শহরের রাস্তায়, খেয়াল করলে আকছার দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রজাতির কুকুর হারা-উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ করে দেখতে পেলে একটু আশ্চর্য হচ্ছি বইকি! কারণ এই শৌখিন প্রজাতিদের সচরাচর বাড়ির ড্রয়িং রুম বা বেড রুমেই দেখা যায়। কিংবা পাহাড়িয়া রাস্তায়। খুদে আদুরে প্রাণগুলো রাস্তার পরিবেশের সঙ্গে সে অর্থে মানানসই নয়। ‘স্ট্রে’দের সঙ্গেও বন্ধুতা হয়নি।
Martha, my dear
You have always been my inspiration
Please, be good to me
Martha, my love
Don’t forget me
Martha, my dear
‘You have always been my inspiration’. তুমি সবসময় আমার অনুপ্রেরণা হয়ে থেকেছ। বক্তা: পল ম্যাককার্ট্নি। ‘বিটল্স’-এর চার নক্ষত্রের অন্যতম। আর মার্থা? না, তাঁর প্রেমিকা নয়, অথচ প্রেম ছেড়ে আর কী-ই বা বলা যেতে পারে এমন রসায়নকে, যেখানে কেউ কারও দ্বারা এমন প্রগাঢ় অনুপ্রাণিত হয়? এমনই সেই অনুপ্রেরণা যার দোয়াত চুইয়ে বেরিয়ে আসে একটা আস্ত গান! মার্থা। পল-এর পোষ্য। ওল্ড ইংলিশ শিপডগ প্রজাতির একটি কুকুর। তাকে হারিয়ে, তার বিরহে পলের থরথর হাত দিয়ে বেরিয়েছিল এই গান– ‘মার্থা মাই ডিয়ার’। পল তো বটেই, ‘বিটল্স’-এর একাধিক ছবিতে ঘুরেফিরে এসেছে লোমশ মার্থা। পল স্বীকারও করতেন, চারপেয়ে পোষ্য নয়, বন্ধু হিসাবেই মার্থা রয়ে গিয়েছে তাঁর জীবনে।
সহমর্মিতা, ভালোবাসা, নিবেদন ও সংযোগের কোন স্তর অতিক্রম করলে পোষ্যর প্রতি মানুষ অনুপ্রাণিত হয়, তার আভাস পল আমাদের দিয়েছেন। আর সেই আভাসে ভেসেছি বলেই বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়, শখ করে পোষ্য বাড়ি এনে শখ ফুরলে তাকে হারা-উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেওয়া যায়!
কোথাও দেখা যাচ্ছে পাগ এবং বক্সার প্রজাতির একটি কুকুর বাঁধা ল্যাম্পপোস্টে। রোদ-ঝড়-জল-বৃষ্টিতে হারিয়েছে এমনকী, শব্দ করার শেষ ক্ষমতাটুকুও। মলত্যাগ করে চলেছে অনবরত। তাকে উদ্ধার করা হলেও এবং তার মলত্যাগের প্রবণতা পরবর্তীতে কমলেও বাঁচানো যায়নি পুচকে প্রাণটিকে। বৃষ্টি-বাজের আওয়াজের ভয় তার রয়েই গিয়েছিল। তাই ‘শেল্টার’ পেলেও এক বছরের মাথায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে শব্দপ্রাবল্য সহ্য করতে না-পেরে মারা যায় সে। কোথাও আবার চার-পাঁচ মাসের একটি বিগল্ রাস্তায় আরও একটি পোষ্য বিগল্-কে দেখে পিছু ধাওয়া করেছে। আশা, ওই পোষ্যটির মতোই তারও পুনরায় ঠাঁই হবে কোনও বাড়িতে। কোনও আরামদায়ক কোলের ওমে আবারও সেঁধিয়ে যাবে সে। একজন তাড়িয়ে দিলে কী হবে, কোনও না কোনও সহৃদয় ফের আগলে নেবে। কিন্তু সদর পর্যন্ত যেতে না যেতেই মুখের ওপর দরজা বন্ধ! কুঁই কুঁই করতে করতে ফিরে আসে সে। ঘুরে বেড়ায় রাস্তায়। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ-ই পথ ও পাথেয়।
শহরের রাস্তায়, খেয়াল করলে আকছার দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রজাতির কুকুর হারা-উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ করে দেখতে পেলে একটু আশ্চর্য হচ্ছি বইকি! কারণ এই শৌখিন প্রজাতিদের সচরাচর বাড়ির ড্রয়িং রুম বা বেড রুমেই দেখা যায়। কিংবা পাহাড়িয়া রাস্তায়। খুদে আদুরে প্রাণগুলো রাস্তার পরিবেশের সঙ্গে সে অর্থে মানানসই নয়। ‘স্ট্রে’দের সঙ্গেও বন্ধুতা হয়নি। তাদের থেকে বরং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই চলছে। অথচ বুঝে উঠতে পারছে না কোথায় যাচ্ছে, কী করছে। পথচারীদের দেওয়া এক-আধলা বিস্কুটও খাচ্ছে অথবা খাচ্ছে না। জুলু জুলু তাকিয়ে থাকা দুটো চোখ। নির্নিমিখ। বলতে চাওয়া অথচ না-পারা করুণ মুখ। বুকের ভেতর বাজতে থাকা আর্তি। কেউ অক্ষত। কারও বা হাত-পা ভাঙা। বা কোনও শারীরিক ত্রুটিযুক্ত। কাউকে অবৈধভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল প্রজননের কারণে। অনেকের অবস্থা আবার মরো-মরো।
আরও পড়ুন: যমরাজ পুজোর ছুটি পেতে পারেন শুধু কলকাতা পুলিশের সৌজন্যেই
পশুচিকিৎসক, পশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও পশু অধিকার কর্মীরা জানাচ্ছেন, করোনাকালীন অবসাদ কাটাতে অনেকেই বাড়িতে কুকুর রাখতে শুরু করেছিলেন। একাকিত্বের দোসর হয়ে কাঙ্ক্ষিত ‘সার্ভিস’ দিয়েছিল তারা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর সময়ের অভাব, তাদের সামলানোর ধকল ও খরচে কুলিয়ে না ওঠায় সেই ‘সভ্য’রা তাদের রাস্তায় ছেড়ে দিচ্ছে। চলতি বছরে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে।
স্বার্থ ফুরলেই জন-জামাই-ভাগনা যেখানে কেউ আপনা নয়, সেখানে পোষ্যদের প্রতি আলাদা ব্যবহার আসবে– এতটা আশা রাখা বাতুলতা বই আর কী! বোঝাই যাচ্ছে, সবক্ষেত্রেই প্রাণীকুলের ‘শ্রেষ্ঠতম জীব’ বরাবর শুরু-শুরুতে ‘জাগিয়ে নাচন তাধিন্ ধিন্’, আর দায়িত্ব নেওয়ার প্রশ্ন এলেই ‘নিয়মহারা হিসাবহীন’। স্বজাতির ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকী, অবলা বাক্যহারা প্রাণীদের ক্ষেত্রেও। ব্যত্যয়হীন।
চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতার প্রতিবারের মতো এবারও এই প্যারামিটারে তারা একশোয় একশো।
‘পাশবিক’ এবং ‘মানবিক’ শব্দদ্বয়ও তাদের জন্য অস্তিত্ব সংকটে।
অথচ এরকম হওয়ার কথা ছিল না। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২৮ ধারা ও ‘দ্য প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস অ্যাক্ট’ বা ‘পিসিএ’ (১৯৬০)-এর ১১ ধারা বলে, পশুদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও তাদের হত্যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধের মধ্যে পড়ে। পোষ্য রক্ষার্থে বা প্রজনন ব্যবসা লাইসেন্সের সঙ্গে সংযুক্তকরণে কঠোর হওয়ার আশা কি অধিক কিছু?
যদ্দিন না এর’ম কিছু হয়, তদ্দিন বরং মার্থাদের উদ্দেশে তোলা থাক এই চিলতে সহমর্মিতাটুকুই–
When you find yourself in the thick of it
Help yorself to a bit of what is all around you
Silly girl
প্রচ্ছদ ছবি: সোমোশ্রী দাস
আমরা তো এদিকে হোম-ডেলিভারিকে বিদায় দিয়ে ততদিনে ভাতের হোটেলে বেঞ্চি বুক করে ফেলেছি। যে কোনও মেসতীর্থেই ধীরে জেগে ওঠে এই সব হোটেল। তাদের হোটেল বললে বড় পাঁচ-সাত তারা-রা কুপিত হতে পারে। না বললে, আমাদের সম্মানে লাগে।