
১৯২২ সালের ওরিয়েন্টাল আর্ট সোসাইটির গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী– যেখানে দেখানো হয়েছিল এমিল নোল্ডে, পল ক্লি কিংবা কান্দিনস্কি-র ছবি– সেখানে ভারতীয় শিল্পীদের নামের তালিকায় তিনিও ছিলেন। ১৯২৩ সালে বার্লিনের ক্রাউন প্রিন্স প্যালেসের ন্যাশনাল গ্যালারিতে অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, এস এন দে কিংবা ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদারের পাশাপাশি তাঁর ছবিও প্রদর্শিত হয়েছিল। ফরাসি শিল্পী নোরা পার্সে কলকাতায় এসে সুনয়নীর ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে লন্ডনের এক প্রদর্শনীতে পাঠিয়েছিলেন তাঁর ছবি। স্টেলা ক্রামরিশ যে তাঁর ছবির স্বচ্ছ স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে তাঁকে ‘অজন্তা ও ভারতবর্ষের যথার্থ উত্তরাধিকারী আধুনিক শিল্পী’-র অভিধা দিয়েছিলেন।
‘আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ আপনারই আবরণ!
খুলে দেখ্ দ্বার অন্তরে তার আনন্দ নিকেতন।।’
সুনয়নী দেবী সম্পর্কে লিখতে বসে এ গানটার কথা মনে পড়ল। তাঁর ‘রবিকাকা’র লেখা এ গানখানা তাঁর সম্বন্ধে যতটা সত্যি, ততটা বোধহয় আর কারও ক্ষেত্রেই নয়। শিল্প-ঐতিহাসিকদের মতে, সুনয়নী ভারত-শিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ‘আধুনিক’ মহিলা-শিল্পী। তবু কেন এই আবরণ? পাঁচ নম্বর দ্বারকানাথ ঠাকুর লেন। সেই বাড়ির ছোট মেয়ে সুনয়নী। খুব অল্প বয়সেই গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু, পিতৃহারা। তিন দাদা ও এক দিদির স্নেহচ্ছায়ায় বড় হয়েছেন। মা সৌদামিনী দেবী ছিলেন রক্ষণশীল হিন্দু-ঘরের বিধবা– নানা আত্মীয়স্বজন, দাসদাসী, আশ্রিতজন নিয়ে বিরাট সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়েছিল। উনিশ শতকের শেষ দশকে, সেখানে তখনও অন্তঃপুরের পর্দার কড়াকড়ি। সনাতনী পদ্ধতিতে মেয়েদের মানুষ করতে চাইলেও, ছ’ নম্বর বাড়ির মেয়েদের স্বাধীনতার খোলা হাওয়া এসে প্রবেশ করেছিল পাঁচ নম্বরের চিকের ফাঁক দিয়ে। গান, পড়াশুনো, অভিনয়। যদিও সেই বাড়িতে থাকাকালীন হিন্দু পরিবারের আর দশজন অন্তঃপুরবাসিনীর মতোই জীবনযাত্রা ছিল সুনয়নীর। ১২ বছর বয়সে রামমোহন রায়ের দৌহিত্র রজনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে। বিয়ের পরেও সে যুগের ঠাকুরবাড়ির রীতি অনুসারে, বেশ কয়েক বছর তিনি স্বামী-সন্তান-সহ সেই বাড়ির একটি মহলের বাসিন্দা ছিলেন। এমনকী তাঁর বড় দুই মেয়ের বিয়েও হয়েছিল সেই বাড়ি থেকেই। খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার পর্যন্ত খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে, আর পর্দা-টানা পালকিতে বাড়ির বাইরে পা ফেললেও, মনে মনে কোথাও হারিয়ে যাওয়ার মানা ছিল না তাঁর।

বোনঝি প্রতিমা দেবী লিখছেন– ‘সনাতন প্রথা অনুসারেই তাঁকে চলতে হত, সংসারে যেমন সব সাধারণ গৃহিণীরা গৃহিণীপনা করে থাকেন। অসংখ্য ছেলেমেয়ে চাকরবাকরের বৃহৎ পরিবার, তারই মাঝখানে মাসীমা কোন্ দূরান্তরের মানুষ যেন!’ সবার মাঝে থেকেও একলা– তবু কর্তব্যে ত্রুটি নেই; সংসারে মন নেই– একথা বলতে পারবে না কেউ। মেয়েলি মজলিশে তাঁকে দেখা যেত চওড়া-পাড় শাড়ি পরে, নানা অলংকারে সেজে। ঠাকুরবাড়ির অন্য মেয়ে-বৌদের মতোই হাজিরা দিতেন সুনয়নী। যদিও সেইসব আড্ডা তাঁর মনকে বেঁধে রাখতে পারত না। পাঁচ নম্বর বাড়ির কোণের একটি ঘরে নিজের ‘আর্টের সৌধ’ রচনা করেছিলেন। স্বামী রজনীমোহন ছিলেন অ্যাটর্নি। সংসারের কাজ একাই সামলাতেন সুনয়নী। দিনের শেষে যখন দুপুরের ক্লান্ত আলো ছায়া ফেলত বারান্দার থামের ওপর, দক্ষিণের বারান্দায় বন্ধ হত শিল্পচর্চা– তখনই নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে শুরু হত তাঁর নিভৃত সাধনা। সামনের বারান্দায় শিশুদের সমবেত কলরব, বিচিত্র শব্দ। স্মৃতিকথায় প্রতিমা দেবী লিখছেন সেসব– ‘মাসীর দরজা সমানভাবেই বন্ধ থাকত। মাঝে মাঝে আমরা শুনতে পেতুম সেতারের ঝংকার। লোকারণ্য বাড়ি থেকে নিজেকে সরিয়ে আপন জগতে সঙ্গীত সাধনায় মগ্ন থাকতেন তিনি।’ কৌতূহলী বালক-বালিকারা বন্ধ দরজার নিষেধ অগ্রাহ্য করে উঁকিঝুঁকি দিলে, দেখা যেত– ইংরেজি ডিকশনারি খুলে পাঠে মগ্ন সুনয়নী। তাঁর শিল্পসাধনা ‘প্রহেলিকার মতো’ মনে হত ছোট্ট প্রতিমার কাছে। সবাই যখন দুপুরবেলায় বিশ্রাম করছে, তখন সেই একাগ্র সাধনা অবাক করত তাকে। বাড়ির আর দশজন মহিলার থেকে তিনি যে আলাদা– সেই শিশু বয়সেই অনুভব করেছিলেন প্রতিমা।

বেলা পড়ে আসে। অপরাহ্ণ বেলায় সাজগোজের সরঞ্জাম নিয়ে মেয়ে-বউদের সাজাতে আসতেন নাপতেনি। বিনুনি বেঁধে, নিত্যনতুন ছাঁদের খোঁপায় ফুল লাগিয়ে দিতেন। তারপর সন্ধেবেলায় ওপরের ঘরের জলসায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শোনাতেন সুনয়নী। আনন্দ করতেন সকলে মিলে। ছোট ছেলেরাও তাঁর গান শুনতে ভারী ভালোবাসত। কখনও আবার বাড়ির ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাটক অভিনয় করাতে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন।

প্রতিমা দেবী লিখছেন, ‘আস্তে আস্তে সেতারের তার ছেড়ে রংতুলি ধরলেন তিনি। তখন এই নির্জন দুপুরে অনেকটা সময় কাটতো ছবি এঁকে।’ ছবি আঁকার ব্যাপারে তাঁর সর্বপ্রধান উৎসাহদাতা ছিলেন রজনীমোহন। দক্ষিণের বারান্দায় অবন-গগনের হাত ধরে চলছে ভারতশিল্পের নবজন্ম উৎসব। ছাত্রদের আনাগোনা, ‘বিচিত্রা’ ক্লাবের হইহই। স্বাভাবিকভাবে সুনয়নীর শখ হল ছবি আঁকার। স্টেলা ক্রামরিশ লিখছেন, কাগজের ওপর লাল-কালোতে প্রান্তরেখা এঁকে নিয়ে তাতে রং চাপাতেন সুনয়নী। তারপর ছোট গামলার জলে বারবার চুবিয়ে বার করে আনতেন পছন্দমতো রং। অস্ট্রিয়ার শিল্প-ঐতিহাসিক স্টেলা ক্রামরিশ ছিলেন ভারততত্ত্ববিদ। তিনি সুনয়নীকে কাছ থেকে কাজ করতে দেখেছিলেন। তাঁর ছবিতে খুঁজে পেয়েছিলেন গ্রাম্য সারল্য-মাখা এক অনন্য শৈলীর সন্ধান, খুঁজে পেয়েছিলেন চিরন্তন ভারত-শিল্পের উত্তরাধিকার– অজন্তা থেকে শুরু করে আজও যা বয়ে চলেছে গ্রামের স্বশিক্ষিত মহিলাদের হাতে– পট, চালচিত্রের অলংকরণে, মাটির দেওয়ালে আঁকা ছবিতে কিংবা উৎসবের আলপনায়।

এই উত্তরাধিকারের সূত্র অবশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে বাড়ির আনাচে-কানাচে, ঘরের দেওয়ালে। সুনয়নীর ছোট পিসিমা কুমুদিনী। তাঁর ঘরে সাজানো থাকত কৃষ্ণনগরের পুতুল, ঠাকুরের আসনে ছিল নানা ঠাকুর-দেবতার মূর্তি। পাঁচ নম্বর বাড়ির বাসিন্দারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় ঠাকুরঘরে ছিল দেবদেবীর ছবিওয়ালা পট, দোল খেলার প্রচলন ছিল, ছিল রাস উৎসব। ফলে সুনয়নীর মনে সহজেই ধর্ম আর শিল্পের মেলবন্ধন ঘটেছিল।

ছোটবেলায় বোটে করে মা-বাবা-বোনের সঙ্গে কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর গিয়েছিলেন সুনয়নী। বলা বাহুল্য শান্তিপুরের ফেনী-বাতাসার স্বাদে মিলেছিল প্রথম স্বাধীনতার আস্বাদ, নৌকোর খোল-ভরা রংবেরঙের মাটির পুতুলের রঙে মিশে গিয়েছিল বেড়ানোর আনন্দ। সুনয়নীর বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো থাকত বিদেশি শিল্পীদের আঁকা ছবি, রবি বর্মার অয়েল-পেন্টিং। আরও পরে সেগুলো খুলে রেখে সাজানো হয়েছিল অনামা দেশি শিল্পীদের আঁকা। মন এবং চোখ খানিক এভাবেই তৈরি হয়েছিল সুনয়নীর। পাশাপাশি ছিল দক্ষিণের বারান্দায় চিত্রশিল্পের নতুন নতুন পরীক্ষানিরীক্ষার উতল হাওয়ার আহ্বান।

দাদাদের মধ্যে বিশেষত গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে ছবি নিয়ে গভীর আলোচনা হত সুনয়নীর। পরবর্তীকালে তিনি জোড়াসাঁকো বাড়ি ছেড়ে উঠে গেলেন বেনেপুকুরে নিজের বাড়িতে। যদিও এ বাড়িতে যাতায়াত ছিল নিয়মিত। বিশেষত বাড়ির মেয়ে-বৌদের নিয়ে নাটক করানোয় তাঁর প্রচুর উৎসাহ ছিল। তাঁদের দিয়ে করিয়েছিলেন ‘মৃণালিনী’ এবং ‘রত্নাবলী’ নাটক দু’টি, শিখিয়েছিলেন নাটকের গান। গগনেন্দ্রনাথের মেয়ে পূর্ণিমা দেবী লিখছেন, ‘ছোট পিসী নিজের বাড়িতে গিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করেন, একেবারে নিজস্ব ধারায়। মাঝে মাঝে বাবাকে দেখিয়ে নিয়ে যেতেন। দিনকতক অসিত হালদারের কাছে শিখেছিলেন।’

