
মানুষের থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে দেখি। অবিশ্বাস করতে দেখি। দুটো মেরু শুধু স্পষ্ট হতে দেখি প্রতিদিন। এক পৃথিবী বন্যতা মিশে রক্তে। বছর দশেক আগেও, যা ছিল চোখরাঙানি অথবা হুমকি সেগুলো আজ শরীর পেয়ে দাপাচ্ছে। রেপথ্রেট, জ্বালিয়ে দেব অথবা গোলি মারো সালো কো– সভ্যতার সহজাত। তাই মন্দির অথবা মসজিদ। হত্যা অথবা গুমখুন। দ্বেষ অথবা দ্বেষ।

এ-ই তবে আকাঙ্ক্ষিত স্বর্গের একখানি স্ক্রিনশট! ভক্তিরসে আপ্লুত সেই অমৃতকালের সন্ধান! এসেছে মোক্ষম এক মুহূর্ত: মহৎ এ মানবজাতি খ্যামটা নাচে বিভোর। তার এক হাতে পরোটা। অন্য হাতে পড়শির থ্যাঁতলানো মুণ্ডু। রক্ত পড়ছে। টপটপ। টপটপ। আর সর্বক্ষণ, সর্বস্থানে, তাকে ঘিরে ধরছে অযুত-নিযুত ক্যামেরা। মিনিটে মিনিটে উদ্দাম চিৎকার: ঐতিহাসিক মুহূর্ত! কেউ-বা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, কোনটা বেশি নরম আর তুলতুলে? মুণ্ডু? না পরোটা?

ফুরফুরে ‘ফেস্টিভ মুড’ বিগড়ে দিলাম মশাই? শুরুয়াতে আওড়ানো উচিত ছিল, ‘অদ্ভুত আঁধার’ কিংবা ‘হোয়্যার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ার্স গন’। নিশ্চিত ‘হ্যাশট্যাগ এস্থেটিক’ ভাইব পেতেন। কিন্তু মানুষগুলো সব কুকুর হয়ে যাচ্ছে আর কুকুরগুলো সব পোকা– তাই লিখব আমির শেখের কথা। ১৯ বছর। একজন পরিযায়ী শ্রমিক। রাজস্থান পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। যেহেতু আমিরের মাতৃভাষা বাংলা, অতএব বৈধ আধারকার্ড থাকা সত্ত্বেও সে ‘বাংলাদেশি’। যেন এমনই দস্তুর! তারপর শারীরিক নির্যাতন। তারপর বিএসএফ। তারপর একটা পেলোডার। আমিরকে জাস্ট ছুড়ে ফেলে বাংলাদেশে। নব্য-ভারত রাষ্ট্রের ভাষ্যে, আমির শেখ একজন অনুপ্রবেশকারী। খোঁয়াড়ের কীট। না-মানুষ। এই হিম হিম হাওয়ার অন্তরালে, আরও এক বদ হাওয়া বয়। যে হাওয়ার তোড়ে, ন’মাসের গর্ভবতী সোনালী খাতুন ও তাঁর আস্ত পরিবারের অস্তিত্ব মুছে দিয়েছে রাষ্ট্র। দেখতে পাচ্ছি, একটা অনন্ত নো ম্যান্স ল্যান্ড! কাতার দিয়ে মানুষ। গৃহহীন। দেশ নেই। অ-নাগরিক।

এহেন দৃশ্যে, আমারই সহ-নাগরিক মস্তি পায়। সে ভুলে যায় চাকরি-দুর্নীতি। সে ভুলে যায় এ-বঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়া সরকারি স্কুলের সংখ্যা, ৮০০০। সে ভুলে যায় দশ বছরের তামান্না খাতুনের একটা রক্তাক্ত শরীর। মৃত। বরং দুটো মিম আর তিনটে ইন্সটাগ্রাম রিল শেয়ার করার পরে বুক চাপড়ে বলে, আমি অ্যাপলিটিক্যাল!

দিনে দিনে বড়ই দীন হয়ে পড়লাম, হে পাঠক। অর্থনৈতিক দীনতা জোঁকের মতো আটকেই ছিল। তবু হালফিলে শোনা যাচ্ছে, আবিশ্বে বৃহত্তম অর্থনীতির পঞ্চম স্থানে, ভারত! জিডিপি বেড়েছে হু হু এবং আশ্চর্যরকম। প্রায় ৭.৫ শতাংশ। তবু দেখুন, বেকারত্ব ঘোচেনি। আমেরিকান এক ডলারের মূল্য, ভারতীয় মুদ্রায় ৯০ ছুঁইছুঁই। আসলে যে তথ্য সজ্ঞানে এড়িয়ে গিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার: দেশের জন্যসংখ্যার কেবলমাত্র ১ শতাংশ মানুষ, নিয়ন্ত্রণ করছে সর্বমোট জিডিপির ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ, গরিব আরও গরিব হয়েছে। এ পরিসংখ্যানের কচকচানি দীর্ঘ হলে, লেখাখানার মূল সুর বিস্তর সংখ্যামালায় ঢেকে যাবে। সমান্তরালে, সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে, রাজনৈতিকভাবে অথবা মুক্তচিন্তার পরিসরে কতখানি দীনতার হাঁ-মুখে ঢুকে গেলাম, সেইসবের খেই এতক্ষণে হারিয়ে ফেলতে বসেছি।

ওড়িশার একটি হাইওয়ের পাশে, লাল-সাদা টুপি বিক্রি হচ্ছিল ঢালাও। বড়দিন। সান্তা ক্লজ। ফ্রুটকেক। জিঙ্গল বেল– অকস্মাৎ কিছু গেরুয়া ধ্বজাধারী যুবক এসে বলছে, ভারত হিন্দুরাষ্ট্র। ক্রিসমাস পালন করা যাবে না। লাল-সাদা টুপির পরিবর্তে যদি চিকেন প্যাটিস হয়, তবুও দৃশ্য এক। অভিন্ন। ব্যাকগ্রাউন্ডে কেউ বা কারা যেন চিৎকার করে ওঠে: ঐতিহাসিক মুহূর্ত! এইবার পিটিয়ে মেরা ফেলা যাবে সহজেই। যেহেতু জনগণের সম্মতি আছে। যেহেতু অস্থায়ী শ্রমিক কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী একা এবং বিচ্ছিন্ন। পিটিয়ে মেরে ফেলা যায় সহজে। একচুয়ালি, এই একুশ শতকে সংখ্যালঘু মাত্রই হত্যার যোগ্য। কলকাতা শহরেই, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের দেওয়ালে পোস্টার পড়ে: ‘মুসলিম এবং কুকুরদের প্রবেশ নিষেধ’! চোখ বন্ধ করলে বাংলাদেশের নাগরিক, দীপু দাসের জ্বলন্ত শরীর বৃহৎ, আরও বৃহৎ আকার ধারণ করে ঝাঁপিয়ে আসতে চায়। পেট গুলিয়ে ওঠে অজান্তেই। হারমোনিয়াম ভেঙে, রবীন্দ্রনাথ ভেঙে, যে কোনও মানচিত্র ভেঙে আমরা খুঁড়ে এনেছি ঘেন্না। একেকবার স্ক্রোল করলে, ঘেন্না বেড়ে যায় দ্বিগুণ। যেভাবে স্মার্টফোনের অ্যালগোরিদম ভাবতে শিখিয়েছে, ঠুনকো হতে শিখিয়েছে, একবগগা হতে শিখিয়েছে, তা-ই হচ্ছি। তা-ই বিক্রি করছি ভার্চুয়ালি। ফরেন ট্রিপের স্বপ্ন দেখি ঘুমে। উদার উদার মন, সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে হে পাঠক, পালানোর পথ কই?


একুশ শতকে, আমরা বড় ধার্মিক অথবা ইনফ্লুয়েন্সার হয়েছি। অথবা একইসঙ্গে দুটোই হয়েছি। যেমন ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ তুলসী পুজো করো। তেমনই একজন মৌলবী সম্প্রতি বলছেন, ঈশ্বর হলেন নন-ফিজিক্যাল আর অতিলৌকিক কোনও সত্তা। তাই বিজ্ঞান, ঈশ্বরের অস্তিত্ব ব্যাখা করতে অক্ষম। অমনি সকলে দলে দলে, উল্লাসে মেতে, ইসলামে আসক্ত হতে চায়। অথচ এ কী ভীষণ মূর্খামি! ঈশ্বর যেহেতু জগৎ-স্রষ্টা, সে সদা করুণাময়। তবু প্যালেস্তাইনে শিশুহত্যার সংখ্যা ৫০০০০ কেন? ঈশ্বর কি রিল দেখতে মগ্ন ছিলেন সে-সময়? সামান্য প্রশ্ন মস্তিষ্কে ঘাই মারে না। টেলিভিশনের প্রাইম টাইমে এসে চিৎকার করে যুদ্ধোন্মাদ কেউ কেউ। তারপর বলে, আপনার পাশের বাড়িতে কোনও রোহিঙ্গা লুকিয়ে নেই তো?

মানুষের থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে দেখি। অবিশ্বাস করতে দেখি। দুটো মেরু শুধু স্পষ্ট হতে দেখি প্রতিদিন। এক পৃথিবী বন্যতা মিশে রক্তে। বছর দশেক আগেও, যা ছিল চোখ রাঙানি অথবা হুমকি সেগুলো আজ শরীর পেয়ে দাপাচ্ছে। রেপথ্রেট, জ্বালিয়ে দেব অথবা গোলি মারো সালো কো– সভ্যতার সহজাত। তাই মন্দির অথবা মসজিদ। হত্যা অথবা গুমখুন। দ্বেষ অথবা দ্বেষ। দেশের ধারণা ঘেঁটে-ঘ। চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞেস করি, মহৎ এ মানবজাতি সম্পর্কে পাঁচটি চমৎকার শব্দ বলো। বলে, প্রেম। সহিষ্ণুতা। তারপর বাফার করতে থাকে। এক সময় বলে, দয়া করে অন্য প্রশ্ন করুন। আমি উত্তর দিতে প্রস্তুত।
হঠাৎ জ্বলে ওঠে একটা বিলবোর্ড। প্রকাণ্ড কেকের বিজ্ঞাপন। হাজারে হাজারে হা-দরিদ্র এবং বিপুল ধনী– অপেক্ষা করছে। খুবলে খাবে ক্রিসমাসের কেক। তখন বল্গাহরিণের স্লেজগাড়িতে চেপে সান্তাক্লজ নেমে আসছিল ইহলোকে, শীতের ঘন অন্ধকারে, ঘুমের পাশে মোম-আলো জ্বলে উঠছিল কিছু ম্যাজিকাল। দুর্দশাগ্রস্থ আর হতাশ এ গ্রহের প্রতি বাড়িতেই ঝুলছিল মোজা। প্রকাণ্ড কেক থেকে নজর ঘুরে যায় তৎক্ষণাৎ। অথবা অবধারিত কেউ ঘুরিয়ে দেয় আর ভিড়িয়ে দেয় স্লেজগাড়ির উদ্দেশে। সান্তাক্লজকে ঘিরে ধরে সকলে উদ্দাম চিৎকার করে। ঐতিহাসিক মুহূর্ত! তুই বাংলাদেশি? জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেব! তারপর একটা বড়দিনের সূর্য ওঠে।
বড় দীনের সূর্য, পাঠক। চেয়ে দেখুন একটিবার।
…………………….
রোববার.ইন-এ পড়ুন রোদ্দুর মিত্র-র অন্যান্য লেখা
…………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved