
এইসব লাইব্রেরি কমলকুমার মজুমদার বা উদয়ন ঘোষের পাঠক তৈরি করেনি হয়তো। কিন্তু পাঠকসত্তা সক্রিয় রেখেছিল। ফলে তাঁদের মানিক চক্রবর্তী বা দেবেশ রায়কে চিহ্নিত করতে পরবর্তীতে অসুবিধা হয়নি। আমরা কথায় কথায় ন্যাশনাল লাইব্রেরি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, রামমোহন লাইব্রেরি, জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি এইসব বিখ্যাত লাইব্রেরির কথা বললেও বাংলা সাহিত্যের পাঠক তৈরিতে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল শহর মফস্সলে এই সাধারণ লাইব্রেরির (স্থানীয় এবং সরকার পোষিত)।
এখনও ‘পথের পাঁচালী’ পড়োনি? ‘আরণ্যক’? ‘গ্যালিভার ট্রাভেলস’-এর গল্পটা জানো তো? জ্যাক লন্ডনের ‘কল অফ দ্য ওয়াইল্ড’ নিশ্চয়ই পড়া আছে? ভালো অনুবাদ আছে জানো তো? এই ছিল ছোটবেলায় আমাদের বিভিন্ন অভিভাবক এবং সাংস্কৃতিক জেঠুদের অপমান করবার ধরন। না-পড়ার অপরাধ। রেজাল্ট যেমনই হোক, তুমি যে সাহিত্য-সংস্কৃতির খোঁজ রাখো না, তা এক ধরনের হীনম্মন্যতারই পরিচয় ছিল সেদিন। আমাদের অবসর মিলত বিস্তর। ডিসেম্বরের শেষে ফাইনাল পরীক্ষার পর কিংবা মাধ্যমিকের পর তিন মাস টানা গল্পের বই পড়ার স্বাধীনতা। এখন অবশ্য অভিভাবকেরা পরের দিন থেকেই নতুন ক্লাসের সিলেবাস হাতে ধরিয়ে দেন। আর সেই বই পড়ার ধরন বদলে গিয়েছে অনেকখানি। বদলে গিয়েছে বই ও পাঠকের সম্পর্ক। উত্তরাধিকারীর হিসেব-নিকেশ। সেদিন আমরা জানতাম বই থাকবে লাইব্রেরিতে, বাড়িতে নয়। দু’-একটি স্বচ্ছল পরিবার বাদ দিলে বই কেনার বিলাসিতা বা সামর্থ ছিল না নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের। কোনও কোনও আত্মীয় বা ভালো চাকুরিজীবী, কাকু-জেঠুদের বাড়িতে দেখেছি লটারিতে পাওয়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র রচনাবলি। যেখানে বাতাস ঢোকার উপায় ছিল না। শুধু বড় বিস্ময়ে হেরি, চমক লেগে মেতে উঠার সুযোগ নেই। পাতা ওল্টানোর ক্ষমতা কার্যত মালিকেরও নেই। অনেক পরিবারে একটি-দু’টি ‘সঞ্চয়িতা’, ‘সঞ্চিতা’, ‘গল্পগুচ্ছ’ পাওয়া যেত। যাঁর বাড়িতে সঞ্চয়িতা আছে তিনি ছেলেমেয়েদের পাড়ার রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর প্রধান উদ্যোক্তা। তখনও ‘গীতবিতান’ সহজলভ্য হয়নি। বরং গানের খাতায় পাওয়া যেত রবীন্দ্রনাথের আস্ত একটা গান। গানের দিদিমণির খাতায় গানের পরিমাণ আরেকটু বেশি। এমনকী, দু’-একটা ‘স্বরবিতান’ অতিরিক্ত সম্বল ছিল তাঁর। কিন্তু তখনও দূরদর্শনের ‘চিত্রহার’, ‘রঙ্গলি’ কিংবা ‘তেরো পার্বণ’, ‘নৃসিংহ রহস্য’ দখল করে নেয়নি সব অবসর। মেগা সিরিয়াল প্রতিদিনের বিষয় ছিল না। গানের জন্য রেডিও, পড়ার জন্য লাইব্রেরির বই, এই ছিল বিনোদনের প্রধান উপাদান। দু’-একটি ভাড়াটে পরিবারের ছিল সন্তোষ টেপ রেকর্ডার। সেখানে জোরে জোরে গান চলত পরিবার এবং পাড়ার স্বার্থে। ছুটির দুপুরে মাঝে মাঝেই বাজত ‘ছোটবউ’, ‘গুরুদক্ষিণা’র সংলাপ-সহ ক্যাসেট। সেদিন পাড়ার মাঠ থেকে স্থানীয় লাইব্রেরির দূরত্বে আলোকবর্ষ ব্যবধান ছিল না।

আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগেও সদ্য যুবক, ক্যাম্পের একদা বাসিন্দা, কিছু মানুষ কলোনিতে প্রাথমিক দাবিতে প্রাইমারি স্কুল, বাজার, বাসস্থানের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তুলেছিলেন কিছু স্থানীয় লাইব্রেরি। সেখানে সরকারি সাহায্যের প্রশ্ন নেই। বরং এর-ওর বাড়ি থেকে বিভিন্ন বই চেয়ে প্রাথমিক একটি লাইব্রেরির রূপ দেওয়া হত। তখনও বিয়েতে বই উপহার দেওয়ার রীতি বিব্রত করত না আমন্ত্রিতকে। তারপর কখনও চাঁদা তুলে, কখনও কারওর ব্যক্তিগত অর্থে বইয়ের সাম্রাজ্যটি একটু একটু করে সমৃদ্ধ হত। তখন পাড়ার বেকার যুবকরাই সপ্তাহে একদিন করে লাইব্রেরি খোলার দায়িত্ব নিতেন। পাঠক সংখ্যা বেশি নয়, তবে বেশ সংক্রামক। মফস্সলে একটি-দু’টি সরকারি লাইব্রেরির পাশাপাশি এমন ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি স্থানীয় অনেক বেসরকারি লাইব্রেরি ছিল। খুব বৈচিত্র না থাকলেও, বইমেলার নতুন বই না-থাকলেও, সেইসব লাইব্রেরি পাঠক তৈরিতে কোনও কার্পণ্য করেনি। এর পাশাপাশি ছিল সরকার পোষিত লাইব্রেরি, যেখানে প্রতি বছর সরকারি সহায়তায় জেলা বইমেলা থেকে অজস্র নতুন বই আনা হত। পাঠকের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। মাথায় রাখতে হবে এইসব পাঠক মূলত উপন্যাসের পাঠক। ছোটগল্পের পাঠক কম আর কবিতার বই প্রায় ছিলই না। ‘ছাড়পত্র’, ‘বনলতা সেন’, ‘সঞ্চয়িতা’, ‘সঞ্চিতা’– এসব ছিল ঐতিহ্য ও পরম্পরায়। এরই ফাঁকে কখনও কখনও ঢুকে পড়ত ‘বাবরের প্রার্থনা’, ‘উলঙ্গ রাজা’, ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’– মূলত পুরস্কারের সৌজন্যে। এইসব পাঠক বই নিতেন। সপরিবার গোগ্রাসে পড়তেন এবং পরের সপ্তাহে আবার নতুন বই ইস্যু করতেন। এমনকী, কোনও বই এগিয়ে দিলে আগে পড়া কিনা স্মৃতি থেকে বলেও দিতে পারতেন। এদের আমরা ‘ভাতঘুমের পাঠক’ বলে অশ্রদ্ধা করেছি এতদিন। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে বাঙালির বই পড়ার প্রধান কারিগর এরাই। আজ এরা সংখ্যালঘু। কোথাও কোথাও সংরক্ষণ করে রাখার মতো বিলুপ্তপ্রায়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, নিমাই ভট্টাচার্য, প্রফুল্ল রায়, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় থেকে কল্লোল সেনগুপ্ত, মৈত্রেয়ী দেবী, গৌতম রায়, বনফুল– প্রত্যেকের বইয়েরই পাঠক ছিলেন এঁরা। আর ছিল রহস্যময় জেমস হেডলি চেজ। অনেক বইয়ে পূর্ববর্তী পাঠক আসল রহস্যময় জায়গাগুলি আন্ডারলাইন করে রেখেছেন। কেউ কেউ ‘আমার নাম জানতে চাও, অমুক পাতায় যাও’ বলে বলে শেষ পর্যন্ত শেষ পাতায় নিয়ে গিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন। সেই বই আমাদের নয়। সে বই সবার। লাইব্রেরি থেকে একটি বই এনে দেখি পূর্বপুরুষের ঘামের গন্ধ তখনও মুছে যায়নি। তখন বই কেনা নয়, বই পড়াই ছিল মুখ্য। বই যে কেনার মতো জিনিস– একথা ভাবার অবকাশ ছিল না। এমনকী, বাড়িতে নিজস্ব পঞ্জিকা রাখার চলও হয়নি। ওসব মূলত ঠাকুরমশাইয়ের বাৎসরিক ব্যাপার। যাঁদের বাড়িতে ল্যান্ডফোন ছিল, তাঁরা সঙ্গে একটি ডিরেক্টরি বই পেতেন এবং সেইসব ডিরেক্টরি সাজিয়ে সাজিয়ে দিব্যি একটি বুক সেলফ নির্মাণ করা যেত। সবদিক থেকেই না-পড়ার আভিজাত্য চুঁইয়ে পড়ত।

আমরা এমন সর্বগ্রাসী পাঠক ছিলাম, একটি বইয়ের জন্য এক সপ্তাহ তো দূরের কথা, ছোট বইয়ের জন্য একদিনও অনেক বেশি মনে হত। রাতেই শেষ। আবার পরের দিন বিকেলের জন্য অপেক্ষা। কখনও ছোট বই লাইব্রেরিতে দাঁড়িয়ে পড়েই ফেরত দিয়ে আরেকটি ইস্যু করে নেওয়া। মনে পড়ে, ভগীরথ মিশ্রের ‘আড়কাঠি’ উপন্যাসটি লাইব্রেরি থেকে এনে আমি, দাদা এবং বাবা পড়েছিলাম। এক ঘণ্টা অন্তর রাত তিনটে পর্যন্ত। রাত্রি একটায় দেখেছি বাবা আমায় ডাকছে। এবার তার পালা। রাত্রি দুটোয় দাদা বাবাকে ডাকছে। এবার তার পালা। সেই দিন আজ কষ্টকল্পনা মাত্র। এইসব লাইব্রেরি কমলকুমার মজুমদার বা উদয়ন ঘোষের পাঠক তৈরি করেনি হয়তো। কিন্তু পাঠকসত্তা সক্রিয় রেখেছিল। ফলে তাঁদের মানিক চক্রবর্তী বা দেবেশ রায়কে চিহ্নিত করতে পরবর্তীতে অসুবিধা হয়নি। আমরা কথায় কথায় ন্যাশনাল লাইব্রেরি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, রামমোহন লাইব্রেরি, জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি এইসব বিখ্যাত লাইব্রেরির কথা বললেও বাংলা সাহিত্যের পাঠক তৈরিতে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল শহর মফস্সলে এই সাধারণ লাইব্রেরির (স্থানীয় এবং সরকার পোষিত)। গবেষণা কর্মের প্রস্তাবনায় গবেষকের হেলায় ভরা কৃতজ্ঞতার কোনও অবকাশ রাখেনি এই সব লাইব্রেরি। তার প্রয়োজন ছিল না। মূলত সাহিত্যের পাঠকের মোটা ভাত-কাপড়ের বন্দোবস্ত করাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য। একেকটি সাধারণ স্থানীয় বেসরকারি লাইব্রেরির ঐশ্বর্য দেখলে চমকে উঠতে হয়। যখন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর বইগুলি বাজারে সুলভ নয়, তখন তাঁর অনেকগুলি গল্পগ্রন্থ এবং উপন্যাস পাওয়া গিয়েছিল সীমান্তবর্তী একটি গ্রামীণ লাইব্রেরি থেকে। আমার এক ছাত্রী যখন কবিতা সিংহ নিয়ে গবেষণা করছেন এবং যখন তাঁর দু’-একটি উপন্যাস এবং ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না, তখন অসংখ্য গল্পগ্রন্থ এবং উপন্যাস পাওয়া গেল মুর্শিদাবাদের এক স্থানীয় লাইব্রেরি থেকে। আমাদের পাড়ায় মন্দিরের পাশে একটা ঘর দখল করে অগ্রদূত লাইব্রেরি তৈরি হয়েছিল। মন্দির কমিটির সঙ্গে লড়াই করে দীর্ঘদিন বেঁচেও ছিল। আজ তার অস্তিত্ব নেই। মনে পড়ে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে যাবেন এক অধ্যাপিকা। আমায় বললেন, একটি বিস্মৃত উপন্যাসের কথা। দিপালী দত্ত রায়ের ‘লাল হলুদ সবুজ আলো নেই’। আমি পরের দিন এই লাইব্রেরি থেকেই বইটি জেরক্স করে অধ্যাপিকার হাতে পৌঁছে দিই। সঙ্গে ‘বনসাই’ নামে তাঁর আরেকটি উপন্যাস। এইসব ছোটখাটো লাইব্রেরিগুলির এত গভীর সম্পদ কোথা থেকে এল? দেখা যাবে, স্থানীয় কোনও মাস্টার বা পাঠক গোপনে এইসব বই এনে রাখছেন। সমরেশ বসুর আদি নিবাস (যে-পাড়ায় ভাড়া থাকতেন) আতপুরে প্রায় শতবর্ষ পুরনো একটি স্থানীয় বেসরকারি লাইব্রেরি আছে। বীণাপাণি পাঠাগার। শাসক এবং বিরোধী দলের সঙ্গে যুদ্ধ করে এখনও কোনও রাজনৈতিক দল তার দখল নিতে পারেনি। সেখানেই পাওয়া গেল বিস্মৃত লেখক নারায়ণচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনেকগুলো উপন্যাস। পাঁচের দশকের আরেক বিস্মৃত কবি দুর্গাদাস সরকার সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা। এইসব লুকনো সম্পদ কেজি দরে বহু আগেই কলেজ স্ট্রিট বা মুদি দোকানে চলে গিয়েছে। একদিন আমরাই দায়িত্ব নিয়ে বুদ্ধদেব গুহর পাঠককে কবিতা সিংহের উপন্যাস তুলে দিয়েছিলাম। দায়িত্ব নিয়ে আশীষ লাহিড়ীর ‘অন্য কোনো সাধনার ফল’ বা রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ‘কামারের এক ঘা’– এইসব বই দিয়ে তরুণ পাঠককে নির্মাণ করছিলাম একদিন, আজ তা এক বিলুপ্ত জীবন। মরুপথে দিশা হারানো অস্তিত্বহীন নদীর রাষ্ট্রনির্মিত গণহত্যা।

শেষ ঘণ্টা বেজেছিল অনেকদিন আগেই। তখনও পাঠককে ধরে রাখা যেত অনেকগুলি বাংলা ইংরেজি সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন দিয়ে। প্রায় প্রত্যেক লাইব্রেরিতেই সরকারি চাকরির পরীক্ষার্থীদের জন্য দুপুরবেলাগুলি বরাদ্দ ছিল। এভাবে কোনওরকমে টিকে ছিল লাইব্রেরিগুলি। তখন কথায় কথায় চাকরির পরীক্ষার এত বই, এত বাংলা-ইংরেজি ম্যাগাজিন ছিল না। ফলে প্র্যাকটিসের জন্য লাইব্রেরির উপর নির্ভর করতে হত। এখনও কিছু লাইব্রেরি টিকে আছে কিন্তু পাঠাভ্যাস প্রায় লুপ্ত। বরং সমাজমাধ্যমে পাঠক সাজার বিপুল চাহিদা আছে। এর পাশাপাশি আমরা মনে রাখতে চাই বিভিন্ন কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব লাইব্রেরি ছিল। তখনও মফস্সলের স্কুলগুলিতে লাইব্রেরি ক্লাস দেওয়া হত। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাডেমিক বই বেশি হলেও, গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ কিছু কম ছিল না। এখন লাস্ট মিনিট সাজেশনের দৌলতে লাইব্রেরিতে না গেলেও চলে। আমি খুব স্পষ্ট করে জানি, তখনও অনেক অফিসের লাইব্রেরিতে স্টাফদের জন্য বই থাকত। তাঁরা নিয়মিত বই নিয়ে বাড়িতে ফিরতেন। পড়তেন। ছেলেমেয়েদের পড়তে বলতেন। তারপর জমা দিতেন। আসলে পড়তেই হত। আমার বই তো নয়। সাত দিনের বেশি লাগলে দিন অনুসারে ফাইন দিতে হবে। তাই যথাসাধ্য পড়াই ছিল আমাদের একপ্রকার ভবিতব্য। কখনও কাজ না থাকলে, বই জমা দেওয়ার তাড়া না থাকলে শুধুমাত্র ক্যাটালগ পড়েই দিনের পর দিন কাটিয়েছি। আমরা স্বপ্ন দেখেছি কিছুক্ষণ উপন্যাসটির পাশে বনফুলের নাম লেখা এক অজানা দেশের। ‘দেশ’ পত্রিকার বিজ্ঞাপনে শামসুর রহমানের ‘হরিণের হাড়’ কিংবা বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের ‘অশ্লেষা তিথির কন্যা’ এইসব বই না-পড়েই ভালোবেসেছিলাম। মাঝে মাঝেই বিজ্ঞাপনে দেখতাম ‘প্রমা প্রকাশনী’ থেকে বেরোচ্ছে কাঞ্চনকুন্তলা মুখোপাধ্যায়ের ‘হেমন্তে এই হলুদ খামার’ এই নামটুকুর প্রতি ভালোবাসাই ছিল পড়ার অধিক। পয়সার অভাবে বইমেলা থেকে আনা নানা ক্যাটালগ পড়ে কত দুপুর কল্পনায় কাটিয়েছি আমরা তখনও একটি পত্রিকা হাতে পেলে ছানবিন করে পড়ে পড়ে মুখস্থ করা ছিল আমাদের স্বভাব। তখনও লিটিল ম্যাগাজিন তিন ফর্মা বা চার ফর্মার বেশি হয়নি। সবটা পড়া যেত এবং পত্রিকা পড়ে সম্পাদকের দপ্তরের পোস্টকার্ড এসে পৌঁছত পাঠকের। এখন লিটল ম্যাগাজিন হাজার পাতার স্পেশাল ইস্যু। পড়ার জন্য নয়। শুধুমাত্র সংগ্রহের জন্য। না-পড়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়ে দেওয়া অসামান্য কাজ। এখন লিটল ম্যাগাজিনের অধিকাংশ সম্পাদকের স্পাইন দেখা না গেলেও ম্যাগাজিনের স্পাইন দেখার মতো বিষয়। নিজস্ব বইয়ের অভাব ছিল বলেই একটি-দু’টি বই, কম পয়সায় কিনে, বারবার পড়েও আশ মিটত না। ১৯৯৪ সালে আমি কেমিস্ট্রি বইয়ের ভেতর লুকিয়ে পড়েছিলাম শঙ্খ ঘোষের ‘তুমি তো তেমন গৌরী নও’। পূর্ণেন্দু পত্রীর অসামান্য প্রচ্ছদ। দাম মাত্র ছ টাকা। অন্তত ৭০ বার সেই কাব্যগ্রন্থ আমার পুরো পড়া। যেহেতু কেনার সামর্থ্য ছিল না, একটি-দু’টি বইকে ভালোবেসে এক যুগ কাটিয়ে দেওয়া যেত। জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা একটি পাঠকের সারা জীবনের জন্য যথেষ্ট ছিল সেদিন। এইসব বইয়ের পাতা উল্টেই আমরা বুঝতে পারতাম প্রচ্ছদশিল্পী কে, কত কপি ছাপা হল, মুদ্রাকরের নাম, প্রকাশকের নাম। এভাবেই প্রচ্ছদশিল্পীকে নাম না দেখেই চিহ্নিত করার গৌরব ছিল আমাদের।

দিব্যেন্দু পালিতের বই পড়তে পড়তে দেখলাম কপিরাইট কল্যাণী পালিতের। এর থেকেও তথ্য আদায় করতাম আমরা। আজ এইসব বেসরকারি স্থানীয় লাইব্রেরি কার্যত পার্টি অফিস বা ক্লাব। বেশিরভাগ সরকার পোষিত লাইব্রেরি বন্ধ। একজন লাইব্রেরিয়ান চারটি সরকার পোষিত লাইব্রেরি একসঙ্গে দেখছেন। পাঠকের সংখ্যা কার্যত নেই। কিন্তু বইয়ের বিক্রি বাড়ছে। বইমেলার বিক্রি তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আজ দিকে দিকে ক্রেতা ও বিক্রেতা। পাঠক উধাও। পড়ার চেয়ে সংগ্রহের দিকে ঝোঁক বেশি। সমাজমাধ্যমে প্রমাণের দায় বেশি। পাঠের চেয়ে পাঠকের ইমেজ বড় হয়ে উঠেছে আজ। অন্তত সোশ্যাল মিডিয়া তাই বলছে। কেন এমন হল তার হয়তো স্বভাব ও প্রযুক্তির একটা পূর্ব ইতিহাস আছে।

নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে অতি সক্রিয় হয়ে উঠল জেরক্স মেশিনগুলি। মূলত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। এখান থেকেই শুরু হল পুরো বই জেরক্স করে স্পাইরাল বাইন্ডিং করিয়ে নেওয়ার নানা ফিকির। শিয়ালদা স্টেশনের কাছে সস্তায় অনেকগুলি দোকান গড়ে উঠল। যেখানে প্রতিদিন রাশি রাশি বই জমা পড়ত এবং জেরক্স হয়ে বেরিয়ে আসত। আগে লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ে হাতে কপি করতে হত বেশিরভাগ বই। গুরুত্বপূর্ণ লাইব্রেরিতে বই জেরক্স করতে দেওয়া হত না, বইয়ের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে। পড়া এবং হাতে নোট নেওয়াই ছিল সম্বল। এখন লাইব্রেরির এই দুর্দিনে কর্মীদের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে সহজেই দুষ্প্রাপ্য বই জেরক্স করে নেওয়া যায়। দামি বই জেরক্স করালে কম পয়সা লাগে। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উপকারী এবং স্বাস্থ্যকর। অচিরেই কিন্তু এই রোগ বিসূচিকার মতো ছড়াতে লাগল। বাড়িতে জমি উঠল জেরক্স বইয়ের পাহাড়। ‘পরে পড়ব’– এই অছিলায় জমে ওঠে বোঝা। আমি যত ভার জমায়ে তুলেছি সকলই হয়েছে বোঝা। এই বোঝার ভার কমাতে গত দশ বছরে এসে পড়ল পিডিএফ। বইয়ের বদলে শুরু হল সস্তায় পিডিএফ চালাচালি। ডাউনলোড এবং চালাচালি। না-পড়লেও চলে। শুধু আমার সংগ্রহে কত কী আছে! কত না মণিমানিক্য এই বোধ! এক ছোবলেই হাজার বইয়ের ছবি। পাঠক হয়ে উঠল না-পড়া বইয়ের মিউজিয়ামের কিউরেটর। ব্যাগের বোঝা কমল কিন্তু বোঝা বাড়ল ডিভাইসে। কোনওদিন পাতা ওল্টানো হবে না এমন লক্ষাধিক বই জমা হল মোবাইলে। আমার মোবাইলই আমার লাইব্রেরি। এসেছিলে তবু আসো নাই, পলাতক পাঠকের ছায়া। শারীরিক পরিশ্রম কমল। সেই সময়ের মূল্য বই পড়ায় নিয়োজিত হল না। বরং আমরা দেখলাম কঠোর এক বিকল্প যার কোনও পরিশ্রম নেই। এরা পাঠক নয়, সংগ্রাহক। এরাও সেই আমাদের আত্মীয়-স্বজনের মতো যাঁদের বাড়িতে রবীন্দ্র রচনাবলিতে বাতাস ঢুকতে ভয় পায়।

আজ শহরে মফস্সলে বেশিরভাগ লাইব্রেরি বন্ধ। কিন্তু খুলে গিয়েছে ব্যক্তিগত লাইব্রেরির এক অতিকায় দরজা। আমরা অজস্র ভালো-মন্দ পেরিয়ে তবে বেছে নিয়েছি প্রিয় কবি বা লেখককে। আজ একজন তরুণ পাঠকের জীবনে শুরু থেকেই কবি বা লেখক নির্বাচিত। আমরা শঙ্খ, শক্তি, সুনীল, নীরেন্দ্রনাথ পেরিয়ে শম্ভু রক্ষিত বা যুগান্তর চক্রবর্তীকে চিনেছি। আজ একজন তরুণ পাঠক অগ্রজ দাদার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে প্রথমেই হাতে তুলে নিচ্ছেন রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী কিংবা উদয়ন ঘোষ। লাইব্রেরি থেকে ভালো-মন্দ মিলিয়ে পড়ে নিজস্ব ভাবনা গড়ে ওঠার সুযোগ নেই। প্রথমেই তিনি চূড়ায় উঠে বসছেন। তারপর না পড়েই নিদান দিচ্ছেন সুবোধ সরকার ফালতু কবি। ওই জনপ্রিয় বইটি আসলে একটি ট্র্যাশ। পড়ুয়ার চেয়ে পাঠকের মুখোশ বড় হয়ে উঠছে প্রতিদিন। একটি-দু’টি প্রতিক্রিয়া, রিভিউ কিংবা সমাজমাধ্যমে দু’-একটি কবিতা পড়ে বুঝে ফেলছে, সে আমার কবি নয়, আমি সেই লেখকের পাঠক নই। যেন সে জীবন দিয়ে মুচকি হেসে বুঝে ফেলেছে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই স্লোগানটি: না-পড়ার ইতিহাস দিয়ে বানানো অতিকায় একটি ফানুস। আমরা বই পড়েছিলাম শুধুমাত্র বিস্মিত হব বলে। মুগ্ধতার আনন্দে মাথা উঁচু করে একটা বিকেল পায়চারি করব বলে। এর বেশি কিছু প্রয়োজন ছিল না। আজ দেখতে পাচ্ছি লেখকের পাশাপাশি গড়ে উঠছে পাঠকের কেরিয়ার। মনে রাখতে হবে, আজকের সিরিয়াস সাহিত্যের সিংহভাগ পাঠক আসলে পাঠকের ছদ্মবেশে কবি বা লেখক বা প্রকাশক। সুতরাং, পাঠক হিসাবে তাঁর দেখানোপনার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নগদমূল্য আছে। পাঠকের সেতু ধরেই সে প্রকাশক হিসেবে লেখকের কাছে পৌঁছয়। কিংবা কবি হিসেবে সম্পাদক-কবির কাছে। সমাজমাধ্যমে পাঠ প্রতিক্রিয়ার নামে আসলে আমরা যা দেখি তা এক উচ্ছ্বসিত স্তাবকতা। উচ্চকিত দ্বিরালাপ। এমনকী, পাঠক সেজে নিজের বইটির বিক্রি খানিক নিশ্চিত করা। নিছক পাঠকের দিন আজ শেষ। যতই তাঁদের ভাতঘুমের পাঠক বলি তাদের পড়াশোনায় বিনোদন বা বিস্ময় ছাড়া অন্য কোনও দাবি ছিল না। লেখকের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ কোনও যোগাযোগ ছিল না। হয়তো প্রয়োজনও ছিল না। আজ শুধু পাঠের আনন্দ দিয়ে কাজ চলে না। পক্ষ ও বিপক্ষ নিতে হয়। এমনকী, ব্যক্তিগত সমস্যার পোস্টেও পাশে আছি তুমি এগিয়ে যাও– এইসব নিদান দিতে হয়। না-হলে পাঠকের ছদ্মবেশে ক্রেতার মান থাকে না। আর এভাবেই বেড়ে ওঠে সংগ্রহ। বইয়ের পরে বই জমে। না-পড়া সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী। পড়ার চেয়ে সমাজমাধ্যমে দ্রুত লিখনের কদর বাড়ে। আজ বাংলা সাহিত্যে পাঠের বিস্ময়কর খিদের চেয়ে সংগ্রহের চোখের খিদে ভূমিকা নিয়েছে সবচেয়ে বেশি। নির্বাচিত পড়ার এক অন্ধগলিতে, এক বিস্ময়কর উন্নাসিকতার আভিজাত্যে ভরে উঠেছে পাঠকের ঘরবাড়ি। সংকলক এবং টীকা-ভাষ্যকারের বাজারদর বাড়ে। এভাবেই এসে পড়ে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগের দিন। এবার বিশ্বসাহিত্যের নজরদারি। এবার বাংলা সাহিত্যের পাঠকের রাজজ্যোতিষী হয়ে উঠবার অগ্নিপরীক্ষা। আগের রাতেই যে পাঠক সদ্য নোবেলজয়ীর লেখা পড়ে ঘুমতে গিয়েছেন– এই সুযোগে তাঁকেও প্রণাম।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved