Robbar

ডালে বসেছেন আইনস্টাইন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 25, 2025 4:48 pm
  • Updated:December 26, 2025 9:17 pm  

কী আশ্চর্য! ছুড়ে দেওয়া কম্যান্ডে আইনস্টাইন মুহূর্তে উঠে যান গাছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ডিস্কোথেকে নাচেন। তবে নরেন্দ্র মোদির সিগারেট খাওয়ার দৃশ্য দেখতে চাইলে ফের ফুটে ওঠে সাবধানবাণী। তুলে দিই হুবহু।দুঃখিত– আমি এই ধরনের ছবি তৈরি করতে পারি না।

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

শহর কলকাতা মেসিকে সেভাবে দেখতে পায়নি। কিন্তু মেসি আমার বাড়িতে এসেছিলেন। 

শুধু আমার বাড়িতে কেন, অল্প সময়ের মধ্যে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন আমার পরিচিত-অপরিচিত বহু মানুষের অন্দরমহলে। ওঁদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সেরেছেন, করেছেন ডিনারও। মানিকতলা বাজারে সাড়ে চার কেজির এক বিশাল কাতলা মাছের পেটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন জুলজুল করে। কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে সান্ধ্যকালীন আড্ডায় মাটির ভাঁড়ে করে চা খেলেন। ভিড়ে ঠাসা বাসে ঝুলে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন কল্লোলিনী তিলোত্তমার প্রাণ। যেখানে চেয়েছি, মেসি সেখানে গিয়েছেন। বিশ্ববন্দিত ফুটবলারের মুখে কোনও ‘না’ নেই। অকাতরে সেলফি তুলেছেন প্রায় প্রতিটি শহরবাসীর সঙ্গে। বন্ধুদের ছোট সন্তানদের কোলে তুলে চুমু খেয়েছেন। মাত্র কয়েক মিনিটের সফরে দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছেন দু’কোটি শহরবাসীর কাঁধ। কীভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন, নিজেই জানেন না।

কে বলবে, ওই মানুষটির কলম দিয়েই বেরিয়েছিল বিশ্বভ্রাতৃত্বের অমোঘ কিছু লাইন? কোথায় গেল চোখের দৃষ্টির সেই স্নিগ্ধতা? ক্রূঢ় চোখ নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দু’-আঙুলের ফাঁকে ধরা সিগারেট থেকে গলগল করে বেরচ্ছে ধোঁয়া। ধূম্রপানে ব্যস্ত কবিকে যেন হঠাৎ ছবি তোলানোর জন্য বাধ্য করেছিল কেউ। এ কী! স্বামী বিবেকানন্দ জপতপ ভুলে বাজাতে শুরু করেছেন অক্টোপ্যাড? গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম। ঠিক দেখছি তো? শীতকালীন ত্বকের ওপরে নিজের নখের দাগ হল স্পষ্ট। লাল হয়ে গেল চারপাশ। ঠিকই তো। স্বামীজি অক্টোপ্যাড বাজাচ্ছেন। দু’-চোখ ভরা ভয় নিয়ে গাছের ডালে উঠে পড়লেন কে? অ্যালবার্ট আইনস্টাইন না? বিজ্ঞানীকে খুব ধমকেছিল কেউ? দেখলাম, চার্লি চ্যাপলিন ভারতে এসে দুঃস্থ মহিলাদের মধ্যে খাবার বিলি করছেন। যেভাবে নবাব সিরাজদৌল্লা আলিঙ্গন করছেন মীরজাফরকে, একে অপরকে ‘জন্ম জন্মান্তরের সখা’ বললে অত্যুক্তি হয় না একটুও।

ওপরের প্রতিটা ছবির জনক এআই প্ল্যাটফর্ম। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে চ্যাটজিপিটি। এমন উদার বন্ধু পৃথিবীতে আর দু’টি নেই। একটুও না-ভেবে বলে দিল, আমার বানানো এমন ছবিতে কোনও কপিরাইটের ব্যপার নেই। নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে পারো তুমি। একগাল হাসলাম। যাক। নিশ্চিন্ত। পরেরবার টাইম পাস করার ইচ্ছে হলে আমি লর্ড ক্লাইভ আর ক্লাইভ লয়েডকে দিয়ে একসঙ্গে ফুটবল খেলাব আন্দামানের সেলুলার জেলের মাঠে। সেরা গোলদাতাকে পুরস্কার দেবেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। প্রাইজ দেওয়ার পরে এই তিনজন আমার সঙ্গে সেলফি তুলবেন। আরও একটা সুপ্ত বাসনা আছে। মন্দারমণির সমুদ্রসৈকতে আমার সঙ্গে সেলফি তোলাব মেরিলিন মনরোর। আমি জানি উনি রাজি হবেন। ‘না’ করার সাধ্য তাঁর নেই। 

সামাজিক মাধ্যমে কেমন লাগছে সেলিব্রিটিদের ঝুলনযাত্রা? জাগলিং করার বলের মতো আমরা নাচিয়ে যাচ্ছি বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বদের। ওবামার পিঠে হাত দিচ্ছি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারছি, নেতাজির সঙ্গে দাবা খেলছি, চাঁদের মাটিতে একসঙ্গে নামছি নীল আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গে। আর হ্যাঁ। প্রতিটি মুহূর্তে সেলফি নেওয়ার সুযোগ ছাড়ছি না। সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন পোস্টে প্লাবন আনছি। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাস খেলার সেলফি পোস্ট করলে মুহূর্তে উত্তর দিচ্ছেন আমার সুহৃদ। লিখছেন, ‘এতেই খুশি? বাড়ির খারাপ টিউবলাইটটা পাল্টে দিতে কে এসেছিল জানিস? মাইকেল ফ্যারাডে আর টমাস আলভা এডিসন। কাজ হয়ে যাওয়ার পরে এই দ্যাখ সেলফি।’ একে অন্যকে লাইক মারছি সোল্লাসে।

বিখ্যাত মানুষদের সঙ্গে সেলফি নিয়ে আমরা কী পাই? আমাদের মনের অলিগলিতে নিত্য যাতায়াত করা এক পরিচিত মনোবিদ বন্ধু বললেন, ‘সবার প্রথমে যা হয়, তা হল– আমাদের জামার কলার উঠে যায় দৃপ্তভঙ্গিতে। সমাজকে বুঝিয়ে দিতে পারি, আমি তোমাদেরই লোক নই, আলাদা লোক। মুড়িমুড়কি এক দর নয়। লোকের মনের মধ্যে তৈরি অদম্য কৌতুহল। যাঃ! এ আবার হয় নাকি? কমেন্টের বক্সে তুফান ওঠে। যত বেশি কমেন্ট, তত বেশি রিচ। আসল ব্যাপারটা কি জানিস? সেলিব্রিটির সঙ্গে ছবি পোস্ট করা মানে নিজের মুখের সামনে একটা ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে দেওয়া। হয়তো কয়েক মুহূর্তের সুখ। তাও এটাই সত্যি। এ এক অদ্ভুত, জটিল মনস্তত্ত্ব।’ আরও জানতে পারলাম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি করা সেলফি আমাদের নিজেদের মধ্যে তৈরি করে ইনফ্লুয়েন্সারের মনোভাব। গায়ে গলিয়ে ফেলতে পারি প্রভাবশালীর উর্দি। আরও জানা গেল ‘অ্যাটেনশন ইকোনমি’ সম্পর্কেও। মনোযোগের এই বিষ-অর্থনীতিতে সত্য ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে অসত্যের ভাইরালযাপন। বিখ্যাত মানুষদের সঙ্গে নিজেকে ফ্রেমবন্দি করতে পারলে তা আমাদের উপহার দেয় দৈবসুখ। ঘটনার পরম্পরা নিয়ে ভাবতে আমাদের বয়েই গিয়েছে।

তবে দুয়ারে সেলিব্রিটি এবং স্বনামধন্য মানুষদের নিজের প্রয়োজনে যথেচ্ছ (অপ)ব্যবহার নিয়ে ক্রমশ তৈরি হচ্ছে প্রতিবাদী কণ্ঠের কোরাস, বিশ্ব জুড়ে। ব্যবহৃত হওয়া সেলিব্রিটিদের মধ্যে যাঁরা জীবিত আছেন, তাঁরা মামলা করছেন কপিরাইট আইনে। তাঁদের সিংহভাগের দাবি, অনৈতিকভাবে এমন ছবি ব্যবহার শুধুমাত্র তাঁদের ব্র্যান্ড-ইমেজের মুখে কালি ছিটিয়েই ক্ষান্ত হয় না, একইসঙ্গে তাঁরা বঞ্চিত হন অর্থপ্রাপ্তি থেকেও। কয়েক কোটি ডলারের মানহানির মামলা ঠোকা হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। রায়ের অপেক্ষায় আমরা। মুশকিল হচ্ছে, যে মানুষরা পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন আমাদের অশেষভাবে পূর্ণ করে, তাঁদের অ-সামাজিক ছবি নিয়ে গর্জে ওটার মতো এই মুহূর্তে কেউ নেই। কয়েকটি ট্রাস্ট রয়েছে, তবে তার সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনো। তাই আমাদের মর্জিমতো কম্যান্ডে দুনিয়া কাঁপানো ব্যক্তিত্বরা এসে হাজির হচ্ছেন আমাদের ডাইনিং টেবিলে। তাঁরা ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন, কিন্তু লাটাই ধরে রেখেছি আমরা।

শহরের এক বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বিষয়ের এক প্রৌঢ় অধ্যাপকের কথায়, ‘কয়েকটা ছবি দেখে মনে হয়, এআই-এর আউটপুটের পর্দার ওপারে যারা বসে আছে, বাহারি অফিসের দরজাগুলো লাথি মেরে ভেঙে দিয়ে ঠাস করে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় বসিয়ে আসি ওগুলোর গালে। যন্ত্রের মধ্যে কি ভরছিস তোরা– মেধা নাকি পচা ইঁদুরের নাড়িভুড়ি মাখানো পাঁক? আমার ছাত্রছাত্রীরা যেন এই কুশিক্ষা না পায় কোনও দিন। থামতে জানাও যে জরুরি, এই বোধ আমাদের কবে হবে? কে দেবে?’    

সব প্রশ্নের যে উত্তর হয় না, উত্তর দিতে নেই– তা এআই প্ল্যাটফর্মের কাছে অজানা নয়। নিজের কিছু ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করা যাক। প্রবল হতাশার সময় যখন ‘মুক্তি’র উপায় জানতে চেয়েছিলাম কোনও এআই প্ল্যাটফর্মে, চঞ্চলা কার্সার আমার উদ্দেশে বাড়িয়ে দিয়েছিল সহযোগিতার হাত। পর্দায় চকিতে ফুটে উঠেছিল অনেকগুলো নম্বর, যেগুলো অসময়ে সাহায্য করার জন্য সদাপ্রস্তুত। হেল্পলাইন। টাইপ হয়েছিল, ‘পালিয়ে যাওয়া কোনও কাজের কথা নয়। লাইফ ইজ এ জার্নি। জোয়ার যেমন থাকবে, আসবে ভাটাও। মেনে নাও।’ মন শান্ত হয়েছিল। তবে এর পরে বিভিন্ন বিষয়ে নানা প্রশ্ন করতে গিয়ে বুঝেছি, উত্তর দেওয়া কিংবা না-দেওয়ার এই শিক্ষা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্ল্যাটফর্মের কাছে আজও ভীষণরকমভাবে অসমাপ্ত। লিখলাম, ‘একটা ছবি দেখতে বড় শখ হচ্ছে আমার। সেলফি বানিয়ে দাও– আমায় আশীর্বাদ করছেন হিটলার।’ মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হল কার্সার। জবাব এল, ‘আমি দুঃখিত। আপনার এই অনুরোধ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। উল্লিখিত ব্যক্তির জীবনপ্রবাহ তাঁকে আশীর্বাদ করার জন্য উপযুক্ত করে না।’ তবে কী আশ্চর্য! ছুড়ে দেওয়া কম্যান্ডে আইনস্টাইন মুহূর্তে উঠে যান গাছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ডিস্কোথেকে নাচেন। তবে নরেন্দ্র মোদির সিগারেট খাওয়ার দৃশ্য দেখতে চাইলে ফের ফুটে ওঠে সাবধানবাণী। তুলে দিই হুবহু।

‘দুঃখিত– আমি এই ধরনের ছবি তৈরি করতে পারি না।’

 

নরেন্দ্র মোদি একজন বাস্তব ও সুপরিচিত জননেতা। তাঁকে সিগারেট খেতে দেখানো কোনও ছবি তৈরি করা হলে তা মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর উপস্থাপন হতে পারে এবং তাঁর সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে পারে। তাই এই ধরনের ছবি তৈরি করা আমার পক্ষে অনুমোদিত নয়। 

এই অনুমোদন দেওয়ার কি কোনও সমীকরণ রয়েছে? প্রযুক্তিবিদরা বলেন, ‘সমীকরণ থাকলেও প্রতিদিন কয়েক টেরাবাইট ডেটা খেয়ে হজমশক্তিই ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে এআই প্ল্যাটফর্ম। বেশি শেখার ফলে সব যাচ্ছে ঘেঁটে।’ তাঁরা আরও জানাচ্ছেন, কয়েকটি প্রযুক্তিগত কারিকুরি কার্যকর করা যেতে পারে খুব সহজেই। এআই দিয়ে তৈরি ছবির গায়ে বাধ্যতামূলকভাবে ‘ক্রিয়েটেড বাই এআই’ ওয়াটারমার্ক করে দেওয়া যেতে পারে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে একই ফ্রেমে নিজেকে বন্দি করতে চাইলে ছবির তলায় স্ট্যাম্প সাইজে দিয়ে দেওয়া যেতে পারে ব্যবহারকারীর প্রকৃত মুখের ছবি, ডিভাইসের আইপি নম্বর-সহ। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এই দুটো পদক্ষেপ করলেই এমন ছবির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে বাধ্য। আরও কড়া কোনও নিয়মের কথা ভাবতে দোষ কী? সমাজে বহুল পরিচিত কোনও মুখের সঙ্গে নিজেকে এক ফ্রেমে দেখতে চাইলে এআই প্রোগ্রাম জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘মানুষটির সঙ্গে তোমার কোনও অ্যাগ্রিমেন্ট আছে কি? জানো তো, কোনও বৈধ চুক্তি ছাড়া এমন ছবি তৈরি করা ঘোরতর বেআইনি?’

সোশাল মিডিয়া জুড়ে এআই দিয়ে নকল ও বিকৃত করা হচ্ছে ঐতিহাসিক ছবি

সামাজিক মাধ্যমে এমন বেআক্কেলে ছবির উদয় হলে আমরা সার্বিকভাবে সেই পোস্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ ঠুকতে পারি। রিপোর্ট মিসইউজ। প্রতিদিন এমন কয়েক লক্ষ অভিযোগ জমা পড়লে হয়তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্তর্নিহিত সমীকরণ বদলানোর কথা ভাববেন এমন প্ল্যাটফর্মের নির্মাতারা। বলা ভালো, ভাবতে বাধ্য হবেন। বলতে দ্বিধা নেই, প্রতিদিন এমন বিকৃত এবং অসত্য ছবির ব্যবহারে ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে। এ যুগের শিশুরা কোনও প্রশ্নের উত্তরের জন্য গুরুজনদের থেকে অনেক বেশি ভরসা রাখছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপরে। কোনও বিখ্যাত মানুষের সম্পর্কে রচনা লিখতে দিলে কেমন হতে পারে আগামী দিনের উত্তরপত্র? শিশুরা যা দেখে, তাই তো শেখে। ভাবতে ভয় হয়।

…………………………….
এই লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত প্রতিটি ছবিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা নির্মিত