ঘরে অদ্ভুত ভাবে ভেসে আসছে মাসিমুনির গায়ের সেই সুগন্ধির গন্ধ। আমি অনুভব করতে পারছিলাম ঠিক আমার পাশেই যেন মানুষটা বসে আছে। আমার হাত-পা ক্রমে আড়ষ্ঠ হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে রেখেছি, খুললেই যদি ওঁকে দেখতে পাই! তবু একসময় তাকালাম। লিখছেন অনিন্দিতা সুর
ছোটবেলা থেকে আমরা সবাই কমবেশি ভূতের গপ্পো শুনতে ভালোবাসি। বাড়িতে জেঠু-কাকুর কোলে বসে লোডশেডিংয়ের রাতে জমাটি ভূতের গল্প হোক কী ইতিহাস বইয়ের ফাঁকে রেখে শেষ করা ভৌতিক সমগ্র। কিন্তু সরাসরি সেই অভিজ্ঞতা হলে তা কি আদৌ সুখকর হয়? আমার জীবনে তেমনই এক অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে। কোনও এক পড়ন্ত বিকেলের চুরি যাওয়া আলোয় ধুলো ঝেড়ে স্মৃতি আঁকড়ালে ভয়ের চেয়েও বেশি চেপে ধরে মনখারাপ।
সময়টা ২০১০ সাল। আমার তখন বয়স ১৪ কি ১৫। তখনও মধ্যবিত্ত পাড়া-গাঁর আলসে অবসরে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে যায়নি স্মার্টফোন। ওই কৈশোরে মায়ের পাশাপাশি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল মাসিমুনি। যার সঙ্গে খেলাধুলো থেকে শুরু করে গল্প করা, কমিক্স পড়া, ভূতের সিনেমা দেখা, লুকিয়ে নিজের হোমওয়ার্ক মাসিমুনিকে দিয়ে করিয়ে নেওয়া সবই চলত অনায়াসে। আমার বন্ধু, কাম গাইড, কাম বহু দুষ্টুমির সঙ্গী ও আলতো প্রশ্রয় মাসিমুনি। মাসিমুনির সঙ্গে আমার বয়সের ফারাকও খুব একটা বেশি ছিল না। ওই ১০-১২ বছরের বড় আরকি। তাই মাসি কম, বন্ধু বেশি। বিশ্বাস অগাধ। ভালোবাসাও অপরিসীম। আমার সব সমস্যার একমাত্র সলিউশন।
আরও পড়ুন: একঝলকে যা দেখলাম ওর মুখটা বিবর্ণ, ফ্যাকাসে
শৈশব থেকেই আমার জীবনে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ খানিক বেশিই ছিল বলা যায়। আর হবে নাই বা কেন। সেও তো আমার মতোই খানিক অন্তর্মুখী, খানিক জেদি, খানিক স্বাধীনচেতা। বিয়ে করবে না ঠিক করেছিল। দৌড়ে ফার্স্ট প্রাইজ পেত। ছোটবেলা থেকেই অঙ্কে তুখড় ছিল। প্রচুর মেডেলও পেয়েছে। কিন্তু বাংলা পড়তে গেলে তার একটা অসুবিধা হত। একটু পরে জেনেছি মাসিমুনির ডিসলেক্সিয়া ছিল। ওই রোগের কারণে বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেনি মাসিমুনি। বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় থাকত। এদিকে মায়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমার দিদাও একসময় মারা যায়। এই সময়ে মাসিমুনি একা হয়ে পড়ে। দাদু সেই সকালে অফিস চলে যেত, আস্তে আস্তে রাত ১১টা। সেই সময়টুকু মাসিমুনি আমার সঙ্গেই ফোনে আড্ডা দিত, মজা করত। ‘ডিপ্রেশন’ শব্দটা আজ থেকে ১৫ বছর আগে এতটা প্রচলিত ছিল না। ওঁকে একসময় সেই রোগটা ঘিরে ধরে। যার ফলস্বরূপ চোখের নিমেষে জটিল পাটিগণিত সলভ করে ফেলা মানুষটা জীবনে তিনটে মেডেল উপহার পায়, রোগের মেডেল। মাত্র ২৯ বছর বয়সে সুগার, প্রেসার আর থাইরয়েড বাসা বাঁধে শরীরে। তারপরই একসময় দেখা দিল কিডনির অসুখ। দু’-দুটো কিডনি পুরোপুরি ড্যামেজ। ডাক্তার বলেই দিয়েছিলেন, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করলেও বড়জোর হাতে আর মাত্র ২ বছর। আমার অবাধ্য কৈশোর বুঝতে পারেনি আমার দোসরের এহেন মারণরোগের বেদনা। জানতে পারিনি সব বিপদে পাশে থাকা মানুষটার সমস্যার কথা। আমি আমার মতো মাসিমুনির সঙ্গে খেলেছি, গল্প করেছি, সবটাই স্বাভাবিক ছন্দে। এরকমই একদিন সন্ধ্যায় মাসিমুনি আমার কাছে অস্ফুটস্বরে জানতে চাইল, ‘মনা, যদি কোনও দিন আমি না থাকি আমার জন্য তোর কষ্ট হবে? আমায় ভুলে যাবি না তো?’
আরও পড়ুন: আমার ঘরের সেই হঠাৎ অতিথি
তাকিয়েছিলাম অপলক দৃষ্টিতে। সেদিন বুঝেছিলাম যে মায়া জিনিসটা সত্যি বড় ভয়ংকর। অবুঝ মন খালি ভেবেছিল, মাসিমুনি কেন এরকম কথা বলছে! ওকে ছাড়া তো আমার একটা দিনও ঠিকমতো কাটে না। নিস্তব্ধতা ভেঙে ওকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম ছাদে। কথা দিয়েছিলাম হাত ছুঁয়ে, কোনও দিনও না ভোলার। তবু মাসিমুনি ছেড়ে না যাওয়ার কথা রাখেনি। সব ছেড়ে চলে গেল একদিন। আমি খুব কেঁদেছিলাম সেদিন, ওকে ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে। সেদিন গায়ে ওর পছন্দের সুগন্ধির গন্ধ পেয়েছিলাম। মায়ায় ভরা সে গন্ধ। যে মায়া ছেড়ে সে যেতে চায় না কখনও। শুধু থাকতে চায় আমার সঙ্গে, সারাজীবন।
আরও পড়ুন: মৃতদেহটা আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি
মৃত্যুই বোধহয় মানুষকে অনেক পর করে দেয়। প্রিয় মানুষটা হয়ে গেল আমার ভয়ের কারণ। শ্রাদ্ধের দিন আমি বড় অস্বস্তিতে কাটাচ্ছি। সকাল থেকে বৃষ্টি। মনে এক অদ্ভুত আনচান করা অনুভূতি। যেন মনে হচ্ছে, ও এখানেই আছে। সবাইকে দেখছে, বিশেষ করে আমায়। মামারবাড়িতে অনেক লোক এসেছিল সেদিন। সবাই চলে গেল রাতে। আমি একা। মা-বাবা অন্য ঘরে। যথারীতি রাত বাড়তেই সব চুপচাপ। আমি সেদিন কিছুতেই ঘুমোতে পারছিলাম না। ঘরে অদ্ভুত ভাবে ভেসে আসছে মাসিমুনির গায়ের সেই সুগন্ধির গন্ধ। আমি অনুভব করতে পারছিলাম ঠিক আমার পাশেই যেন মানুষটা বসে আছে। আমার হাত-পা ক্রমে আড়ষ্ঠ হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে রেখেছি, খুললেই যদি ওঁকে দেখতে পাই! তবু একসময় তাকালাম। সেই চেনা গন্ধ। সেই নরম খুলে রাখা চুল। গালে তিল। নির্জনতা ভেঙে হাতে চুড়ির হালকা ঝমঝম। সেই চেনা সান্নিধ্য। সেই মায়া ভরা চোখ। প্রিয় মানুষটা বসে আমার পাশে। আর ভয় করছে না একটুও। দু’চোখ বেয়ে নেমে আসা অশ্রুস্রোত ভিজিয়ে দিচ্ছে বালিশ। আমার প্রাণের দোসর। হাতে হাত রাখল মাসিমুনি–
‘ভালো থাকিস মনা। আমায় ভুলে যাস না কখনও…!’
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী