
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘কফিন অথবা সুটকেশ’ বইয়ের শেষ কবিতা ‘তৈরি হও’ আর পরের বই ‘হিমযুগ’-এর প্রথম কবিতার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে শীত ঋতু। ‘তৈরি হও’ কবিতা শুরু হচ্ছে এইভাবে, ‘খুব দ্রুত শীত আরও কাবু করে ফেলবে তোমাকে…’ আর ‘হিমযুগ’ বইয়ের প্রথম কবিতায় আছে ‘ব্রিজের ওপর মাফলার জড়ানো সেই মাথা’। তবে ‘হিমযুগ’ এক অদ্ভুত কাব্যগ্রন্থ, চারপাশের সময় যেন কবিতার বাইরের খোলসে লেগে রইল না, বরং কোনও গোটা মানুষ যে প্রায় হারিয়ে গেল বুদ্ধদেবের এই পর্বের কবিতা থেকে, তার কারণ বোধহয় সেই সময়ের ফলশ্রুতি।
যতবার শীত আসে, বছর শেষ হওয়ার উপক্রম হয়, ততবার মনে হয়, ‘আসবে নতুন একটা বছর, সে তৈরি হয়,/ সে দরজা হবার কথা বলে, আগামী বছর/ চৌকো কাঠের ফ্রেমে ভারী পাল্লার মতো গম্ভীর হয়ে সে/ দাঁড়িয়ে থাকবে বারোমাস।’ এই কবিতার মধ্যে যে বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে, সেটা ১৯৭৬ সাল– অর্ধ-শতাব্দী আগের কথা। এর পরের বছর প্রকাশিত হয় বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের এই কাব্যগ্রন্থ ‘হিমযুগ’।

‘হিমযুগ’-এর কথায় পরে আসছি। আপাতত বেশ কয়েক বছর আগেকার এক স্মৃতিচারণার কথা বলি। তখন তাঁর যৌবনের শুরু। তিনি নিজেই বলছেন যে, যে-বয়সে লোকে প্রথম প্রেমে পড়ে, পাগলের মতো প্রেমে পড়ে কোনও নারীর, তখন তিনি কিন্তু ভয়ংকর রকম প্রেমে পড়েছিলেন সিনেমার। এই সময় তিনি যেতেন একজনের কাছে, যিনি ছিলেন একইরকম সিনেমা-পাগল। এদিকে বুদ্ধদেব সিনেমা বানাতে পারছেন না বলে মনখারাপ করে আছেন, আর এই কথাটাই বললেন তাঁকে। এক অদ্ভুত পরামর্শ দিয়েছিলেন সেই ভদ্রলোক। বলেছিলেন, মনে মনে সিনেমা তৈরি করুন। বাসে যেতে যেতে ভেবে নিন, তারপর কল্পনায় বানিয়ে ফেলুন। বুদ্ধদেবের শুধু মনে ধরেছিল বললে কম বলা হবে, তিনি নাকি রোজ এইভাবে তৈরি করে ফেলতেন নানা সিনেমা! আমার মনে হয়, তিনি যে এই পদ্ধতিতে শুধু সিনেমাই তৈরি করতেন তা নয়, হয়তো এই অভ্যেসের বশে লিখে ফেলতেন কবিতাও। তাঁর এই কথার সাক্ষ্য দিচ্ছে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কফিন কিংবা সুটকেশ’-এর ‘সিনেমা’ কবিতাটি: ‘পুরোনো পর্দায় ফুটে বেরুল পুরোনো/ রবারের রাস্তা–/ চেনা-লোকজনদের জন্য, তোমার রয়েছে এক বিশেষ পরিকল্পনা/ তুমি তাদের দেখতে চাও/ শুধু সিনেমার মধ্যে।’

ওই যে তাঁর দরজা হওয়ার কথা বলেন, কাঠের ফ্রেমে ভারী দরজা, বারোমাস আসলে সেই ফ্রেমের ভিতর ধরা পড়তে থাকে এক-একটা মুহূর্ত, হয়তো একটা ইমেজ, সেই একটা ইমেজের সূত্রে ক্রমেই একটা ঘটনা দানা বেঁধে উঠছে। যেমন, হয়তো তাঁর চোখে পড়েছিল, ইঁদুরের পিছনে বিড়ালের ছুটতে থাকা, আবার/ কিংবা বিড়ালের পিছনে কুকুরের। এই ছবির মধ্যে তিনি নিয়ে আসবেন মানুষকে, যে আবার চেন হাতে ছুটছে কুকুরের পিছনে। এইবার সম্পূর্ণ অন্য এক দৃশ্য। শান্ত আর নীল একটা ঘর। সেখানে চা ফুটছে, ডাইনিং টেবিলে ফুটে উঠছে কাপ-ডিশ, চামচ নাড়তে নাড়তে গান গায় কোনও এক মানুষী। তারপর গান ফুরিয়ে গেলে হঠাৎ সে যেন দৌড়ে যায় ছাদে। এইবার সেই মানুষীর ছাদে গিয়ে দেখার সঙ্গে মিলিয়ে বুদ্ধদেব মিলিয়ে দেন ইঁদুর, বিড়াল, কুকুর আর মানুষের ছোটাকে। তবে সেই মানুষীর দেখায় কিন্তু ছোটার ক্রম একেবারে উলটে যায় কবিতার শেষে:
দূর থেকে দেখতে পায়,– কুকুরের পেছনে
ছুটছে বেড়াল, বেড়ালের পেছনে ছুটছে ইঁদুর
আর তার মানুষ, ছুটতে ছুটতে
ঢুকে পড়ছে
আশ্চর্য এক ইঁদুরের গর্তে!
(ইঁদুর/হিমযুগ)
মোটামুটি বছর ১৬ বয়স থেকেই কবিতা লিখতে থাকেন তিনি এবং ১৯ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় প্রথম বই ‘গভীর এরিয়েলে’ (১৯৬৩)। পরের বই ‘কফিন অথবা সুটকেশ’ প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৭২ সালে এবং তৃতীয় বই ‘হিমযুগ’ বেরচ্ছে ১৯৭৭ সালে। সময়ের দিক থেকে তিনি ছয়ের দশকে শুরু করলেও তাঁর সত্তর জুড়ে রয়েছে বাকি দু’টি বই। সেই সময়ের তুমুল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সরাসরি ছায়া ফেলেছিল ‘কফিন অথবা সুটকেশ’-এর বেশ কয়েকটি কবিতায়। এই বইয়ের শেষ কবিতা ‘তৈরি হও’ আর পরের বই ‘হিমযুগ’-এর প্রথম কবিতার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে শীত ঋতু। ‘তৈরি হও’ কবিতা শুরু হচ্ছে এইভাবে, ‘খুব দ্রুত শীত আরও কাবু করে ফেলবে তোমাকে…’ আর ‘হিমযুগ’ বইয়ের প্রথম কবিতায় আছে ‘ব্রিজের ওপর মাফলার জড়ানো সেই মাথা’। তবে ‘হিমযুগ’ এক অদ্ভুত কাব্যগ্রন্থ, চারপাশের সময় যেন কবিতার বাইরের খোলসে লেগে রইল না, বরং কোনও গোটা মানুষ যে প্রায় হারিয়ে গেল বুদ্ধদেবের এই পর্বের কবিতা থেকে, তার কারণ বোধহয় সেই সময়ের ফলশ্রুতি। ‘হিমযুগ’ কাব্যগ্রন্থের শুধু সূচিপত্রের দিকে যদি চোখ রাখেন তাহলে দেখবেন মনুষ্যেতর প্রাণীর ভিড় সেখানে। ‘মাগুরমাছ’, ‘লাল-পিঁপড়ে’, ‘খচ্চর’, ‘টিকটিকি’র মতো প্রায় ১১টি কবিতা আছে। আর আছে সম্পূর্ণ অ-প্রাণীবাচক কবিতা। সেখানে ‘প্রেসার-কুকার’ থেকে ‘হ্যাঙ্গার’, ‘সাঁড়াশি’ থেকে ‘চামচ’– সবই তৎকালীন সময়ের যেন প্রতীকে পরিণত হচ্ছে। এখানে গোটা মানুষের পরিবর্তে আসছে দেহের বিভিন্ন টুকরোর কথা, একেবারে প্রাণহীন যেন এক-একটা বস্তু মাত্র।

এই বইয়ে হিমযুগ নামে কোনও কবিতা না থাকলেও ‘হাড়’ কবিতায় এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, ‘তারা ঝরে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে, পৃথিবী তেমনই আছে তো? নাকি এসেছে নতুন হিমযুগ?’ এই ‘নতুন হিমযুগ’ শব্দবন্ধটি খেয়াল করার মতো। এই পৃথিবী যখন ছিল বরফে মোড়া সেই প্রাকৃতিক হিমযুগে বিভিন্ন প্রাণী থাকলেও আধুনিক মানুষ বলতে আমরা যা বুঝি, তাদের অস্তিত্ব ছিল না। ছিল এই প্রজাতির আদিম মানুষ যারা মূলত শিকারী। এই হিমযুগই ফিরে এসেছে নতুন ভাবে, সেখানে বিভিন্ন সরীসৃপ, পতঙ্গের সঙ্গে যে মানুষ রয়েছে, সে যেন আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্স নয়, তার কিছু টুকরো অংশ। সাধারণ টিকটিকিও যেন ফিরে যেতে চাইছে হিমযুগের অতিকায় সরীসৃপের চেহারায়, আর শিকার করতে চাইছে পোকামাকড়েরও অধম মানুষকে:
দেখতে দেখতে ফুলে উঠছে শরীর, আজ
শেষ পর্যন্ত আমি হয়ে উঠতে পারলাম ভয়ংকর
সেই ডায়নোসারাস, যা হয়ে ওঠার জন্য
ছোট্টবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতে হয়েছে আমাকে।
(টিকটিকি)
এই বইয়ে দাঁত নিয়ে দুটো কবিতা আছে। দুটো কবিতাতেই মানুষকে কৌশলে সরিয়ে দিয়ে শুধু তার দাঁত ক্রিয়াশীল থাকে। একটি কবিতায় সে কামড় দেওয়ার জন্য আক্রমণোদ্যত, অন্যদিকে সে অসহায়, নিষ্ক্রিয় এবং নকল। দু’টি কবিতা থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি এখানে উদ্ধৃত করি:
… রাস্তা দিয়ে
ছোট দাঁতের পেছনে বড় দাঁত
ছুটে চলে,
শহর, শহরতলী, গ্রাম ছাড়িয়ে
কোটি কোটি দাঁত আরও কোটি কোটি
দাঁতের পেছনে ছুটে চলে–
(দাঁত)
…টেবিলের দু’পাশে
মুখোমুখি বসে থাকে চার পাটি দাঁত। খাবার-দাবার লক্ষ্য করে
তাদের, হঠাৎ
রাগে ঠক ঠক করে কেঁপে ওঠে দু’পাটি দাঁত, ভয়ে
ঠক ঠক করে কেঁপে ওঠে
অন্য দু’পাটি দাঁত। টেবিলের দু’পাশে মুখোমুখি বসে থাকে
চার পাটি মাড়ি।
(দাঁত – ২)
গদ্যের শরীরে সমর্পিত এক বিশেষ বাক্ভঙ্গিমা রপ্ত করেছিলেন বুদ্ধদেব এবং তাঁর তিন বন্ধু– ভাস্কর চক্রবর্তী, সুব্রত চক্রবর্তী আর শামসের আনোয়ার। একের পর এক ছবি সাজিয়ে গল্প নির্মাণ করতে করতে যেন অপরূপ এক মোচড়ে পাঠককে চমকে দিয়ে সমে এসে দাঁড়ায়। যেমন ধরুন কোনও কবিতা শুরু হল সাধারণ চেহারার কয়েকটি বাক্য সাজিয়ে, অথচ সেখানেই রয়েছে তথাকথিত ঔচিত্যের সমস্যা, বিবর্তনের উল্টো চলন। ব্যাঙ হয়ে যাচ্ছে ব্যাঙাচি, ছোট মাছ গিলে ফেলছে বড় মাছকে, মানুষের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে ছাগল। এইভাবে চলতে চলতে দেখালেন যে পৃথিবী ছোট হয়ে একটা চামড়ার বলে পরিণত হয়ে গেল আর সোঁ সোঁ করে এগিয়ে গেল ‘ফাঁকা একটা গোলপোস্টের দিকে’।
হিমযুগ প্রকাশিত হওয়ার পর এই ধরনটি এতটাই স্পষ্ট হয়ে গেল যে, বিভিন্ন তকমায় সেগুলোকে দেগে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা গেল। বুদ্ধদেব নিজে অবশ্য মেনে নিতে চাননি এইসব। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, “শুরু দু’-এক বছরের আড়ষ্টতা, প্রিয় কবিদের ছায়া আমাদের লেখালিখি থেকে সরে যাওয়ার পর, আমার সময়ের কয়েকজনের মতো আমিও নিজস্ব ভঙ্গি খুঁজে পেয়েছিলাম, পরে অনেক আলোচকই তাকে ‘Anti Poetry’ বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। এই ভাবেই লেখা হয়ে যেতে লাগল সেই সব।”

সাধারণত সাত দশকে যখন কোনও কবিতা লেখা হয় বা কোনও কবিতার বই প্রকাশিত হয়, সেখানে যতটা সরাসরি সময়ের চিহ্নগুলো থাকে, যতটা ‘সন্ত্রাসকালের বীর্য’, আর্ত স্বর থাকে, উত্তেজনা আর নিষ্ঠুরতার যত আয়োজন থাকে, বুদ্ধদেবের কবিতায় এইসব ছাপ তেমন ভাবে পড়েনি। বরং চারপাশের ভূতগ্রস্ত লোকগুলোর ওপর তাঁর নজর পড়েছে, তিনি খেয়াল করেছেন এই মানুষগুলো কখনও হাস্যকর রকমের গম্ভীর, কখনও হীনমন্যতায় ভোগা এবং স্বার্থপর, প্রতিবাদহীন, দুঃখী, ব্যর্থ আর দয়ালু। ‘ফলত তাঁর কবিতা আর্ত নয়, ক্ষুব্ধ; গভীর নয়, স্মার্ট; সরাসরি নয়, প্রতীক ও প্যাটার্নে অন্বিত। দ্রুত, উত্তেজিত, খোলামেলা ও উদ্ভট চিত্রে কীর্ণ তাঁর এই সময়ের কবিতা বলিষ্ঠতা, নতুনত্ব ও সাম্প্রতিকতার জন্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই আদৃত হয়েছিল।’ মণীন্দ্র গুপ্তের এই অল্প কথাতেই ধরা পড়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতার হৃদয়। তবে সবকিছুকেই প্রতীকায়িত করে ফেলার প্রবণতা অনেক সময় বক্তব্যকে ছাপিয়ে গেছে, মণীন্দ্র গুপ্তের এই অনুযোগও একেবারে উপেক্ষা করার মতো নয়।

খুব মনে হয়, হিমযুগের ভয়ংকর শীতের মধ্যে চুপ করে বসে, ঘুমহীন স্থবির আলস্যে তিনি দেখে চলেছেন অ-প্রাণী বা প্রাণীকুলকে, হয়তো ফসিল হয়ে যাবে কিছুকাল পরেই। শুধু কালি আর কলম অপেক্ষা করে আর ভাবে, কবে আসবে গ্রীষ্মকাল! তখন হয়তো শুকনো আর খরখরে চামড়া দেখে আঁতকে উঠবে পৃথিবীর মানুষ। বুদ্ধদেবের কবিতার এই খরখরে চেহারা আর সেই রেজর ধরা আঙুলের কথা ভেবে যখনই তাকাই তাঁর দিকে, দেখি তাঁর লেখা ‘কালি’ কবিতার শেষ পঙ্ক্তিকটি রয়ে গিয়েছে ক্রিয়াপদের সামান্য হেরফেরে:
সাদা কাগজের সামনে
ছোট্ট টেবিলের ওপর, গালে হাত দিয়ে
অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে কবি।
… রোববার.ইন-এ পড়ুন শীতলপাঠ-এর অন্যান্য লেখা …
সেবন্তী ঘোষ-এর লেখা: প্রেমেও ছিল কবিতার ক্লাস, শুরু হয়েছিল ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ দিয়ে
অভিরূপ মুখোপাধ্যায়-এর লেখা: শীতকালেই প্রথম বইয়ের জন্য কবিতালেখা, শীতকালেই সরে আসা কবিতা প্রকাশ থেকে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved