
কেবল অদূর-ভবিষ্যতের এক ‘ডিস্টোপিয়ান’ কলকাতা নয়, সমকালকেও ছুঁয়ে থাকছে এই নগর-কথা; দু’ পক্ষের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে একদিকে যেমন দারিদ্র, অনাহার, কালোবাজারি, এমনকী ‘ইমিগ্রেশন’-এর মতো প্রত্যক্ষ বিষয় জড়িয়ে, অন্যদিকে সুবিধাভোগী আর সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির মধ্যে সামাজিক-রাজনৈতিক অন্বয় অথবা একদেশদর্শী সামাজিক ন্যায়ের মতো বিষয়ও উঠে আসতে পারে।
প্রকৃতি-পরিবেশ যে ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে অর্জিত ভারসাম্য, জীব-জীবন-জীবিকার ওপর বিশ্বজোড়া উষ্ণায়নের দূরপ্রসারী প্রভাব, সেই নিয়ে চর্চা, তর্জা অব্যাহতই রয়েছে, তবে এই পরিণাম সম্পর্কে আমাদের উদাসীন দূরত্বও কম নয়। যখন কোনও ‘ক্লাইমেট ফিকশন’ আখ্যানের পরিসরে পরিবেশ-বিপর্যয়ের প্রশ্নকে আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে জুড়ে নিয়ে, এর অন্তর্লগ্ন সত্যগুলি ছুঁয়ে যেতে থাকে, তার তীব্র পাঠ-প্রতিক্রিয়া যেন আমাদের বন্ধ চোখ খুলে দেয়, দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের নিজেদেরই অমোঘ বিপন্নতার সামনে। মেঘা মজুমদারের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘এ গার্ডিয়ান অ্যান্ড এ থিফ’ পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, এই তরুণ লেখক ‘ফিউচারিস্টিক’ এক কলকাতার পটভূমি নির্মাণ করে, বিশেষ করে নগরজীবন, নাগরিক, আরও ব্যাপ্ত অর্থে, নগরসভ্যতার উপর আবহাওয়া-বদলের প্রভাবকে একটি কেন্দ্রীয় প্রশ্ন করে তোলেননি শুধু, তিনি মানবিক আবেগ, বিশ্বাস এমনকী নৈতিকতার প্রশ্নের সঙ্গে একে জুড়ে দিয়ে একটি জরুরি ভাষ্য তৈরি করলেন। তীব্র কালসচেতন এই উপন্যাস আমাদের দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে আসন্ন একটি প্রকাণ্ড নিরালম্বতার দিকে, আর আমরা প্রায় কেঁপে উঠি নিজেদেরই নিয়তি-দর্শনে।

দু’টি বিচ্ছিন্ন পরিবার, ঘটনাচক্রে নিজেদের দুঃসময় আর ভবিতব্য জুড়ে নিচ্ছে, আর এর সবটার পটভূমি সেই এক (আসন্ন-ভবিষ্যতের) কলকাতা, যেখানে পর্যায়ক্রমে প্রবল বৃষ্টি আর প্রখর গরমে তেতে-ওঠা শহর নাগরিকের জীবন করে রেখেছে ত্রস্ত। এই-যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ব্যাপ্ত অর্থে ‘ইকলজিকাল ক্রাইসিস’, এর সঙ্গে অবধারিতভাবে যুক্ত হয়েছে অনাহার; শহরে খোলা হয়েছে ‘শেলটার’, ঘর-হারানো, অভুক্ত মানুষের ভিড় নিয়ে। লেখক একদিকে যখন চিনিয়ে দিচ্ছেন ভগ্নদশা শহর, জনজীবন, অন্যদিকে তখন দু’টি পরিবারকে মিলিয়ে দিচ্ছেন এইভাবে, যে ‘গার্ডিয়ান’ আর ‘থিফ’ এই শব্দদু’টিই শেষ পর্যন্ত খুলে দেবে নানা স্তরে ব্যঞ্জনা পরতে পরতে, আর জড়িয়েও নেবে নগর আর নাগরিকের সংশয়-দীর্ণ মূল্যবোধের প্রশ্ন, আমূল বদলে-যাওয়া পরিস্থিতির সাপেক্ষে। মা-দাদু-মিষ্টিকে নিয়ে প্রথম পরিবার, শহর-জোড়া বিপর্যয়ের থেকে বাঁচতে অ্যামেরিকার মিশিগানে (মিষ্টির বাবার কাছে) নতুন বসতি শুরুর জন্য উৎকণ্ঠ অপেক্ষায়, আর মাত্র সাতদিন বাকি, তবে তার মধ্যেই ঘটে যায় অঘটন, যাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনায়, আতঙ্কে যেন একটি রুদ্ধশ্বাস থ্রিলারের আদল গড়ে উঠছে। সামাজিক শ্রেণী অথবা পরিস্থিতির বিচারে, প্রায়-বিপরীত দুই চরিত্র মা আর বুম্বা, তবে যে রাতে অনাহারে ক্লিষ্ট, দরিদ্র, গ্রাম-থেকে-আসা বুম্বা মায়ের বাড়ি থেকে চুরি করে নেয় তাঁর ‘ইমিগ্রেশন ডকুমেন্টস’, সেই রাত দু’জনকেই ক্রমশ ঠেলে দেবে গাঢ়তর অনিশ্চয়তায়; দুই পরিবারকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে লেখক নৈরাজ্যের নগরের নতুন পাঠ তৈরি করে নিচ্ছেন। মা শিশুকন্যার ভবিষ্যৎ দেখে যেতে চান সুরক্ষিত, যে কোনও মূল্যে, বুম্বাও গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে আসবে তার প্রিয় পরিবার; দু’ পক্ষই সুদিনের দুর্মর অপেক্ষায়। দাদুর চরিত্রটি সৌজন্য-বন্ধুতায় ঘেরা চেনা কলকাতা খুঁজছে এখনও– অনাহত নগর-বিবেক যেন তিনি।
একদিকে কঠিন অনিশ্চয়তা, উৎকণ্ঠা আর অনাহারের ভয় (জঞ্জালে মায়ের হারানো পাসপোর্ট-খোঁজা তার একটি রূপক হয়ে রইল), অন্যদিকে নীতি, আইন আর মানবতার প্রশ্ন ক্রমে জড়িয়ে যাচ্ছে একটি জটিল সমীকরণে। প্রথমে পিতৃশোক, পরে ফ্লাইট বাতিল হওয়াতে মায়ের স্বপ্ন থাকছে অধরা, আবার এর মধ্যেই বুম্বা তাঁর পৈতৃক বাড়ি দখল নেয় সপরিবার, পুনর্দখলের মরিয়া চেষ্টায় তাঁর হিংস্র প্রত্যাঘাত। এই-যে স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের দোলাচল, আত্মস্বার্থে উন্মত্ত অপরিণামদর্শিতা, এই পরিস্থিতির ভিতরে দাঁড়িয়ে মা আর বুম্বা, দু’জনেই পর্যায়-ক্রমে, অথবা একই সঙ্গে, হয়ে উঠছেন স্নেহশীল ‘অভিভাবক’ আর শুভচেতনা-বর্জিত ‘তস্কর’, দুই ‘বিপরীত’-এর মধ্যরেখা আবছা করে দিয়ে। এই ভূমিকা-বদলই সম্ভব করে তুলছে একরকম ‘সাবভারশন’– পূর্বনির্ধারিত ন্যায়-অন্যায় অথবা সততার মানদণ্ড এখন প্রশ্নের মুখে, ক্রমশ বদলাতে-থাকা সমাজ-পরিবেশের সাপেক্ষে, পূর্বধারণা ভাঙছে, গুলিয়ে যাচ্ছে ‘ভালো-মন্দ’-এর প্রচলিত ভাষ্য, বদলাচ্ছে সম্পর্কের সমীকরণও।
কেবল অদূর-ভবিষ্যতের এক ‘ডিস্টোপিয়ান’ কলকাতা নয়, সমকালকেও ছুঁয়ে থাকছে এই নগর-কথা; দু’ পক্ষের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে একদিকে যেমন দারিদ্র, অনাহার, কালোবাজারি, এমনকী ‘ইমিগ্রেশন’-এর মতো প্রত্যক্ষ বিষয় জড়িয়ে, অন্যদিকে সুবিধাভোগী আর সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির মধ্যে সামাজিক-রাজনৈতিক অন্বয় অথবা একদেশদর্শী সামাজিক ন্যায়ের মতো বিষয়ও উঠে আসতে পারে। ‘বিলিওনেয়ার’ চরিত্রটিও বহুমাত্রিক– তিনি অনাহারী মানুষের জন্য অন্নসংস্থান করেন প্রায় ‘যক্ষপুরী’-র মতো তাঁর রহস্যে-ঘেরা আবাস থেকে, আবার তাঁর ব্যক্তিগত বৈভব উসকে দিচ্ছে অসম বণ্টনের আর্থ-সামাজিক প্রশ্ন। প্রায় অদৃশ্য নিয়ন্তার মতোই এই চরিত্রের উপস্থিতি– তাঁরই আয়োজিত এক ‘ফীস্ট’ উপলক্ষে বুভুক্ষু বুম্বা উপস্থিত, মিষ্টিকে ‘কিডন্যাপ’ করে সঙ্গে নিয়ে, আর এই ঘটনা মায়ের প্রত্যাঘাতে দিয়েছে ইন্ধন, পরিণামে তাঁর মৃত্যুও হল ত্বরান্বিত। উপন্যাসটির পরিসর জুড়ে এইভাবে উঠে আসছে নগর-চৈতন্যের বহুস্বর, পরস্পর-বিরোধী অথচ সমান্তরাল।
লেখক দেখছেন স্বার্থরক্ষার টানাপোড়েনে দীর্ণ নগর-জীবন, দেখছেন প্রতিদিনের জীবনে টিকে থাকবার অবিরত সংগ্রাম এক স্তরে ব্যক্তিগত, অন্য স্তরে সামগ্রিক, আবার অবিশ্বাস, বিদ্বেষ, সংঘাতের মধ্যেও থেকে যাচ্ছে অনাহত চেতনা। একদিকে মিষ্টির উপস্থিতিই যোগ করে দেয় স্নিগ্ধতা, যেন বিপন্নতার উপশম, অন্যদিকে মাতৃহীন মিষ্টি যে বুম্বার হাত ধরে নেয় শেষে, সে কেবল সম্পর্কের, নির্ভরতার নতুন এক সমীকরণই নয়, আমরা তারই মধ্যে পড়ে নিতে পারি শোধনের আশ্বাসও। যেন উচ্চারিত হল, ত্রাস থেকে ত্রাণের সম্ভাবনা অকম্পিত, ‘আরো বেঁধে-বেঁধে’ থাকবার উদ্যোগ নিঃশেষ নয়। ভয় আর ভরসা, সংশয় আর ভালোবাসার সহাবস্থান নিয়ে উপন্যাসের এই কলকাতা কেবল এক ভূখণ্ড নয়, সজীব চরিত্র হয়ে উঠল। মেঘার গদ্য নিয়ন্ত্রিত শব্দের ব্যবহার নিয়ে সংহত, অভিঘাতে তীক্ষ্ণ, তবে অন্তর্লীন সন্দীপ্ত আবেগ চিনে নিতে পাঠকের ভুল হয় না।
A Guardian And A Thief
Megha Majumdar
Penguin Random House, India, 2025
699/-
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved