপচাপ, সংগ্ৰামী, পরিশ্রমী, ব্যক্তিগত সংগ্রাম থেকে উঠে আসা। এই নীরব যোদ্ধার গল্পে বাঙালি খুঁজে পায় নিজের স্বপ্নের আশ্বাস, নিজের সুরক্ষাবোধের প্রতিরূপ। ফলে আর্জেন্টিনা এখানে কোনও দূরের দেশ নয়, এটা বাঙালির কল্পনার একটা অংশ, তার সাংস্কৃতিক আবেগের স্বাভাবিক সম্প্রসারণ। কলকাতা ঠিক কতটা আর্জেন্টিনা হয়ে উঠেছে, তা বোঝার জন্য শুধু উন্মাদনার মাপকাঠি যথেষ্ট নয়। বোঝা যায় শহরের সংস্কৃতি, বাজার, জনসমাজ ও প্রতিদিনের আচরণে কীভাবে নীল-সাদা রঙ ধীরে ধীরে মিশে গেছে। অনেক দোকানদারই বলেন, প্রতি চার বছর অন্তর তাঁদের ব্যবসার ৬০-৭০ শতাংশ ঘুরে দাঁড়ায় আর্জেন্টিনাকে কেন্দ্র করে, যা এই শহরের সমর্থনের গভীরতারই প্রমাণ। পরিসংখ্যান বলছে, সাধারণ সময়ে যেসব হোলসেলার ফুটবলসামগ্রী বিক্রি করে মাসে ২৫-৩০ লক্ষ টাকার মতো ব্যবসা করতেন, বিশ্বকাপের ঠিক আগের দুই মাসে তাঁদের টার্নওভার লাফিয়ে উঠে ৬০ লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে যায়। মেটিয়াবুরুজের এক হোলসেলারের হিসেব মতে, অক্টোবর-নভেম্বরে প্রায় ৩৬ লক্ষ টাকার আর্জেন্টিনা জার্সি বিক্রি হয়েছে।

অর্থনীতির এই ঢেউ শুধু রাস্তার দোকানে থেমে নেই। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মেও ফুটবল-সংশ্লিষ্ট সামগ্রীর বিক্রি বিশ্বকাপের সময়ে প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে। কিছু সাইটে প্রতিদিন তিন–চার হাজার ফুটবল আর তিন শতাধিক আর্জেন্টিনা থিমড কিট বিক্রি হয়, যার বড় অংশের ক্রেতা কলকাতা ও পূর্ব ভারতের ফুটবলপ্রেমীরা। শুধু জার্সি, বল নয় কাপ, ব্যাজ, পোস্টার, এমনকী, মেসি-মারাদোনার প্রিন্টেড মোবাইল কভারও ব্যাপক বিক্রি হয়। এই চাহিদা পুরোটাই তৈরি হয় শহরের সাংস্কৃতিক উন্মাদনা থেকে, যা সরাসরি টেনে নিয়ে যায় বাজারকে। ব্যবসার এই বিস্ফোরণ কেবল পণ্যের বিক্রিতেই সীমাবদ্ধ নয়। ফুটবল ইভেন্টও এখন বড় অঙ্কের অর্থ টানছে কলকাতায়। একবার মেসিকে ঘিরে হওয়া একটি ফ্রেন্ডলি ম্যাচের প্রায় ২০ কোটি টাকার সম্ভাব্য আয় প্রমাণ করে দেয় যে এই শহর আবেগের নামে কিন্তু এক বিশাল বাজার তৈরি করে ফেলেছে।
তা সত্ত্বেও মেসিকে ঘিরে এই শহরে বিশ্রী রকমের বিশৃঙ্খলা ঘটে গেল। ফুটবল পাগল পশ্চিমবঙ্গ হয়তো উন্মাদনা দমিয়ে রাখতে পারেনি। কলকাতার আর্জেন্টিনা উন্মাদনার সামাজিক মনস্তত্ত্ব আসলে এক সামষ্টিক পরিচয়ের আকাঙ্ক্ষা। দূরের এক দেশের ফুটবলকে ঘিরে বাঙালি এমন এক অনুভূতির জগৎ তৈরি করেছে, যেখানে অচেনা মানুষও এক পতাকার রঙে হঠাৎই আপন হয়ে ওঠে। মারাদোনার বিক্ষুব্ধ প্রতিভা হোক বা মেসির নীরব সংগ্রাম, বাঙালি তাদের গল্পে নিজেরই জীবনযুদ্ধের ছায়া দেখতে পায়। তাই তাদের জয় মানে শহরের হৃদয়ে আলো, আর পরাজয় মানে হাহাকার। নীল-সাদা পতাকা তোলা, জার্সি কেনা, রাস্তায় আনন্দে নেচে ওঠা এসব শুধুই উন্মাদনা নয়। এগুলো সমাজের ভিড়ে নিজের অস্তিত্ব ও অংশগ্রহণকে অনুভব করার মানসিক আচার। ব্যস্ততা, চাপ আর অনিশ্চয়তার শহুরে জীবনের মাঝেও আর্জেন্টিনার ফুটবল তাই হয়ে ওঠে এক আশ্রয়, যেখানে আবেগ মানুষকে সাময়িক হলেও আরও কাছে টেনে আনে।
কলকাতা আবেগের শহর। ফুটবল সব খেলার সেরা, তা বিশ্বাস করার শহর। মেসি আজ এসেছিলেন, মেসিকে তাঁর ভক্তরা কেউ দেখলেন, কেউ দেখতেই পেলেন না। উদ্যোক্তাদের ভুল, ম্যানেজমেন্টের ভুল, এইসমস্ত পেরিয়ে এই শহর বুকের মধ্যে মারাদোনার উত্তরাধিকার জাগিয়ে রেখেছে, মেসির বর্তমান বাঁচিয়ে রেখেছে। কলকাতা লন্ডন হওয়ার যতটা স্বপ্ন থেকে, আর্জেন্টিনা হওয়ার স্বপ্ন তার চেয়ে কম দেখে কি? কে জানে!
……………………
রোববার.ইন-এ পড়ুন আদিত্য ঘোষ-এর অন্যান্য লেখা
……………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved