
অ্যাবরিজিনাল অস্ট্রেলিয়ানদের শিল্পকর্ম যেমন রহস্যাবৃত এবং বিস্ময়ের, তেমনই আদরেরও সারা পৃথিবীতে আজও। আমার ওদের শিল্পকর্ম সম্পর্কে বেজায় আগ্রহ। প্রথম অ্যাবরিজিনাল আর্টের বড়সড় একটা প্রদর্শনী দেখেছিলাম কলকাতায়, একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে, সাতের দশকে। কিছু শিল্পীও উপস্থিত ছিলেন সেই প্রদর্শনীর সময়। জঙ্গলে, গুহায় তাদের বসবাস, কাজের পদ্ধতি, পরিবেশ ইত্যাদির অসাধারণ সব বড় বড় ফটোগ্রাফ ছিল। আর ছিল অনেক অরিজিনাল পেইন্টিং।
১৫.
‘এই অনন্ত আকাশ, সীমাহীন সমুদ্র, আর দিগন্ত ব্যাপী মরুভূমি, এদের কোন মাপজোক হয় না। এরা সব ঈশ্বরের সম্পত্তি, আমরা শুধু ভোগ করার অধিকার পেয়েছি’– এমনই মনের কথা আজও অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের। একথা শুনে আমার মনে হয়েছিল, এই আকাশ, এই সমুদ্র আর মরুভূমির সমস্তটাই নানান ভাবে দাগ কেটে ভাগ করে নিয়েছে মানুষ। ঈশ্বরের নিজস্ব জায়গা বলে আর কিছুই বাকি নেই। সবই এখন মানুষের।
সম্প্রতি অতিমারীতে অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করেছিলাম দীর্ঘদিন এবং সুযোগ হয়েছিল খুব কাছ থেকে তাদের শিল্পকর্ম দেখা। হাজার হাজার বছরের পুরনো সেই মানুষগুলো বংশ পরম্পরায় এখনও আছে। এখনও তারা এঁকে চলেছে সেই আগের মতোই। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের বিভিন্ন শৈলীর কাজের অনেক নমুনা দেখার ভাগ্য আমার।

অ্যাবরিজিনাল অস্ট্রেলিয়ানদের শিল্পকর্ম যেমন রহস্যাবৃত এবং বিস্ময়ের, তেমনই আদরেরও সারা পৃথিবীতে আজও। আমার ওদের শিল্পকর্ম সম্পর্কে বেজায় আগ্রহ। প্রথম অ্যাবরিজিনাল আর্টের বড়সড় একটা প্রদর্শনী দেখেছিলাম কলকাতায়, একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে, সাতের দশকে। কিছু শিল্পীও উপস্থিত ছিলেন সেই প্রদর্শনীর সময়। জঙ্গলে, গুহায় তাদের বসবাস, কাজের পদ্ধতি, পরিবেশ ইত্যাদির অসাধারণ সব বড় বড় ফটোগ্রাফ ছিল। আর ছিল অনেক অরিজিনাল পেইন্টিং। এছাড়া ওদের ব্যবহারের জিনিস, পোশাক, বাদ্যযন্ত্র, বিশেষ করে কাঠের তৈরি বাঁশি ইত্যাদি দেখতে পেয়েছিলাম সেই প্রদর্শনীতে। আর ছিল গাছের ছালের ওপরে করা শিল্পকর্ম। কখনও বা লোহার শলাকা দিয়ে পুড়িয়ে, কখনও রং দিয়ে তুলিতে আঁকা। দীর্ঘদেহী, কুচকুচে কালো, বড় বড় নাক-ঠোঁটের জীবন্ত প্রাগৈতিহাসিক মানুষগুলোকে অবাক হয়ে দেখেছিলাম। যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে।
পরবর্তীকালে সত্যিকারের অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে যখন ওদের নানা রকমের কাজ দেখলাম তখন অন্য অনুভূতি। কোন কাজ পাহাড়ের গুহাতে পাথরের গায়ে, কখনও গাছের বাকলে, কাগজে এবং এখনকার কালে একেবারেই আধুনিক ক্যানভাসে। প্রাইভেট গ্যালারিগুলো ওদের সরবরাহ করছে আধুনিক সরঞ্জাম। বিভিন্ন মিউজিয়াম এবং প্রাইভেট গ্যালারিতে অনেক কাজ দেখার সুযোগ হল।

বিভিন্ন ধরনের মধ্যে এক ধরনের কাজ আমার মাথা থেকে যাচ্ছেই না। বড় অদ্ভুত। মাপজোকের যখন কথা হচ্ছে আগের পর্ব থেকে, তখন সেই প্রসঙ্গে এটার কথাও একটু বলা যায়। এই ধরনের কাজগুলো মূলত মানচিত্র। একটা জায়গায় ওরা বেশিদিন থাকতে পারে না, কারণ খাদ্য এবং পানীয় জলের অভাব। তার ফলে ওদের স্থানান্তর ঘটতেই থাকে। আর সেই কারণেই একটা জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার আগে থাকে অনেক অনুসন্ধান। যেমন, এখান থেকে ঠিক কোন দিকে কতদূর গেলে বাসাযোগ্য জায়গা পাওয়া যাবে। সেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা, পানীয় জল এবং খাদ্যের কী অবস্থা, সে সমস্ত দেখা। কিছু লোক তারা এই কাজটা করতে থাকে সমস্ত গোষ্ঠীটাকে এক জায়গায় রেখে।
এই অনুসন্ধানে কিছুদূর যাওয়ার পর থেকে তারা প্রাকৃতিক কোনও চিহ্ন খোঁজে, জলাশয় কিংবা বড়গাছ অথবা ছোট ঢিবি, পাহাড়। সেগুলো তারা একটা ম্যাপের মতো করে নথিবদ্ধ করে। তারপর সেখান থেকে আবার যাওয়ার সময়, বাঁদিকে বা ডানদিকে কত দূরত্বে যাচ্ছে তেমন চিহ্ন দিয়ে রাখে। অদ্ভুতভাবে আমার মনে হয় যে, এইগুলোর দূরত্বের একটা অনুপাতও তারা দক্ষতার সঙ্গে করে। হিসেব-নিকেশে তারা কিন্তু বেশ পাকাপোক্ত। কতদূর গিয়েছে এবং সেখান থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার সময় আরও একটা চিহ্ন পর্যন্ত দূরত্বে অনুপাতের কমবেশি সেটাও বোঝা যায় এই মানচিত্রের মতো কাজগুলোতে।
মানুষ-গাছ-জন্তু-পাখি-নদী-পাহা
এই ডট পেইন্টিংগুলো আবার আজকালকার তরুণ শিল্পীদের একেবারে সমকালীন শিল্পের মধ্যে ব্যবহারে চেষ্টা দেখছি। যেটা বলছিলাম, এই ডটগুলো এক বা একাধিক রঙে ভরে দেওয়ার ব্যাপারটাই রহস্য, ছবিতে নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। আসলে কয়েকটি সাংকেতিক চিহ্ন ডট-এর মধ্যে লুকিয়ে আছে। সেগুলোই কোথায় কী আছে তার একেবারে হিসেব-নিকেশ। অর্থাৎ মানচিত্রটা সবার জন্য নয়, যে ক’জন মানুষ মিলে মানচিত্র তৈরি করতে গিয়েছিল মূলত তাদের কাছেই এটা থাকে, অন্যরা সহজে পড়তে পারে না। প্রয়োজনে এই মানচিত্রের ওপরে ভরসা করেই পুরো আদিবাসী গোষ্ঠীটাকে একটা জায়গা থেকে আর একটা জায়গায় স্থানান্তর করে। এই মানচিত্রধর্মী কাজটা করাও তো সহজ নয়। মরুভূমির পথে সামান্য ভুলের জন্য এরা নিজেরাই খাদ্যাভাবে এবং জলের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে এই কাজ করতে গিয়ে হয়তো আর ফিরেও আসেনি।

এখনকার আধুনিক আদিবাসী শিল্পীরা খুব বিশাল আঙ্গিকের দূরত্বে চলে আসেনি। অল্প সংখ্যক আধুনিক শিল্পীরা রঙচঙে ছবি আঁকলেও বেশিরভাগ শিল্পীরা এখনও সেই আদিম দুটো তিনটে বা চারটে রঙের মধ্যেই নিজেদের বেঁধে রেখেছে। আজও সেই সীমিত প্যালেট।
আগেও বলেছি, আমার নিজের শিল্পচর্চায় শুরুতে কিন্তু ছবি ছিল না। ছোটবেলা থেকে আমার মধ্যে শিল্পের কোনও আভাস যদি থাকে, সেটা মূর্তি করা। অর্থাৎ পুতুল এবং প্রতিমা বানানোর ঝোঁক। ফণী জ্যাঠা, মানে আমাদের পাড়ার ফণী পোটো-র সৃজনশীলতার নানা কথা আগে বিস্তারিত বলেছি। তিনি আমার শিল্পগুরু, আমি তার একলব্য।
ঠাকুর বানানোর নানান পর্যায়ে নানা ভাগ। কারিগরি পর্যায়ে নানা কৌশলগত দিক আর মাপজোক। ভাস্কর্য, প্রতিমা এবং পুতুল বানানোর মধ্যে একটা পার্থক্য থাকে। গ্রামীণ জীবনে এই কাজের যে ফর্মুলা বা গাণিতিক ব্যাপার, সেটা ছিল, কিন্তু তাদের নামের মধ্যে একটা গ্রামীণ ছাপ থাকত। যেমন ধরা যাক বড় সাইজের কালী ঠাকুর তৈরি করার সময়ে বলা হল, ‘চোদ্দ হাত কালী’। এই যে এত হাত, অত হাত, সেটা ওই মাপের ব্যাপার।

যখন কর্মসুবাদে দক্ষিণ ভারতে থাকতাম তখন সেখানে মূর্তি কলা দেখতে গিয়ে একটা অদ্ভুত ধরনের সিরিয়াস এরিয়াতে ঢুকে পড়লাম। টেম্পল স্কাল্পচার, মন্দির-ভাস্কর্য। শুধু তাই নয় সরকারিভাবে এবং বেসরকারি মানসিকতায় আর সাধারণ মানুষের অনুভূতি মিলিয়ে দক্ষিণ ভারতের এই মূর্তিকলাও আমার মনের মধ্যে একটা আলাদা স্থান করে নিল ধীরে ধীরে।
ড. বদীরাজের সঙ্গে আমার আলাপ হয় বেঙ্গালুরুর শিল্পীবন্ধু মারফত। বয়স্ক এবং ‘ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড’ মানে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মন্দির ভাস্কর্যের পুরোধা ভাস্কর। তাঁর সঙ্গে অন্যভাবে মূর্তি দেখলাম, তাঁর মুখে অন্যভাবে মূর্তি নির্মাণের গল্প শুনলাম। সেখানেও একটা নতুন মাপের নাম শুনলাম। তাল। দশতাল, নবতাল, অষ্টতাল ইত্যাদি। তার মানে কিন্তু অংকের নিয়মে গুনতি নয়, এখানে গুণগত দিক, স্টেটাস বা সম্মান, প্রতিপত্তি। সমাজে এবং সংসারে অবস্থানের দিক এবং জাগতিকভাবে তার মূল্যায়ন করতে তাকে একটা বিশেষ মাপে রাখতে হবে। অর্থাৎ যেখানে তিনি দেবতা বা দেবী সেখানে তার মাপজোক যা হবে, যখন তারা নররূপী তাদের সেই মাপে রাখলে হবে না। দেবতা এবং ভক্ত হতে হবে ভিন্ন মাপের। মন্দির ভাস্কর্যের অনেক মূর্তিতে তাই দেখি নানারকম বড় বড় মূর্তির হাতের কাছে, পায়ের পাশে অনেক হাঁটু সমান তার চেয়েও ছোট মূর্তি।

উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে অংশের যে মাপে, অর্থাৎ মুখ এত বড় হলে গলা কত বড়, গলা থেকে বুক, বুক থেকে পেট, সেই মাপগুলো আর একটা মাপ। মাপগুলো, অংশগুলো জুড়ে জুড়ে একটা যে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া হচ্ছে তার হিসেব-নিকেশ আর একটা অদ্ভুত বিষয়। এটাকে একটা ‘অনুপাত’ শব্দ দিয়েই সবসময় ব্যাখ্যা করা যাবে না। তার পরিবর্তে বলা যেতে পারে যে, আকার এবং অবয়বের মাপের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্ক স্থাপনে একটা সামঞ্জস্য বজায় রেখে পুরোপুরি সম্পূর্ণ রূপ দেওয়ার দক্ষতা। মজার ব্যাপার হল, এই যে অংশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক, সেখানে যদি কোনও বিঘ্ন ঘটে তাহলে সেটা হয়ে যায় সামঞ্জস্য বিরোধী। আবার এই যে পরস্পর সম্পর্কের মধ্যে বিরোধিতা অথবা আপাত দৃষ্টিতে যেটা ভুল সেই ব্যাপারগুলো কাজে লাগিয়ে সমকালীন শিল্পে আর এক রকমের শৈলী তৈরি হচ্ছে, সেটাকে বলা হতে পারে অসামঞ্জস্যের সামঞ্জস্য। কল্পনার, সৃষ্টির, সৃজনশীলতার অন্য মাত্রা।
গুরুদেব অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহায্য নেব এইখানে, সাপোর্টও বলা যায়। ওঁর ১৯৪১-এর ‘বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী’-তে ‘শিল্পীর ক্রিয়াকাণ্ড’ পর্যায়ে বলেছেন– “রসায়নশাস্ত্রে জল গ্যাস এসব তৈরীর প্রক্রিয়া বিষয়ে পরীক্ষার দায়ে সুনিশ্চিত হয়ে তবে পুঁথির মধ্যে মানুষ প্রক্রিয়ার হিসেবটা ধরলে। বই পড়ে সেই ক্রিয়া কর ঠিকঠাক ফল নিশ্চয় পাবে। কিন্তু শিল্পশাস্ত্রের নির্দেশ ও মান-পরিমাণ মতো মূর্তি গড়লে পাথর দেবতাই হবে যে তা নয়, আট দশ হাত মনুষ্যেতর ব্যাপারও হ’তে পারে। ছন্দশাস্ত্র মতো ঠিকঠাক ছন্দ-বাঁধা জিনিষ সব সময়ে কবিতা হয় না।”

সত্যিই তো, “বাঁধা-ধরা যোগশাস্ত্র পড়িয়ে যোগী সৃষ্টি করা যায় না। বাঁধা-ধরা ছন্দ নিয়ে, সুর নিয়ে, কবিতা বা সঙ্গীতকে ধরে আনা যায় না। যে কবিতা ছিল কালিদাসের আমলে, ছন্দশাস্ত্র মতে তারই পুনরাবৃত্তি যদি চলতো, সাহিত্য-সেবার দরকারই হত না আজকের মানুষের। সৌভাগ্য, যে এটা ঘটা সম্ভব হ’ল না। দেবতা হলেই নবতাল, নর হলেই অষ্টতাল ইত্যাদি শাস্ত্রের যে নিয়ম, শিল্পী মাত্রেই সেটা ভাঙলো, বদলালো।”
সৃষ্টিশীল কাজ বলুন বা শিল্পকলা বলুন এ বিষয়ে কথা, গল্পচ্ছলে মাপ আর হিসেব-নিকেশের ব্যাপারে বলতে এসে অবনী ঠাকুরে আটকে গেলাম। কারণ এত সুন্দর করে উনি বলেছেন এবং সবার বোধগম্য করে বলার ভাষাও ওঁর একান্তই নিজের, সেই কারণে এইখানে এসে ওই উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। প্রিয় পাঠক, ভালো লাগলে বরং ওই বইটি পড়ে নেবেন।
এইখানে আরও একটা কথা স্পষ্ট করে বলা দরকার, শিল্পী, শিল্প, সৃজনশীল মানুষ, এই সমস্ত বলে নিজের দাম বাড়ানো, ভয় দেখানো আর লোককে বিরক্ত করার কোনও মানে হয় না। অন্যদিকে কিন্তু শ্রোতা-দর্শক-পাঠক এঁরাও বদলাচ্ছেন। নিজেদের পছন্দমতো কোনটা দরকার, কোনটা দরকার নয়, সে বিনোদনই হোক বা জ্ঞান অর্জন, এ ব্যাপারে সবাই সচেতন। কারণ, পৃথিবীর ঘুরপাকের স্পিড বোধ হয় বেড়ে গেছে, এ ধারণা অনেকেরই।
প্রীতীশদা মানে প্রীতীশ নন্দীর সঙ্গে আমি নানা রকম কাজকর্মে জড়িয়ে ছিলাম মুম্বাই পিরিয়ডে অনেকদিন। আপনারা যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন, মুম্বাইয়ের আসল মন্ত্রটাই হল ‘টাইম পাস’। জিন্দেগী না মিলেগি দোবারা।
পাঠক লেখকের মধ্যে টুগেদারনেস। প্রীতিশদার কথা মনে পড়লেই মুকুলদার কথাও মনে পড়ে যায়। মুকুল শর্মা। টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় আমাদের সেই সময়ের নানা বিভাগের অদ্ভুত অদ্ভুত বিজ্ঞ বন্ধুদের কথাও মনে পড়ে। বিজ্ঞান বিষয়ক রসিকতা, শিবরামীয় আঙ্গিকের। ভারী বিষয়কে সহজ, সরল এবং রসালো করে আলোচনা করা যেতে পারে, সেটা আমি দেখলাম মুকুলদার সঙ্গে আড্ডায়। এই মাপজোক বিষয়ে যে কথা চলছে সে ব্যাপারে মুকুলদার বলা কথা এখন আমি আপনাদের বলি। বিজ্ঞানের মত নীরস বিষয়কে সহজ করা এবং শিবরাম চক্রবর্তীর মতো মানুষের নাম এখানে কেন টেনে আনা হল– তার একটা প্রমাণ হয়ে যাবে এক্ষুনি হাতেনাতে।
মাপজোক বিষয়ে মুকুল শর্মার সহজ প্রশ্ন: ব্যারোমিটার দিয়ে কীভাবে একটা বিল্ডিং-এর উচ্চতা পরিমাপ করা যায়? মুকুলদার কথায়– যেহেতু ব্যারোমিটার হল বায়ুমণ্ডলীয় চাপ পরিমাপের একটি যন্ত্র এবং এটি আরোহণের উচ্চতা নির্ধারণের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, তাই হাইস্কুলের কোনও ছাত্রছাত্রী তোমাকে বলতে পারে যে, প্রথমে মাটির স্তরে এবং তারপর আবার ছাদে চাপ পরীক্ষা করতে হবে, রিডিংয়ে হ্রাস বা বৃদ্ধি বা যা-ই হোক না কেন, ইত্যাদি ইত্যাদি…।
–বিজ্ঞান জিন্দাবাদ। কিন্তু ব্যারোমিটার দিয়ে একটি বিল্ডিং এর উচ্চতা মাপার অন্য কোনও উপায় নেই? আমি এর কিছু দুর্দান্ত উত্তর দেখেছি, যার জন্য কোনও পদার্থবিদ্যার জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। যেমন– তুমি ব্যারোমিটারটি ছাদে নিয়ে যাও এবং এটি ফেলে দাও। সেকেন্ড গোনো, যতক্ষণ না এটা ফুটপাতে ভেঙে পড়ে। তারপর মাধ্যাকর্ষণের শক্তি, সেকেন্ডে তার গতি ইত্যাদি…। একটু কঠিন?
–এখন ব্যারোমিটারের সঙ্গে একটা দড়ি বেঁধে আবার ছাদে ফিরে, এটা মাটিতে নামিয়ে দাও। দড়িটার পরিমাপ করো।
–আরে, তুমি বলছ, এটা ব্যারোমিটার ব্যবহার করা নয়! এটা তোমার মাথা ব্যবহার করা! কিন্তু, কে বলেছে তোমাকে ফাংশনের উপর স্থির থাকতে হবে?
–তাহলে তুমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে পড়ো, আবার ব্যারোমিটার ব্যবহার করে, দেওয়ালের সঙ্গে স্কেলিং করে। তোমার সেই ডাংগুলি খেলার দূরত্ব মাপার পদ্ধতিতে। ধরো, যদি ৯৬ বারে ব্যারোমিটার ছাদে পৌঁছায় এবং যন্ত্রটি ১০ ইঞ্চি লম্বা হয়, তাহলে উচ্চতা হবে ৯৬ x ১০ = ৯৬০ ইঞ্চি। অথবা ৮০ ফুট।
–অথবা, সন্ধের দিকে, যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে কিন্তু দিগন্তে ডোবেনি, তখন তুমি সেই ব্যারোমিটারটা নিয়ে বিল্ডিং-এর পাশে মাটিতে রাখতে পারো। বিল্ডিংটা ইতোমধ্যেই একটি দীর্ঘ ছায়া ফেলছে, তাই না?
ব্যারোমিটারটাও তাই করবে। যেহেতু ব্যারোমিটারের দৈর্ঘ্য ইতিমধ্যেই জানা, তাই বিল্ডিং-এর দৈর্ঘ্য (উচ্চতা) বের করা সোজা পাটিগণিতের ব্যাপার।

–তবে, আজ পর্যন্ত আমি সবচেয়ে সহজ যে সমাধানটা পেয়েছি, তার মধ্যে সত্যকার অর্থে কোনও বিজ্ঞান নেই, কোনও বিচক্ষণতা নেই, কিছুই নেই। কেবল প্রচুর পরিমাণে রসিকতা আর সমস্যা সমাধানের জন্য এক ভিন্ন উপায় আছে। তুমি ব্যারোমিটারটি পকেটে রেখে দেড় তলার ঘরে চলে যাও। সেখানেই সাধারণত বিল্ডিং-এর অফিসগুলো থাকে। একটা ছোট ভাঙা দরজা, যা বছরের পর বছর ধরে রঙ করা হয়নি। তুমি ব্যারোমিটারটি বের করে স্মার্টলি দরজায় আঘাত করো। যখন একজন পরিশ্রমী, দাড়ি না কামানো, কম বেতনের কেয়ারটেকার দরজা খুলবে, তখন বলো, ‘শুনুন, আমার নাম অপর্ণা (অথবা যে কেউ)। আমার কাছে ২০০০ টাকা দামের একটা ব্যারোমিটার আছে। আপনি যদি আমাকে শুধু এই বিল্ডিং-এর উচ্চতা বলেন তবে এটা আপনার’।
এরপরে আর ভারী ভারী বিজ্ঞানের মাপজোকে ফিরে আসার খুব একটা প্রয়োজন আছে কি? প্রাত্যহিক জীবনে কত মাপজোকই না করছি আমরা!

এই তো সেদিন বাড়ির রং করতে কেউ একজন এসে ফটাফট মেঝে থেকে ছাদ, এ দেয়াল থেকে ও দেয়াল লেজার সিস্টেমে মুহূর্তে মেপে ফেলছে। দেয়ালের পর দেয়াল কামরার পর কামরা। প্লেনে সর্বক্ষণ বুঝতে পারছি কত উঁচু দিয়ে যাচ্ছি, কত গতিতে যাচ্ছি। সূর্য চন্দ্র গ্রহ তারা বিজ্ঞানীরা মেপে ফেলছে চুটকিতে। বিশাল দূরত্বে কারা কারা আছে, কত সে আলোকবর্ষ দূর, এসব এখন মুড়ি-মুড়কি। ভাববেন না, এই যে বিশাল বিশাল আকৃতির সব বস্তু ভেসে বেড়াচ্ছে মহাকাশে এবং তাদের দূরত্ব, ওজন নিয়ে মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো বিশাল বিশাল অংক। মাথায় আসবেই না যে ক্ষুদ্র প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া থেকে ভাইরাস, অণুবীক্ষণের তলায় কী না কী ছোটখাটো জিনিসের অদ্ভুত বিশাল গাণিতিক সংখ্যা। শব্দের কত ভাগ, এক সেকেন্ডের হাজার হাজার ভাগের একভাগ, এই সমস্ত কিন্তু আরও একটা বিশাল আকারের অংক।

তবে মুকুলদার সঙ্গে আড্ডার পর কঠিন ব্যাপারটা আর কঠিন থাকত না। ঠিক যেন শিবরামীয় আঙ্গিক। আরও হালকা হয়ে যায় শিবরাম চক্রবর্তীর সঙ্গে আড্ডায়। দু’জনেরই মুখে যেন যে কোনধ উত্তর রেডি থাকে। শিবরামকেও চিনতাম, আমাকে উনি স্নেহ করতেন। আজ এখানে শিবুদা থাকলে হয়তো বলতেন, ব্যারোমিটারের কী দরকার, সুতো দিয়ে যদি নিচে পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে মাপতেই হয় তাহলে তো থার্মোমিটার হলেও চলে। এ সব হচ্ছে মাথার মাপজোক। বুঝলে? আরও একজন আমার প্রিয়, সুকুমার রায়। বিজ্ঞানবিষয়ক, ছেলে-বুড়ো সবার জন্য অমন প্রাঞ্জল করে লেখা, আর হবে না। তিনিও বুদ্ধি মাপতে হলে বলতেন–
আয় তোর মুণ্ডুটা দেখি, আয় দেখি ‘ফুটোস্কোপ’ দিয়ে।
…পড়ুন অল্পবিজ্ঞান-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৪: মাপের ভুলভাল, পাগলের মাপজোখ
পর্ব ১৩: শব্দ কল্প দ্রুম
পর্ব ১২: হ্যালো, তুমি শুনতে পাচ্ছ কি?
পর্ব ১১: ‘শব্দ’ শুধুই আওয়াজ নয়
পর্ব ১০: শিল্পকলায় বিষ্ঠা মানে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ অথবা প্রতিবাদ
পর্ব ৯: বাস্তব আর ভার্চুয়ালের সীমান্তে দাঁড়িয়ে হাইব্রিড আর্ট প্রশ্ন করতে শেখায়– শিল্প কী?
পর্ব ৮: মগজে না ঢুকলে শিল্পও আবর্জনা
পর্ব ৭: ছবির অসুখ-বিসুখ, ছবির ডাক্তার
পর্ব ৬: বিসর্জনের মতোই একটু একটু করে ফিকে হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর রং ও রূপ
পর্ব ৫: জীবন আসলে ক্যালাইডোস্কোপ, সামান্য ঘোরালেই বদলে যায় একঘেয়ে নকশা
পর্ব ৪: কুকুরেরই জাত ভাই, অথচ শিয়াল সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?
পর্ব ৩: অন্ধকারে অল্প আলোর মায়া, ফুরয় না কোনওদিন!
পর্ব ২: বজ্রবিদ্যুৎ ভর্তি আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে আমাদের চিরকালের নায়ক হয়ে আছেন বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved