
‘রেজ বেট’ আসলে রাগের চাষ। অর্থ হয়, এমন এক ধরনের অনলাইন কন্টেন্ট, যা মূলত ক্ষোভ উদ্রেককারী। সে ক্ষোভের জন্ম হতে পারে বিবিধ প্ররোচনা থেকে। ক্রমাগত উত্যক্ত অথবা আক্রমণের ফলাফলও হতে পারে– ক্ষোভ। তাই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস জানিয়েছে, এ-বছরের শ্রেষ্ঠ শব্দটি হল, ‘রেজ বেট’। প্রশ্ন উঠেছে, শব্দ কই? এ যে এক শব্দবন্ধ! অক্সফোর্ড বলছে, ‘রেজ বেট’ আসলে একক ও স্বতন্ত্র অভিব্যক্তি। আসলে একটি ভাষা ব্যপ্ত হয় এভাবেই। সে তো গ্রহণে সর্বদা সক্ষম।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
দিব্যি স্ক্রোল করছিলেন। গায়ে ছিল শীতের কাঁচা-রোদ। ছাদে ছিল বয়ামভর্তি আচার। আর ছিল কলকাতার একিউআই– ৫০০ ছুঁইছুঁই!
তবু স্ক্রোল করছিলেন। হঠাৎ থামলেন। বেমক্কা রেগে গেলেন দারুণ। মনে হল, কার এত সাহস? চেতন ভগতের মতো লেখকের পাশে ‘ওভারহাইপড’ ট্যাগ লাগিয়ে দেয়? ইয়ার্কি হচ্ছে!
বলা মাত্রই ২৫০ শব্দের একটি আখাম্বা রচনা লিখতে শুরু করলেন পোস্টদাতার কমেন্ট বক্সে। এইবার মাথায়, মনে আর মাংসের ভেতরে টুপ টুপ করে ঝরতে শুরু করল তরল আগুনে লোহা। আরও কমেন্ট! আরও আরও তরল লোহা! স্নায়ু ফেটে বেরিয়ে আসতে চায় যত! তত ঘন হয় ক্রোধ। উদ্বেগ। অপারগতা। অথচ এ ইন্সটাগ্রাম পোস্টে আপনি ততক্ষণে এনগেজড। পোস্টদাতা উসকানি দিয়েছিল ইচ্ছাকৃত। ‘রেজ বেট’ করেছিল। হিম হিম মস্তিষ্কে। তবু আপনি? ধরা পড়ে গিয়েছেন বিলকুল! মাথায়, মনে আর মাংসের ভেতরে তরল আগুনে লোহা…

যেমন ক্লিক বেট। আকছাড় টাইমলাইনে ভেসে ভেসে উঠছে কত কত প্রলুব্ধকর লিংক! শুভমান গিলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলেন কে? বাংলা সিরিয়ালের নায়িকা জলকেলিতে মাতলেন কেন? আগামী শনিবার ভুলেও যে কাজগুলি করবেন না… পড়ুন কমেন্টে। আড়াল খুঁজে নিয়েছেন তৎক্ষণাৎ, কখনও হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে দুরন্ত। কিন্তু ক্লিক করে পেয়েছেন কী? ফক্কা! জাস্ট কিচ্ছু না।
‘রেজ বেট’-ও তেমন। রাগের চাষ। অর্থ হয়, এমন এক ধরনের অনলাইন কন্টেন্ট, যা মূলত ক্ষোভ উদ্রেককারী। সে ক্ষোভের জন্ম হতে পারে বিবিধ প্ররোচনা থেকে। ক্রমাগত উত্যক্ত অথবা আক্রমণের ফলাফলও হতে পারে– ক্ষোভ। তাই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস জানিয়েছে, এ-বছরের শ্রেষ্ঠ শব্দটি হল, ‘রেজ বেট’।
প্রশ্ন উঠেছে, শব্দ কই? এ যে এক শব্দবন্ধ! অক্সফোর্ড বলছে, ‘রেজ বেট’ আসলে একক ও স্বতন্ত্র অভিব্যক্তি। আসলে একটি ভাষা ব্যপ্ত হয় এভাবেই। সে তো গ্রহণে সর্বদা সক্ষম।

মনে পড়ছে, গত বছরেও, এ-হেন একটি শব্দবন্ধকেই বেছে নিয়েছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। ‘ব্রেন রট’! যে-সমস্ত মস্তিষ্ক পচে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ফোকাস করতে চাইছি, প্রত্যেকটি শব্দের বাছাই-প্রক্রিয়ার গভীরে রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের কী আশ্চর্য প্রতিফলন! আস্ত একটা বছরের খতিয়ান যেন লিখে রাখা হয়েছে শব্দের শরীরে। যেন আমাদের রক্তের অন্তর্গত যাবতীয় বিস্ময় ইরেজার দিয়ে মুছে দিয়েছে কেউ অথবা কারা। গত দেড় ঘণ্টা ধরে কমেন্টবক্সে মারকাটারি করছি, কিন্তু কেন করছি? সম্পূর্ণ অহেতুক? উঁহু। আমাদের অনুভূতিগুলো সুনিপুণভাবে ম্যানিপুলেটেড হয়ে শেষমেশ ভার্চুয়াল বিস্ফোরণে শামিল। তাই বলা যেতে পারে, একুশ শতকের একমাত্র সত্য ক্রোধ। ঘৃণা। আক্রোশ। যে কারণে জোম্যাটোর ডেলিভারি বয় দু’-মিনিট দেরিতে খাবার নিয়ে এলে রেগে যাই। প্রেমিকা যদি চুমুতে অসম্মতি জানায়, ফুঁসতে থাকি। গীতাপাঠের ময়দানে চিকেন প্যাটিস বিক্রি হলে সাধ জাগে মব লিঞ্চের।
একটা ক্ষোভে আচ্ছন্ন পৃথিবী। কে আমাদের রাগিয়ে দিয়েছে মাই লর্ড? রাষ্ট্রনেতা? ইন্সটাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সার? কুৎসিত কোনও হাসি ভেসে আসে অদৃশ্য থেকে। অনলাইন কন্টেন্ট তো হালফিলে! ঘোরতর বাস্তবেই ‘রেজ বেট’-এর ফিকির আঁটা কতশত বছর আগেই! যেন আমরা বিভ্রান্ত হই আরও। যেন ভুলে যাই চাকরি-দুর্নীতি। খুল্লমখুল্লা ভোট-চুরি। একজন খেতমজুরের প্রতিদিনের আয় কত। নব্য লেবার কোড। দিল্লির বিষবায়ু। শ্বাসের অযোগ্য…
………………………..
একুশ শতকের একমাত্র সত্য ক্রোধ। ঘৃণা। আক্রোশ। যে কারণে জোম্যাটোর ডেলিভারি বয় দু’মিনিট দেরিতে খাবার নিয়ে এলে রেগে যাই। প্রেমিকা যদি চুমুতে অসম্মতি জানায়, ফুঁসতে থাকি। গীতাপাঠের ময়দানে চিকেন প্যাটিস বিক্রি হলে সাধ জাগে মব লিঞ্চের।
………………………..
নিউজ চ্যানেলের প্রাইম টাইমে, অর্ণব গোস্বামীদের গর্দভের মতো চিৎকার আসলে ‘রেজ বেট’! দেশের সাধারণ মানুষকে উসকে দেওয়া। এক এবং অপরের বিরুদ্ধে।

মনোবিশেষজ্ঞদের মতে, ‘রেজ বেট’-এর কয়েকটি অনায়াস পথ আছে। যেমন একটি পোস্ট বলছে: যে নিজেকে হিন্দু বলতে পারে না, সে আসলে অমানুষ। আরেকটি পোস্ট বলছে: কথা যদি হয় বিরিয়ানির, তাহলে মধ্যমগ্রামই সেরা। প্রথম পোস্ট, চূড়ান্ত বিতর্কিত। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে, ভার্চুয়াল সংঘর্ষের সম্ভাবনা তুমুল। তৃতীয়টি বলছে: মেয়েদের আজকাল রান্নাঘরে দেখা যায় না কেন? অর্থাৎ সরাসরি আক্রমণ। তিনটি ক্ষেত্রেই, পোস্টদাতা মস্তি লুটছে। প্রোফাইলের রিচ বৃদ্ধি পাচ্ছে হু হু করে। টাকা। টাকা। অথচ আপনি দিব্যি স্ক্রোল করছিলেন। গায়ে ছিল শীতের কাঁচা-রোদ। ছাদে ছিল বয়ামভর্তি আচার। হঠাৎ থামলেন। বেমক্কা রেগে গেলেন।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস আরও দু’টি শব্দ বেছেছিল। ‘অরা ফার্মিং’ এবং ‘বায়োহ্যাক’। অবশ্য টেক্কা দিতে পারেনি। যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানেই। তবে ‘অরা ফার্মিং’ শব্দটি অদ্ভুত। যে অত্যন্ত উদাসীন তবু জবরদস্ত কুল কিংবা আকর্ষণীয়! এ আসলে ‘কুলনেস’-এর চাষ। আর ‘বায়োহ্যাক’? এমন এক অনুশীলন, যা আপনার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উত্তরণে সহায়ক। নিত্যদিনের ডায়েট, স্লিপ-সাইকেল, অপরিহার্য খাদ্য-উপাদান বদলে বদলে ফিটনেসের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছনো। লেখাটি এতদূর অবধি পড়ে আপনার মনে হল, দেখো কাণ্ড! আমিও নিয়মিত শরীর-চর্চায় মগ্ন থাকি। আমিও তো কত উদাসীন তবু কুল! যাই একটা পোস্ট করি।
দিব্যি স্ক্রোল করছিলেন। গায়ে ছিল শীতের কাঁচারোদ। ছাদে ছিল বয়ামভর্তি আচার। আর ছিল কলকাতার একিউআই– ৫০০ ছুঁইছুঁই! হঠাৎ থামলেন। ফেসবুকে লিখলেন, ‘অরা ফার্মিং’ কেন ‘ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার’ হল না? নিদেনপক্ষে ‘বায়োহ্যাক’? অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের লোকগুলো কি ইডিয়ট? ‘রেজ বেট’ শব্দটি সম্পূর্ণ অর্থহীন। তারপর…
…………………..
রোববার.ইন-এ পড়ুন রোদ্দুর মিত্র-র লেখা
…………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved