
বর্ষা আসবেই না এই বছরটায় আর? কথাটা বিশ্বাসই করতে পারেনি দেবকুমার। কেমন যেন নাড়িয়ে দিয়েছিল তাকে। ঢুকে গেছিল তার মনের গভীরে। ঠিক এভাবেই শুরু হয়েছিল ‘হিম পড়ে গেল’। শ্যামল গঙ্গোপ্যাধ্যায়ের উপন্যাস। ফাঁকি দেওয়া বর্ষার দ্যোতনায়। আসন্ন শীতের ইঙ্গিতে।
দেশি বরবটি। হিমে ভেজা। ভাদ্রের মাঝামাঝি, চলে এসেছে বাজারে!
হিম! হিম পড়ে গেল! বদলে গেল মরশুম! অথচ, বর্ষাই তো হয়নি সে-বছর! নিঃশব্দে একটা ঋতু টপকে গেল পৃথিবী। চলে এল আসন্ন সময়ের আগাম খবর। শীত আসবে এরপর।
অবাক হয়েছিল দেবকুমার। সারা কলকাতার গায়ে যে তখনও ভেজা ধুলো! ভাড়াবাড়ির খোলা, লাল-মেঝের বারান্দাটা গোটা বছর ভিজলই না তেমন।
বর্ষা আসবেই না এই বছরটায় আর? কথাটা বিশ্বাসই করতে পারেনি দেবকুমার। কেমন যেন নাড়িয়ে দিয়েছিল তাকে। ঢুকে গেছিল তার মনের গভীরে।
ঠিক এভাবেই শুরু হয়েছিল ‘হিম পড়ে গেল’। শ্যামল গঙ্গোপ্যাধ্যায়ের উপন্যাস। ফাঁকি দেওয়া বর্ষার দ্যোতনায়। আসন্ন শীতের ইঙ্গিতে।

দুই ঋতু– বর্ষা আর শীত, ভিন্ন অভিধা নিয়ে আসে মানুষের অচেতনে, সংস্কৃতিতে। বর্ষা– ভুল শোধরানো। বর্ষায় সতেজ হয় ফসল। সবুজ হয় শুকনো গাছেরা। ধুয়ে মুছে যায় পৃথিবীর সব ধুলো। বর্ষাই প্রকৃতির সেকেন্ড চান্স। আর শীত? সে আসে ফসল কাটার পর। কুয়াশায় ঢেকে দিতে। আরও শুকিয়ে দিতে প্রকৃতিকে। অমোঘ যতিচিহ্নের মতো। নির্মম। নিষ্ঠুর।
হিম শীতের আগাম বার্তা। বৃষ্টির ঝুটো সংস্করণ। তৃষ্ণা মেটায় না। শুধু লেগে থাকে গায়ে গায়ে। ওপর-চালাকের মতো।
বর্ষা নেই, শুধু হিম
দেবকুমার বসু। ‘হিম পড়ে গেল’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। বেসরকারি সংস্থার মাঝারি চাকুরে। পারচেজ ডিপার্টমেন্টের কর্তা। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছেলে রাজু এখনও স্কুলে। স্ত্রী শেফালি গৃহবধূ।
সাধারণ ভাড়াবাড়ি। সংসার নয়, দেবকুমার তার নাম দিয়েছে ‘বসুজ ইটিং হাউজ’। পরিবার নয়, সবাই যেন বোর্ডার। সুখ নেই। আনন্দ নেই। উৎসাহ নেই কোনও। সব কিছুই যেন বাজারের ফর্দের মতো কেজো। মৃত বাবা-মায়ের ফটোতে দেওয়া মালা শুকিয়ে যাওয়ার পর বদলে ফেলার মতো– নিয়মমাফিক।
শেফালির প্রতি এখনও কি আর আকৃষ্ট হয় না দেবকুমার? হয়। কিন্তু সেখানেও প্রত্যাখানই জোটে। শেফালির সঙ্গে তার সম্পর্কটাও এখন সংসারের মতোই কেঠো। গতানুগতিক।
পারচেজেও আর থাকতে চায় না দেবকুমার। সে যেতে চায় জেনারেল ডিপার্টমেন্টে। কিন্তু সেখানেও বাধা। তোষামোদ করতে জানে না দেবকুমার। ফালতু খেজুর করে না কারও সঙ্গে। পারচেজে থেকেও সে খুব সৎ। অথচ সবাই চায় সে ঘুষ খাক। অফিসও। কারণ ঘুষ নিলে সাপ্লায়ারদের থেকে বেশি দামে জিনিস কেনা যাবে। আর তাহলে বেশি খরচ দেখিয়ে কাজের জন্য চাওয়া যাবে মোটা টাকাও। কলিগ অসিত সে-কথাই তাকে বোঝাতে এসেছিল বাড়ি বয়ে। কিন্তু তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল একগুঁয়ে দেবকুমার। টনটনিয়ে ওঠে তার মাথা। শব্দের পর শব্দ খেলা করে। কবিতা লেখে সে। ছন্দহীন, কোথাও না পৌঁছনো কয়েকটা পংক্তি। নেশাগ্রস্তের মতো। ‘পতন ও পত্তনে ইতিহাস সমান হাসে/ তাই– / পরাজিত রক্তের নাম পুঁজ।’
শেষ শীতে নিভে গেছে উত্তাপ
সেটা ছিল ফাল্গুনের রাত। শীতের শেষ দিক। সেই রাতেই শেফালির সঙ্গে শেষবার ঘনিষ্ঠ হয়েছিল দেবকুমার। সেদিন মশারিতে শহুরে জোৎস্না ব্লেড হয়ে ঢুকে পড়েছিল। রাত তিনটের পর, পূর্ণিমা তিথিতে, কলকাতার মধ্যে জেগে উঠেছিল আরেক কলকাতা। সেই নিশুতি রাতে ট্রামলাইনে জেগে উঠেছিল বনপথ। বেকারির চিমনি হয়ে গিয়েছিল নিমগাছ। আর শেফালি আরও একটা পুত্রসন্তান চেয়েছিল দেবকুমারের কাছে।
ট্রামলাইনে বনপথ থাকে না। বেকারির চিমনিও নিমগাছ নয়। শেষ শীতের গর্ভজাত সেই সন্তান তাই মুছেও গিয়েছিল গর্ভপাতে।

হিম পড়ে গেছে
অফিসের ভাত দিতে এসে ডালের বাটি পড়ে গেল স্ত্রী শেফালির হাত থেকে। হতভম্ব শেফালি। স্বামী দেবকুমার নাকি এক রাতেই বুড়ো হয়ে গেছে। গত রাতের কালো চুল এখন সাদা সব। পেকে গেছে গোঁফ। ফুলফুলো চোখের নিচের চামড়া। ঠিক বুড়োদের মতোই।
কথাটা বিশ্বাস করেনি দেবকুমার। এরকম হয় নাকি। যদিও সেদিন সকালে ছেলে রাজুও বলেছিল একই কথা। বাবা নাকি বুড়ো হয়ে গেছে এক রাতেই। রাজুকে চুপ করিয়ে দিয়েছিল দেবকুমার। শেফালির কথাতেও সে আমল দিল না। রেগেমেগে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।
বাসে উঠেও একই জিনিস। লোকে হঠাৎ বুড়ো ভাবছে তাকে। অফিসের লিফটম্যান চেয়ে রইল অবাক চোখে। কলিগরাও। কী হয়েছে দেবকুমারের? এক রাতেই সে যে বুড়ো হয়ে গিয়েছে!
দেবকুমারের রাগ হল খুব। বিরক্তিও। সে বুড়ো হয়নি মোটেও।
দেবকুমারের হঠাৎ বৃদ্ধত্বের পিছনে নিশ্চয় কোনও রোগ আছে। চিকিৎসা দরকার। এমনটাই সবাই বলল তাকে। কিন্তু দেবকুমার নিশ্চিত এই রোগ তার নয়। বরং সবার চোখে।
কিন্তু যতই অস্বীকার করুক সে, তার হঠাৎ বৃদ্ধত্ব নিয়ে নিশ্চিত সবাই। কখনও সে অনুকম্পার পাত্র। আবার কখনও হাসির খোরাক। এর মধ্যেই ছড়িয়ে গেল কথাটা। নিশ্চয় গুপ্তরোগ ছিল দেবকুমারের। ভেতরে লুকিয়ে ছিল এতদিন। এখন লাফিয়ে বেরিয়ে এসেছে।
শীতকে অগ্রাহ্য করা যায় না
সবাই যখন কোনও কিছুকে ঠিক বলে মেনে নেয়, যুক্তিগ্রাহ্য বলে মেনে নেয়, তখন সেটাকে অস্বীকার করার একটাই উপায় থাকে– তার নাম পাগলামো।
দেবকুমার ডুবে ছিল কবিতায়। শব্দেরা ফিরে ফিরে আসত তার কাছে। আর সেই শব্দগুলোকে সে লিখে রাখতে চাইত খাতায়। সেই সঙ্গে তার কাছে ফিরে আসত আরেকজন। সুকুমার দে সরকার। শিশুসাহিত্যিক। যাঁর লেখা সে পড়েছিল ছোটবেলায়। তার সঙ্গে তারই গল্পে পড়া আত্মঘাতী একটা হরিণ। তারপর একদিন পাগল বলে তাকে তাড়িয়ে দিল পাড়ার ছেলেরা। শেফালি তাকে খোঁজার চেষ্টা করেনি কোনও। কারণ শীতের বাতাসগুলো খুব ভয়ংকর। কোথাও কিছু নেই হঠাৎ দুটো বাড়ির মধ্যিখানে এই বাতাস এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সময় যখন শীতকাল
‘হিম পড়ে গেল’-এর প্রথম প্রকাশ ১৩৭১-এ। গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারে ১৯৬৪।
ছয়ের দশকের ঠিক মাঝামাঝি। কলকাতায় শুরু হয়েছে মেট্রোরেলের কাজ। খোঁড়াখুড়ি রাস্তাময়। খোঁড়াখুড়ি যেন সময়ের গায়েও। সবে সাবালক হব হব করছে নতুন স্বাধীনতা। অথচ আদর্শ রাষ্ট্রের ভাবনা ততদিনে অস্তমিত। বোধহয় কষ্ট-কল্পনাও। অস্থির হতে শুরু করে দিয়েছে সময়। এরপর সে আরও অস্থির হবে। হিংস্র হবে।
‘হিম পড়ে গেল’ রাজনৈতিক উপন্যাস নয়। অথচ তার নিগঢ়ে যে লুকিয়ে রয়েছে সেই বোধ। সেই হিংস্র সময়ের আভাস।

বর্ষার ‘সেকেন্ড চান্স’ আসা সম্ভব ছিল না। সোজা শীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আদ্যন্ত দেশটা।
সৎ দেবকুমার, ঘুষ নিতে রাজি না হওয়া দেবকুমারের ভেতর তখনও যেন বেঁচে আছে আগের সব বোধ। যা সময়ের চোখে কষ্ট-কল্পনা। তাই বাফার টাইম ছাড়াই সে রাতারাতি হয়েছিল প্রাচীন। বৃদ্ধ। বাতিল। সময় তাকে দেগে দিয়েছিল বৃদ্ধ বলে। ঠিক যেমন নিরুচ্চারে, মারধোর, হিংসা না করেই কারও/ কোনও কিছুর নির্দিষ্ট লেবেল সেঁটে নিজেকে জাহির করে ক্ষমতা। আর তাই লেবেলের সেই দাগ থেকে বাঁচতে গিয়ে, পাগলামো ছাড়া মুক্তির কোনও উপায় ছিল না তার। শুধু তাকে আচ্ছন্ন করেছিল শীতকাল।
সেই শীতই দেখতে পেয়েছিলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়।
………………….
রোববার.ইন-এ পড়ুন শমীক ঘোষ-এর অন্যান্য লেখা
………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved