
প্রতিবেশী দেশে সদ্য এক মহাসংকটের মুহূর্ত, রাতের অন্ধকারে শিল্পের নিকেতনে গানের আলয়ে আছড়ে পড়া এক দুর্দমনীয় তাণ্ডবের খবর। তবে এ-ও জানি, ‘ছায়ানট’ আর সনজীদা খাতুন যেখানে ওতপ্রোত মিশে আছেন, সংগীতের সেই প্রতিষ্ঠানের ওপরে এহেন নির্মম আঘাত কাটিয়ে আবার উঠে দাঁড়াবে ‘ছায়ানট’। আবার উঠে দাঁড়াবে ‘উদীচী’র মতো প্রতিষ্ঠান।
শান্তিনিকেতন। সদ্য শুরু হয়েছে ৭ পৌষের উৎসব। অবন ঠাকুরের ওয়াশ-ছবির মতো আবছা কুয়াশা জড়ানো সকালে ছাতিমতলায় সংগীত আর মন্ত্রপাঠের মধ্যে দিয়ে যার সূচনা। নিজের মনেই প্রশ্ন করি, ‘উৎসব’ কাকে বলব? রবীন্দ্রনাথের কথায়– ‘উৎসব তো আমরা রচনা করতে পারি নে, যদি সুযোগ হয় তবে উৎসব আমরা আবিষ্কার করতে পারি।’ তাঁর মতে, ‘সত্য যেখানে সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায় সেইখানেই উৎসব।’ আর সেই প্রকাশ অনন্তকাল ধরে বয়ে চলেছে। ‘পাখি তো রোজই ভোর-রাত্রি থেকেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে তার সকাল-বেলাকার গীতোৎসবের নিত্য নিমন্ত্রণ রক্ষা করবার জন্যে। আর, প্রভাতের আনন্দ-সত্যটিকে সাজিয়ে তোলবার জন্য একটি অন্ধকার পুরুষ সমস্ত রাত্রি কত যে গোপন আয়োজন করে তার কি সীমা আছে!’ সে উৎসব তো নিত্যকার উৎসব, তাহলে প্রতিদিনের উৎসব ছাড়িয়ে ৭ পৌষ তারিখে উৎসবের বিশেষ মাহাত্ম্য কী? মাহাত্ম্য এই যে, সেদিন শান্তিনিকেতন আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের দীক্ষার দিন। যিনি একদিন ভোগের মাঝখান থেকে জেগে উঠে ‘বিলাসমন্দিরের সমস্ত আলোকে অন্ধকার’ দেখেছিলেন, বেড়িয়ে পড়েছিলেন অমৃত উৎসের সন্ধানে। তাঁর দীক্ষার পবিত্র দিন স্মরণ করে একদা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, শান্তিনিকেতনের ‘আশ্রমকে যেদিন সত্য করে দেখতে হবে সেদিন আনন্দের সংগীত বেজে উঠবে, ফুলের মালা দুলবে, সূর্যের কিরণ উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে– কারণ আনন্দের মধ্যে দিয়েই সত্যকে দেখা সম্ভব হয়, আর-কোনো ভাবে নয়।’ তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, আশ্রমের সত্য রূপটিকে প্রত্যক্ষ করার জন্য যে-দিনটিকে দেবেন্দ্রনাথ চিহ্নিত করেছেন, সে হল তাঁর দীক্ষার দিন। আলোকের মধ্যে, বাতাসের মধ্যে দীক্ষার মন্ত্রটিকে তিনি স্মরণ করতে বলেছেন। কী সেই মন্ত্র? সে মন্ত্র হল: ‘ইশাবাস্যমিদং সর্বং যৎকিঞ্চ জগতাং জগৎ।/ তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জিথাঃ মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম।’ অর্থাৎ ‘যে পরম ইচ্ছায় সমস্ত জগৎ বিধৃত ও চালিত, যে পরম ইচ্ছায় সূর্য চন্দ্র তারা নিয়মিত, এবং আকাশের অনন্ত আরতি-দীপের কোনওদিন নির্বাণ নাই, সেই পরম ইচ্ছার দ্বারা সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে আচ্ছন্ন ইহা উপলব্ধি করো।’ বলেছেন, ‘সব স্পন্দিত তাঁর ইচ্ছার কম্পনে, তাঁর আনন্দের বিদ্যুতে। সেই আনন্দকে দেখো। তিনি ত্যাগ করছেন তাই ভোগ করছি। তিনি ত্যাগ করছেন তাই জীবনের উৎস দশ দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, আনন্দের নদী শাখায় শাখায় বয়ে যাচ্ছে।… অজস্র ধারায় সেই জীবন, সেই আনন্দ, সেই প্রেম প্রবাহিত; ভোগ করো, আনন্দে ভোগ করো, পরিপূর্ণরূপে ভোগ করো। মা গৃধঃ। মনের ভিতরে কোনও কলুষ, কোনও লোভ না আসুক। পাপের, লোভের সকল বন্ধন মুক্ত হোক। এই তাঁর দীক্ষার মন্ত্র।’

মহর্ষির এই মন্ত্র একদা সৃষ্টি করেছে শান্তিনিকেতন আশ্রমকে, এই মন্ত্র আশ্রমের উদার প্রান্তর, তার পুণ্য সমীরণ আর নির্মল আলোকের মধ্যে দিয়ে সদা প্রবাহিত। প্রতিদিনের অজস্র কাজের ফাঁকে সেই মন্ত্র যদি কখনও বিস্মৃত হয়ে থাকি, তবে অন্তত যেন এই উৎসবের আনন্দলোকে সেই মন্ত্রটি আনত চিত্তে উপলব্ধি করতে পারি– সেজন্যে মনকে প্রস্তুত করতে বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছেন, ‘উদ্বোধিত হও, সত্যকে দেখো, জীবনকে উদ্বোধিত করো’।

আজ শতবর্ষ পার হয়ে মহর্ষির সে মন্ত্র, কবির সে আহ্বান আমাদের মনকে কতটুকু উদ্বোধিত করতে পারে! চারপাশের হিংসা লোভ ক্রোধ আর মিথ্যাচারের আবর্তে খড়কুটোর মতো ভেসে বেড়ানো আমাদের জীবনে, কোন সত্যকে আজ দেখব, কীভাবে উপলব্ধি করব? ভেবে দেখলে ভারি আশ্চর্য সেই শব্দ– ‘সত্য’। আমাদের কাছে সে যেন আজ অতিদূরের কোনও অলীক বর্ণমালায় সাজানো শব্দমাত্র, কেবল এক মায়া! ছোট্ট দু’টি অক্ষরে গাঁথা অমৃতময় আনন্দ-অনুভবে এমন শব্দের নিজস্ব মহিমা যথার্থভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম? না কি, সে আজ অভিধানের শক্ত মলাট দেওয়া প্রাচীরে বন্দি। এই তো সেদিন ‘পরম’ সত্যের কথা বলতে গিয়ে শান্তিনিকেতনের উপাসনাগৃহে আয়োজিত খ্রিস্টোৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘যে মহাপুরুষ তাঁর জীবনের মধ্যেই অমৃতলোকের পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর দ্বারা অমৃতরূপ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল, আজ তাঁর মৃত্যুর অন্তর্নিহিত সেই পরম সত্যটিকে যেন আমরা স্পষ্ট আকারে দেখতে পাই।’ বলেছেন, ‘আসল সত্য এই যে, আমার মধ্যে যিনি বড়ো, যিনি আমার হাতে চিরদিন দুঃখ পেয়ে আসছেন’, তিনি বলছেন, ‘জগতের সমস্ত পাপ আমাকেই মারে, কিন্তু আমাকে মারতে পারে না। আজ পর্যন্ত সব চেয়ে বড়ো চোর কি সব ধন হরণ করতে পেরেছে। মানুষের পরম সম্পদের কি ক্ষয় হল। বিশ্বাসঘাতক আছে, কিন্তু সংসারে বিশ্বাস মরে নি। হিংসক আছে, কিন্তু ক্ষমাকে সে মারতে পারলে না।’ রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘সেই বড়ো যিনি, তিনি তাঁর বেদনায় অমর। কিন্তু সেই ব্যথাই যদি চরম সত্য হত তা হলে কি রক্ষা ছিল। বড়োর মধ্যে আনন্দের অমৃত আছে বলেই তো বেদনা সহ্য হল।’ খ্রিস্টোৎসবের সান্ধ্য-উপাসনায় আজকেও গীত হয় সেই গান– ‘একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে/ রাজার দোহাই দিয়ে/ এ যুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি;/ মন্দিরে তারা এসেছে সাজি–..’। সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে ওঠে, ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ;/ ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ/ নূতন তব জন্ম লাগি কাতর যত প্রাণী/ কর ত্রাণ মহাত্রাণ, আন অমৃতবাণী,/ বিকশিত কর প্রেমপদ্ম চিরমধুনিষ্যন্দ…’। আজ উপাসনা মন্দিরের শ্বেতমর্মর চাতালে এ গান শুনতে শুনতে মনের মধ্যে যেন তীব্র ঝাঁকুনি অনুভূত হল, বহুশ্রুত এ গান আমাকে নতুন করে ঘা দিয়ে গেল। মনে করিয়ে দিল– প্রতিবেশী দেশে সদ্য এক মহাসংকটের মুহূর্ত, রাতের অন্ধকারে শিল্পের নিকেতনে গানের আলয়ে আছড়ে পড়া এক দুর্দমনীয় তাণ্ডবের খবর। তবে এ-ও জানি, ‘ছায়ানট’ আর সনজীদা খাতুন যেখানে ওতপ্রোত মিশে আছেন, সংগীতের সেই প্রতিষ্ঠানের ওপরে এহেন নির্মম আঘাত কাটিয়ে আবার উঠে দাঁড়াবে ‘ছায়ানট’। আবার উঠে দাঁড়াবে ‘উদীচী’র মতো প্রতিষ্ঠান।

সেদিন ‘ছায়ানট’-এর ধ্বংসলীলার উন্মত্ত ছবি দেখতে দেখতে বারবার মনে পড়ছিল সনজীদাদির সেই উজ্জ্বল প্রশান্তিমাখা হাসিমুখটি। শান্তিনিকেতনে কী নিবিড় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে দেখেছি তাঁকে। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কী গভীর অনুভব ছিল তাঁর! কী অদম্য পড়াশোনা! কেবল অসাধারণ গান গাওয়াই নয়, সংগীতের বাণীর অন্দরে প্রবেশ করতে কী গভীর অনুসন্ধিৎসা। তাঁর গ্রন্থ ‘ধ্বনি থেকে কবিতা’, রবীন্দ্রনাথের গান প্রসঙ্গে সে এক আশ্চর্য অবলোকন। মনে পড়ে, ‘গীতবিতান’ বা ‘স্বরবিতান’-এ মুদ্রিত বহু পরিচিত একটি গান কীভাবে মনকে নাড়িয়ে দিয়েছিল! ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’ গানটির শেষ অংশে যেখানে ‘মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন’ মুদ্রিত তা সংশয়াতুর করে সনজীদাকে। রবীন্দ্রনাথের সেই ‘সফল স্বপন’ শব্দচয়ন তাঁর মনে বারবার প্রশ্ন তুলে দিতে চায়। খোঁজ করেন শোভনলাল গাঙ্গুলীর কাছে, দ্বারস্থ হন পুলিনবিহারী সেনের। কিন্তু সদুত্তর মেলে না, পুলিনবিহারী বলেন আমরা তাই জানি, গুরুদেবের বইতে তাই ছেপেছি। অবশেষে শান্তিনিকেতনের এক আশ্রমিকের কাছে পাওয়া ‘স্বরবিতান’-এ তিনি যেন হঠাৎ পেয়ে যান এক টুকরো আলোর ফুলকি, চমকে উঠে সেখানে দেখেন অন্য পাঠ। আশ্চর্য সনজীদা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর আসে এই যে, ওটা হবে ‘সকল স্বপন’ যা কি না সনজীদা মনে মনে ভেবে আসছিলেন। হাতের লেখায় ‘ক’ আর ‘ফ’-এর চেহারার সাদৃশ্য ছাপার অক্ষরে আসার পথে এমন অঘটন ঘটিয়েছে। আর সেই প্রবীণ আশ্রমিকের স্বরবিতানে মুদ্রিত ছাপার অক্ষরের ‘ফ’ কে কেটে দিয়ে যিনি ‘ক’ লিখে দিয়েছেন তিনি আর কেউ নন, তিনি স্বয়ং ইন্দিরা দেবীচৌধুরানী। সনজীদার মনে যে প্রশ্ন জেগেছিল, সেদিন তার নিরসন ঘটেছিল এইভাবেই। এখন এমন মানুষের প্রাণের প্রতিষ্ঠানের ওপরে নেমে এসেছে নির্মম আঘাত। খবরের কাগজের পাতায়, ফেসবুকের দেওয়ালে ছায়ানটের ধ্বংসলীলার মধ্যে যখন তাঁর ছিন্নভিন্ন প্রতিকৃতি চোখে পড়ল, তখন চোখের সামনে ভেসে উঠলো সত্য অনুসন্ধানী, শিল্পী, গবেষক, সংগঠক, এক আপসহীন বিদ্রোহীর কোমলে-কঠোরে মাখান দীপ্ত মুখমণ্ডল– তিনি সনজীদা খাতুন। যিনি নিজেই এক প্রতিষ্ঠান। চারদিকে তাকিয়ে আজ আমাদের আবার নতুন করে রবীন্দ্রনাথের শব্দ ধার নিয়ে বলতে হবে, ‘ওরে চেতনা, তুই কোথায়! ওরে, উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved