ধর্ম বিষয়টি কিন্তু খাপখোলা তরবারি– চাইলে শাসকের অভিপ্রায়কে খণ্ডন করার জন্য ব্যবহার করা যায় ধর্মের অস্ত্রাগার। ‘রক্তকরবী’ নাটকে তাই করেছিল বিশু। বলেছিল গোঁসাইকে, ‘গোঁসাইজি এদের কূর্ম-অবতার বললেন, কিন্তু শাস্ত্রমতে অবতারের বদল হয়। কূর্ম হঠাৎ বরাহ হয়ে ওঠে, বর্মের বদলে বেরিয়ে পড়ে দন্ত, ধৈর্যের বদলে গোঁ।’ জনগণ খেপে উঠলে হাতের কাছে যে-যা অস্ত্র পেল, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে অপশাসকের ওপর, তাকেই বলা হয় জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব। বরাহ অবতারের মাধ্যমে সে-কথাই বলতে চেয়েছে সে। ধর্মের অস্ত্রাগার থেকে খুঁজে নিয়েছে উপযুক্ত উপমা।
ধর্মের ভেক। চেনা শব্দ। ‘বেড়াল তপস্বী’, ‘বক ধার্মিক’ এই শব্দবন্ধগুলি যেমন নেতিবাচক, ‘ধর্মের ভেক’ও তেমন নেতিবাচক শব্দ। রাষ্ট্র ও প্রশাসন অনেক সময় ধর্মের ভেকধারীদের ব্যবহার করে, উদ্দেশ্য কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখা। রাষ্ট্রপোষিত ধর্মের প্রচারকরা জনসমাজে মিশে যান। ধর্মীয় উপমা ব্যবহার করে শাসকের স্বার্থ বজায় রাখেন। রবীন্দ্ররচনায় এর সেরা উদাহরণ নাটক ‘রক্তকরবী’। একজন সেখানে দুই ভূমিকায়– কখনও সর্দার হয়ে চাবুক হাতে খনিমজুরদের শোষণ করছে, কখনও গোঁসাই সেজে জপমালা হাতে মজুরদের কায়েমি স্বার্থের পক্ষে থাকার জন্য ধর্মের শান্তিবুলি কপচাচ্ছে। একালের কবি একদা ক্রুদ্ধ শ্লেষে লিখেছিলেন, ‘শান্তির মরা লিঙ্গ চুষতে আমরা বাধ্য।’ এও তেমন।
একই রশি থেকে চাবুক আর জপমালা দুই তৈরি। খনিমজুরদের স্থির ও শান্ত রাখার জন্য কী বলেছে গোঁসাই? বলেছে, ‘আহা, এরা তো স্বয়ং কূর্ম-অবতার। বোঝার নীচে নিজেকে চাপা দিয়েছে বলেই সংসারটা টিকে আছে। ভাবলে শরীর পুলকিত হয়।’ কথা বলার পদ্ধতি আর ভঙ্গি দুই খুবই চেনা। ক্ষমতার আধিপত্য বজায় রাখার জন্য সাধারণ মানুষের সম্মতি আদায় করার এ রাজনীতিবিদ ও ধর্মধ্বজীদের চেনা বাক্কৌশল। মুখের কথায় সাধারণ মানুষকে মিষ্টি করে ভোলাতে হলে তাকে প্রয়োজন মতো বড়ো করে তুলতে হয়। তুমি তোমরা সব অবতার! এখানেও গোঁসাই তাই করছে। খনিমজুরদের ‘কূর্ম-অবতার’ বলেছে। এ-চেনা বাক্বিভূতিতে এ-কালের রাজনীতিবিদ্দের অনেকেই চূড়ান্ত সিদ্ধি লাভে তৎপর– নিজেদের স্বার্থের কথাকে জনগণের মনের কথার মোড়কে সম্প্রচারের কী সুন্দর ব্যবস্থা!
ধর্ম বিষয়টি কিন্তু খাপখোলা তরবারি– চাইলে শাসকের অভিপ্রায়কে খণ্ডন করার জন্য ব্যবহার করা যায় ধর্মের অস্ত্রাগার। ‘রক্তকরবী’ নাটকে তাই করেছিল বিশু। বলেছিল গোঁসাইকে, ‘গোঁসাইজি এদের কূর্ম-অবতার বললেন, কিন্তু শাস্ত্রমতে অবতারের বদল হয়। কূর্ম হঠাৎ বরাহ হয়ে ওঠে, বর্মের বদলে বেরিয়ে পড়ে দন্ত, ধৈর্যের বদলে গোঁ।’ জনগণ খেপে উঠলে হাতের কাছে যে-যা অস্ত্র পেল, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে অপশাসকের ওপর, তাকেই বলা হয় জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব। বরাহ অবতারের মাধ্যমে সে-কথাই বলতে চেয়েছে সে। ধর্মের অস্ত্রাগার থেকে খুঁজে নিয়েছে উপযুক্ত উপমা।
রাজধর্ম কিম্বা শাসকের ধর্ম যখন অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায় তখন ধর্মের অস্ত্রাগার থেকে উপযুক্ত অস্ত্র নিয়ে বিপ্লব সাধনকারী যে চরিত্রটি রবীন্দ্র-নাটকে ফিরে-ফিরে আসে তার নাম ধনঞ্জয় বৈরাগী। ‘মুক্তধারা’ নাটকের এই চরিত্রটি প্রায় একই ভূমিকায় ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে রয়েছে। রাজা প্রতাপাদিত্য অপশাসক। নিজের উদার পুত্রের রাজনৈতিক কাজকর্মে অসন্তুষ্ট। মন্ত্রীকে বলছেন, ‘সেই বেটাই যত নষ্টের গোড়া। ধর্মের ভেক ধরে সেই তো যত প্রজাকে নাচিয়ে তোলে। সেই তো প্রজাদের পরামর্শ দিয়ে খাজনা বন্ধ করিয়েছে। উদয়কে বলেছিলুম যেমন করে হোক তাকে আচ্ছা করে শাসন করে দিতে। কিন্তু উদয়কে জান তো? এদিকে তার না আছে তেজ, না আছে পৌরুষ, কিন্তু একগুঁয়েমির অন্ত নেই। ধনঞ্জয়কে শাসন দূরে থাক তাকে আস্পর্ধা দিয়ে বাড়িয়ে তুলেছে। এবারে তার কন্ঠিসুদ্ধ কন্ঠ চেপে ধরতে হচ্ছে, তার পরে দেখা যাবে তোমার মাধবপুরের প্রজাদের কতবড়ো বুকের পাটা!’
রাজার এই সংলাপে দু’টি শব্দবন্ধ কানে লাগে। ‘ধর্মের ভেক’ আর ‘এবার তার কণ্ঠিসুদ্ধ চেপে ধরতে হচ্ছে’। এভাবেই এ-ভাষাতেই তো বিশুরা, ‘রক্তকরবী’ নাটকে গোঁসাইকে আক্রমণ করতে চায়। এখানে রাজা ধনঞ্জয়কে আক্রমণ করতে চাইছেন। অথচ গোঁসাই আর ধনঞ্জয়ের কত পার্থক্য। একজন অন্যায়ের পক্ষে, অন্যজন ন্যায়ের পক্ষে। দু’জনের হাতেই ধর্মাস্ত্র! গোঁসাই ধর্মের নামে আফিম সরবরাহ করে। তার কথা ওপর থেকে নেমে আসা বাণী– সেই বাণীতে মজে সবাই রাষ্ট্রের নিয়মমতে চলুক এই তার অভিপ্রায়। ধনঞ্জয়ের ধর্ম কিন্তু আফিমের মতো জনগণকে মজিয়ে রাখতে চায় না, তার ধর্ম জাগিয়ে তুলতে চায়। এমনকী সাধারণ মানুষেরা মজতে চাইলে ধনঞ্জয় তার বিরোধিতা করে। সে প্রসঙ্গ আছে ‘মুক্তধারা’ নাটকে।
‘২। তোমাকেই আমরা বুঝি, কথা তোমার নাই বা বুঝলুম।
ধনঞ্জয়। তা হলেই সর্বনাশ হয়েছে।
গণেশ। কথা বুঝতে সময় লাগে, সে তর সয় না; তোমাকে বুঝে নিয়েছি, তাতেই সকাল-সকাল তরে যাব।
ধনঞ্জয়। তার পরে বিকেল যখন হবে? তখন দেখবি কূলের কাছে তরী এসে ডুবেছে। যে কথাটা পাকা, সেটাকে ভিতর থেকে পাকা করে না যদি বুঝিস তো মজবি।’
ধর্মযাজকের ওপর ভরসা করে নিজেদের বুদ্ধি সাধারণ মানুষ বন্ধক রাখতে চান, আফিম-পরিবেশনকারী রাষ্ট্রীয়ধর্ম ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ বজায় রাখে। জনতোষণের সুযোগ ছাড়ে না। মার্কসের ভাষায় এই হল ‘Religion is the opium of the people’। ধনঞ্জয় সে কথাই বলেছে, ‘পাকা করে না যদি বুঝিস তো মজবি।’
প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থান্ধ ধর্মের বিরুদ্ধে যদি লড়তে হয় তাহলে এই পরিপ্রশ্নের অধিকার যে ধর্ম দেয় সেই ধর্মের কাছে যেতে হবে। নানা-ভাষার ও নানা-ধর্মের এই দেশে ধর্ম যে চমৎকার অস্ত্রাগার, সে কথা রবীন্দ্রনাথ অস্বীকার করেননি। একালে অবশ্য ধর্মবাদীদের উগ্রতার বিপক্ষতা করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শিবিরে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তা কিন্তু পরিপ্রশ্নের অধিকারে সাধারণকে জাগিয়ে তোলার প্রতিক্রিয়া নয়। তা জনমতকে তোষণ করারই পদ্ধতি। ধনঞ্জয়কে গণেশ বলেছিল, ‘তোমাকে বুঝে নিয়েছি, তাতেই সকাল-সকাল তরে যাব।’ এই আলস্যময় সুবিধেবাদী বাসনাকে ধনঞ্জয় প্রশ্রয় দেয়নি। একেলে উগ্র-ধর্মান্ধতাবিরোধী দলগুলি তুলনামূলকভাবে সহনীয়-ধর্মান্ধতার পালে হাওয়া লাগিয়ে ভোট পাওয়ার জন্য তৎপর। এ যেন কড়া আফিম আর ছিটেগুলি দুয়ের লীলা। একদল কড়া আফিম বিলোচ্ছে, অন্যদল ছিটেগুলি বিলোচ্ছে। দুদলের উদ্দেশ্য একই, মজিয়ে রাখা। জয় আফিমতন্ত্রের জয়! জয় ছিটেগুলিতন্ত্রের জয়!