বেনেপুকুরের ‘জমকালো বাড়ি’র ‘সবচেয়ে সাধাসিধে’ এই মানুষটার ছবির মধ্যে ফুটে ওঠে তাঁর সরল মনের প্রতিচ্ছবি, উঠে আসে তাঁর দেখা প্রাত্যহিক জীবনের নানা চিত্র। সুনয়নী ছবি আঁকতেন মনের আনন্দে। ছবি ছিল তাঁর আত্মার আত্মীয়। একই কাগজের দু’ পিঠে দু’টি ছবি এঁকেছেন এমনটাও দেখা যায়। একবার– ছেলেরা তখন বিবাহিত, সংসারের দায়িত্ব বৌমাদের হাতে। চৌকির উপর তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে বসে, গৃহকর্মীদের পরিচালনা করতে করতে, সদ্য-আঁকা ছবিটিকে তরকারি কাটবার জলভরা গামলায় ডুবিয়ে ওয়াশ দিয়েছিলেন। স্মৃতিকথায় সেই দৃশ্য বর্ণনা করেছেন পৌত্র কিশোর চট্টোপাধ্যায়। এই সরলতা ওঁর ছবির মধ্যেও এসেছে।

গগনেন্দ্রনাথের পছন্দ হয়েছিল সুনয়নীর ছবির সরল-সুন্দর রীতি। ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে অবনীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেন ‘সার্টিফিকেট’ লিখে দেওয়ার জন্য। উত্তরে অবনীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেছিলেন সেই অমোঘ সত্য– ‘ও যে ধারায় ছবি আঁকছে তার জন্যে আমায় আর সার্টিফিকেট লিখে দিতে হবে না। পরে দেশের লোকের কাছ থেকে ও নিজেই সার্টিফিকেট আদায় করে নেবে।’

দীঘল চোখের ভাবময় দৃষ্টি সুনয়নীর ছবির নারীদের বিশিষ্ট করে তুলেছে। পটচিত্রের আদলে আঁকা হলেও তা অনেক বেশি জীবন্ত ও ভাবময়। শিল্পশাস্ত্রে মৎস্যচক্ষুর সাদৃশ্যে চোখ আঁকার কথা বলা হয়েছে। সুনয়নীর আঁকা চোখের মধ্যে যেন অতল জলের শান্তি সঞ্চারিত। কৃষ্ণের গোপিনী সেজে রাধাকে মন্ত্রণা দেওয়ার ছবিটি লক্ষণীয়– যেখানে কৃষ্ণের চাহনিতে দুষ্টুমিভরা কৌতুক ফুটে উঠেছে, তার ছায়া পড়েছে রাধার চোখে– দু’টি আঁখি মিলেছে অপর জোড়া আঁখির সঙ্গে, অব্যক্ত বাণী রূপ পেয়েছে রেখার বিভঙ্গে। একইভাবে ‘মিল্কমেইডস’ ছবিটিতে মাঝের মেয়েটির আড়চোখে তাকানো এবং ঠোঁটের ভাঁজে ফুটে উঠেছে তিন সখির গল্প করার মেজাজটি। আবার শ্রী হাতে নববধূর ছবিতে অলংকার-সজ্জা, খোঁপার মালায় রুচিশীল সাজের ছোঁয়া, হালকা হলুদ শাড়িকে ছাপিয়ে তার চোখের সামান্য উৎকণ্ঠিত, চকিত দৃষ্টি লক্ষণীয়। সবক্ষেত্রেই যে চোখ তাঁর শৈলীর অংশ হয়ে উঠেছে এমন নয়। আরেকটি ছবিতে, নীলাম্বরী শাড়ি পরে আনমনা মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে খোলা ছাদে– চোখ নয়, দাঁড়াবার ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে তার অন্তরের আকুলতা। এ ছবিতে ছাদের সামনের বাঁশগাছটি গুরুত্বপূর্ণ– চিনে ছবির সঙ্গে তাঁর স্বাভাবিক পরিচিতির প্রমাণ।

পটের ছবির সঙ্গে তাঁর ছবিকে তুলনা করা হয়ে থাকে। ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, কালীঘাট পটের ডৌল থাকলেও তাঁর বেশিরভাগ ছবিতেই তাঁর নিরীক্ষণ শক্তির ছাপ রয়েছে। অন্তঃপুরে থাকার ফলে মেয়েদের ভাবভঙ্গি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তাই চুলের মধ্যে দিয়ে আনমনে হাত চালানো, কিংবা একা বসে টিয়াপাখির সঙ্গে মনের কথা বলার মতো খুব সাধারণ মেয়েলি ভঙ্গি– মাত্র কয়েকটি রেখার সাহায্যে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। অনায়াস স্বাভাবিক চলন– হালকা রঙের বিন্যাস ও শারীরিক বিভঙ্গের যথার্থতায় চিত্রের মূলভাবটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কত কম রেখা বা রঙে কী গভীর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন। ওয়াশের আলোছায়ার রহস্যময় পরিমণ্ডল সেই ব্যঞ্জনার সহায়ক হয়েছে। পটচিত্রের চড়া রং বা কড়া লাইন নিতান্তই অনুপস্থিত সেখানে। বিশেষত কাপড়ের সূক্ষ্মতা বোঝাতে সাদা রঙের ব্যবহার তাঁর রং ব্যবহারে মুন্সিয়ানার পরিচয় বহন করে।

একটি ছবি, বিবাহের, যেখানে অল্পবয়সি দু’টি ছেলেমেয়ে মালাবদলের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে– হালকা হলুদ জমিতে সূক্ষ্ম রেখার সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা এই ছবিটির ভাব, গভীরতা, সেটিকে সেযুগের সমাজের দলিল করে তুলেছে। আরও দু’টি ছবি– একটি বালক, তার হাতে লজেন্স, ড্রয়িংয়ের দুর্বলতা থাকলেও, ছবিটিতে ভাবের অভাব নেই। আর অন্দরমহলে তিন মহিলার বিকিকিনির যে ছবিটি, ফেরিওয়ালার ঝুড়ি থেকে উঁকি মারছে দু’টি বোতল– সেখানে মহিলাদের মধ্যে দু’জন যে ক্ষুব্ধ সেই ভাবটুকু দিব্যি বোঝা যায়।

তাঁর ছবি সম্বন্ধে আলোচনায় বারবার একথা বলা হয় যে, খ্যাতনামা দুই শিল্পী-দাদার সঙ্গে তাঁর চিত্রশৈলীর কোনও মিল নেই। ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, প্রতিভা নিজস্ব আত্মপ্রকাশের পথ তৈরি করে আন্তর প্রেরণায়। তাই দু’জন চিত্রশিল্পীর শিল্পভাষা কখনওই এক হতে পারে না, যদি তাদের মধ্যে শিল্পপ্রতিভা থাকে। সারা জীবন পাশাপাশি বসে ছবি এঁকেও তো অবনীন্দ্রনাথ গগনেন্দ্রনাথ তৈরি করেছিলেন ভিন্ন ধারার শিল্পশৈলী।

সুনয়নীর ছবির একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে কৃষ্ণলীলা এবং নানা পৌরাণিক কাহিনির দৃশ্যরূপ। এইসব কাহিনি সে যুগের মেয়েদের যাপনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিল। সুনয়নীর মনের পর্দায় তারা ধরা দিয়েছে নতুন রূপে নতুন রঙে। তাঁর অধিকাংশ ছবিই, তাঁর কথায়– ‘স্বপ্নে পাওয়া’। সেসব স্বপ্নদৃশ্যকেই চিত্রপটে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। প্রতিমা দেবী লিখছেন, ‘তাঁর বাড়িতে গেলে বুঝতে পারতুম মাসী কোন্ জগতে বাস করেন। ঘরের প্রতি দেয়াল প্রতি কোণ পৌরাণিক বিষয়ের ছবিতে ভরা। টেকনিক ছিল তাঁর নিজের, ভাব ছিল তাঁর অন্তরের স্বপ্নজড়িত কল্পনার প্রতিরূপ।’ তাঁর কিছু কিছু পৌরাণিক চিত্র মনে করায় অজন্তার চিত্রাবলির সরল অথচ গতিময় রেখাশৈলীকে। ফিগারগুলির দীর্ঘায়িত গড়ন, অজন্তার ধরনে দীর্ঘায়িত আঙুল– যা না কি একসময় বেঙ্গল স্কুল ঘরানার পরিচায়ক হয়ে উঠেছিল। রাধাকৃষ্ণের যুগলমিলনের চিত্রটি বিশেষভাবে মনে পড়ে এই প্রসঙ্গে। অলংকারের চিত্রায়ন অনেকটাই আর্লি বেঙ্গল অয়েল পেন্টিং-এর কথা মনে করায়। এই ঘরানা, যাকে অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘দেশী ধরনের অয়েল পেন্টিং’, তার অজস্র নমুনা ছিল সুনয়নীর ঘরে। তবু শেষ অবধি ছবিতে উপস্থিত এক আশ্চর্য চিত্রমায়া আমাদের মুগ্ধ করে, সেই মায়া, যা অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে রেখেছিল গৃহদেবতা থেকে বাড়ির ছোট-বড় সব সদস্যকেই। ছবির প্রধান চরিত্ররা মূলত নারী– কখনও রাধা কখনও আরাধ্যা, লক্ষ্মী বা পার্বতী, কখনও নিতান্তই গৃহবধূ। পৌরাণিক চরিত্রগুলির সঙ্গে সাবলীলভাবে বুনে দেওয়া কাহিনির অনুষঙ্গ– ঘট হাতে লক্ষ্মী কিংবা মেঘের উপর বসা শিব-পার্বতী। নিজেই লিখেছিলেন, ‘স্বপ্নে ঈশ্বরের অনুরোধে আমি এঁকেছি মা ও শিশু, সরস্বতী, লক্ষ্মী, মহাদেব ও রাধাকৃষ্ণ’। অবনীন্দ্রনাথ একবার অনুযোগ করেছিলেন– ছবির মধ্যে একঘেয়েমির ভাব এসে যাচ্ছে। বাড়িতেই ছিল আস্তাবল, সেখানে দেখা ঘোড়ার ছবি আঁকলেন। নিজের খুব একটা পছন্দ হয়নি সেই ছবি, কিন্তু সেই ছবি, আমিনা করকে মনে করিয়েছিল মার্ক শাগালের ছবির কথা। ভারতীয় দেবদেবী ছাড়াও এঁকেছেন যিশুখ্রিস্টের ছবি– কী আশ্চর্য নিবেদনের ভঙ্গি তাতে। যদিও মুখের নিম্নাংশে ড্রয়িং এর দুর্বলতা প্রকট। তবু এ ছবিটি সেকালের বহুল প্রচলিত মিশনারিদের বিতরণ করা যিশুর ছাপানো ছবির কথা মনে করায়। পোশাকটি চিরাচরিত শৈলীতে আঁকা।

সংসারের মধ্যে থেকেও, যেমন বলেছেন প্রতিমা দেবী, সুনয়নীর ছিল এক বৈরাগী মন। সবার মধ্যে থাকলেও তাঁর আনন্দলোকের দ্বারের চাবিটি নিজের কাছেই গচ্ছিত রেখেছিলেন। বহু ছবি এঁকেছেন, অকাতরে বিলিয়েও দিয়েছেন। বেড়াতে গেলে উপহার হিসেবে নিয়ে যেতেন নিজের আঁকা ছবি। শ্যামলবাবু যখন তাঁর কর্তামাকে দেখেছেন, তখন আর বেনেপুকুরের দেওয়াল তাঁর আঁকা ছবিতে সুশোভিত নয়। পরে মা অমিতা দেবীর সংগ্রহ থেকে শ্যামলবাবু খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁকে উপহার দেওয়া দু’টি ছবি। সে দু’টির বর্ণনা রয়েছে তাঁর লেখায়। সুনয়নীর মেজো মেয়ে প্রভাতীর কন্যা ছিলেন অমিতা। প্রিয় নাতনিকে একটি ছোট ছবি দিয়েছিলেন সুনয়নী– ‘কৌটোর মাপে অর্ধেক হলুদ, অর্ধেক নীল রঙের এক গোল চাকতিতে তা আঁকা। হলুদে রাধা আর নীলে কৃষ্ণের প্রোফাইল। দুয়ের মধ্যে কোনো ফাঁক নেই। দুই প্রোফাইলের নাক মুখ ঠোট ভুরু সবই একে অপরকে অতিক্রম না করে মিলে গেছে যথাযথভাবে।’ এছাড়াও অমিতার সংগ্রহে ছিল ‘কার্ডবোর্ডের ফ্রেমে মাউন্ট করা’ আরেকটি ছবি– “তাতে হালকা নীল পটভূমিতে বাদামি রেখায় ছিল বংশীধারী কৃষ্ণের আবক্ষ প্রতিকৃতি। পিছনে হালকা হলুদ পটভূমি, রূপায়িত পূর্ণিমার চাঁদের আকারে। ছবির তলায় কর্তা-মা’র হস্তাক্ষরে লেখা দুটি নাম– ‘সুনয়নী’ আর ‘অমিতা’।”

প্রথমটি মনে করায় তাঁর ‘অর্ধনারীশ্বর’ ছবিটির কথা। হালকা গোলাপি পটভূমিতে গাঢ় হলুদ আর হালকা বাদামি রঙের বিন্যাসে এক দিব্যভাব ফুটে উঠেছে। এখানেও চোখ দু’টি লক্ষণীয়। মহেশ্বরের দৃষ্টি অর্ধনিমীলিত, আর পার্বতীর চোখ পূর্ণায়ত, করুণাঘন। আঙুলগুলি সুদীর্ঘ, অজন্তার ঘরানায় আঁকা। পার্বতীর মুকুট মনে করায় শুধু রঙের স্তর দিয়ে আঁকা জাপানি শৈলীকে। আর হাতে ধরা পদ্ম খানিকটা ‘ভারতমাতা’ ছবির নিচের দিকের প্রস্ফুটিত পদ্মগুলিকেও।


তবে তাঁর শ্রেষ্ঠ ছবিটি সম্ভবত তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি। নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী, কারণ– অন্তঃপুরের ঘেরাটোপে থাকা সে যুগের মেয়েরা কেন, আজকের মহিলা শিল্পীদের মধ্যেও কতজন আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন তা গবেষণার বিষয়। সুনয়নী তাঁর আত্মপ্রতিকৃতিতে ধরে রেখেছেন তাঁর সেই ব্যক্তিত্বময়ী সরল সুন্দর চেহারাটি। উদাস দু’ নয়নে তাঁর শিল্পী-মনের ছাপটি ধরা পড়ে। সংসারে থেকেও বৈরাগী। প্রতিমা দেবীর কথা মনে পড়ে যায়।

ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের অনেকেরই সূচিশিল্পে ঈর্ষণীয় নৈপুণ্য ছিল। সুনয়নীও সেই ধারার বাইরে নন। তাঁর সেলাইয়ের কাজও তাঁর ছবির মতোই– রং-রেখার বাহুল্যহীন, ভরাট কাজের বদলে জমির রং অক্ষুণ্ণ রেখে আউটলাইন-ভিত্তিক নকশা। অথচ চমৎকার ভাবময় উপস্থাপন, সূক্ষ্ম কারুকাজ। ছবির নিচে, সে যুগের রীতি অনুযায়ী সেলাই করে লেখা নিজের নাম।



‘প্রবাসী’ বা ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে তাঁর ছবি। ১৯০৮ ও ১৯১১ সালে দেশের মাটিতে প্রদর্শিতও হয়েছে। ১৯২২ সালের ওরিয়েন্টাল আর্ট সোসাইটির গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী– যেখানে দেখানো হয়েছিল এমিল নোল্ডে, পল ক্লি কিংবা কান্দিনস্কি-র ছবি– সেখানে ভারতীয় শিল্পীদের নামের তালিকায় তিনিও ছিলেন। ১৯২৩ সালে বার্লিনের ক্রাউন প্রিন্স প্যালেসের ন্যাশনাল গ্যালারিতে অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, এস এন দে কিংবা ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদারের পাশাপাশি তাঁর ছবিও প্রদর্শিত হয়েছিল। ফরাসি শিল্পী নোরা পার্সে কলকাতায় এসে সুনয়নীর ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে লন্ডনের এক প্রদর্শনীতে পাঠিয়েছিলেন তাঁর ছবি। স্টেলা ক্রামরিশ যে তাঁর ছবির স্বচ্ছ স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে তাঁকে ‘অজন্তা ও ভারতবর্ষের যথার্থ উত্তরাধিকারী আধুনিক শিল্পী’-র অভিধা দিয়েছিলেন।

কিন্তু সেসব গত শতকের কথা। শিল্পজগতে তাঁর অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন আজও হয়েছে কি? এখনও শিল্প-ইতিহাসের বইপত্রে তাঁর উল্লেখ থাকে কেবল ‘মহিলা-শিল্পী’ হিসেবে। পটশিল্পের শৈলী আত্মস্থকরণের জন্য যদি যামিনী রায় সাধুবাদ পান, তবে তা সুনয়নীরও খানিক প্রাপ্য। তিনি স্বশিক্ষিত, আর্ট স্কুলের ডিপ্লোমা তাঁর ছিল না। তবু দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শিল্পধারার সঙ্গে তাঁর যে বিলক্ষণ পরিচিতি ছিল, তা অনুমান করা যায়। আমৃত্যু দেশি-বিদেশি নানা পত্রিকা পড়তেন। ছবির নিজস্ব শৈলী তিনি বেছে নিয়েছিলেন সচেতনভাবেই। অন্তঃপুরবাসিনী হিসেবে নয়, সেই বয়ানে আত্মপ্রকাশ করা তাঁর মানসিক অবস্থিতির পক্ষে সুখকর ছিল বলে।

৩০ বছর বয়েসে স্বামীর প্রেরণায় শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তার পূর্ববর্তী ইতিহাস অজানা। যেমন অজানা ১৯৩৪ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর সহসাই ছবি আঁকা ছেড়ে দেওয়ার কারণ। সার্ধশতবর্ষের প্রান্তে দাঁড়িয়ে, আজ মনে হয়, নতুন করে তাঁর কাজ মূল্যায়ন করার দরকার রয়েছে। কোনও তকমা লাগিয়ে নয়– তাঁর সময়ের প্রেক্ষিতে, ভারত-শিল্পের আধুনিকতার বিবর্তনের প্রেক্ষিতে– মহিলা হিসেবে নয়, শিল্পী হিসেবে। তবেই হয়তো ঘুচবে স্বেচ্ছাবৃত ‘আবরণ’, মুছবে তাঁর যথার্থ পরিচিতির সংকট।
তথ্যসূত্র:
১. কিশোর চ্যাটার্জি, সুনয়নী দেবী/ আ পায়োনিয়ার অ্যামংস্ট ইন্ডিয়ান উইমেন পেইন্টার্স, অবনীন্দ্রনাথ টেগর ন্যাশনাল মেমরিয়াল লেকচার
২. আমিনা আহমেদ কর, সুনয়নী দেবী/ আ প্রিমিটিভ অফ দ্য বেঙ্গল স্কুল, ললিতকলা অ্যাকাডেমি
৩. দীপেশ চক্রবর্তী, প্রভিন্সিয়ালাইজিং ইউরোপ, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০১
৪. অপর্ণা রায় বালিগা, দ্য ওপেনিং অফ গৃহস/ আ ডিসকোর্স অ্যান্ড দ্য আর্ট প্র্যাকটিস অফ সুনয়নী
৫. প্রতিমা দেবী, স্মৃতিচিত্র, বিশ্বভারতী
৬. পূর্ণিমা ঠাকুর, ঠাকুরবাড়ির গগন ঠাকুর, রামায়ণী প্রকাশ ভবন
৭. শ্যামলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, না-চেনা উজানে, প্রতিভাস
৮. পার্থ মিটার, ইন সার্চ অফ মর্ডানিজম, অক্সফোর্ড
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved