গ্রামের জোড়া মন্দিরের কাছাকাছি আসতে পাশে চোখ ফেরাতেই দেখি– কোথা থেকে একটা বেড়াল এসে জুটেছে! মোবাইলের টর্চটা তার দিকে ফেলতেই দেখলাম বেড়ালটার গায়ের রং সাদা, তার ওপর কালো ডোরাকাটা দাগ। একবার তাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিছুটা দূরে সরে গিয়ে আবার কাছ ঘেঁষে চলতে লাগল। আমার বাড়ি গ্রামের শেষের দিকে। এখনও বেশ খানিকটা হাঁটাপথ। আমিও ভাবলাম যাক, নিঃসঙ্গ রাতে অন্তত একটা সঙ্গী পাওয়া গেল। লিখছেন মহম্মদ রিজওয়ান পারভেজ
সেবার ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফেরার জন্য বাক্স বাঁধাছাদা শুরু করলাম। পরিকল্পনামতো একদিন বিকেলে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন যখন গ্রামের স্টেশনে পৌঁছল, তখন হাতঘড়ির কাঁটায় রাত ১১টা। এই সময় গ্রামে-গঞ্জে খুব বেশি লোক জেগে থাকে না। তার ওপর শ্রাবণ মাস, আকাশের মুখ ভার। সারাদিন টিপ-টিপ বৃষ্টি পড়ছে। স্টেশন মাস্টারও ঘরের দরজা জানলা লাগিয়েছেন। স্টেশনের বাইরে কোনও সাইকেল রিকশা দেখতে পেলাম না। এত রাতে আশাও করিনি। যদিও স্টেশন থেকে আমাদের গ্রাম পায়ে হেঁটে বড়জোর দু’-মাইল। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে দ্রুত হাঁটা লাগালাম। আকাশের অবস্থা ভালো নয়, তার ওপর মাঝে মাঝে আকাশে বিদ্যুতের চমক। বড় দীঘির কাছাকাছি আসতেই ঝিরঝিরে হাওয়া এসে গায়ে লাগল। হাঁটার গতি বাড়ালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হবে। যতই চেষ্টা করি দ্রুত হাঁটা সম্ভব হচ্ছে না। খানা-খন্দ, জল-কাদায় পরিপূর্ণ।
একমাত্র সঙ্গী অনবরত ঝিঁঝিঁর ডাক এবং মাঝেসাঝে রাস্তায় দু’-একটা কুকুর-শেয়াল ছাড়া জনপ্রাণী চোখে পড়েনি। গ্রামের জোড়া মন্দিরের কাছাকাছি আসতে পাশে চোখ ফেরাতেই দেখি– কোথা থেকে একটা বেড়াল এসে জুটেছে! মোবাইলের টর্চটা তার দিকে ফেলতেই দেখলাম বেড়ালটার গায়ের রং সাদা, তার ওপর কালো ডোরাকাটা দাগ। একবার তাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিছুটা দূরে সরে গিয়ে আবার কাছ ঘেঁষে চলতে লাগল। আমার বাড়ি গ্রামের শেষের দিকে। এখনও বেশ খানিকটা হাঁটাপথ। আমিও ভাবলাম যাক, নিঃসঙ্গ রাতে অন্তত একটা সঙ্গী পাওয়া গেল। হাঁটতে-হাঁটতে মনে পড়ল, ব্যাগে একটা বিস্কুটের প্যাকেট আছে। হাওড়া স্টেশনে কিনেছিলাম। সেই ট্রেনে দু’-একবার বিস্বাদ চা ছাড়া সেরকমভাবে দুপুরের পর আর কিছু খাওয়া হয়নি। আমি ব্যাগ থেকে বিস্কুটের প্যাকেট বের করতেই আমার সঙ্গী পাশ থেকে ডাকলেন, ‘ম্যাও…ম্যাও…’।
আরও পড়ুন: মনে হচ্ছে ও যেন আমাকেই দেখছে ভিড়ের মধ্যে
বুঝলাম, তার ভাগ চাই। আর ভাগ চাওয়াই তো স্বাভাবিক। আমার নিঃসঙ্গ রাতের সঙ্গীর পাওনা তো দেওয়া উচিত। মাটিতে জল-কাদা ছিল, তাই মাটিতে না ফেলে তার মুখের দিকে একটা বিস্কুট এগিয়ে দিলাম। সে দিব্যি সেটিকে গলাধঃকরণ করল। শুধু একটিতেই তার পেট ভরল না। আরও বেশ কয়েকটি বিস্কুট চাওয়ার পর তার আবদার মিটল।এতক্ষণ সে আমার পাশে পাশে চলছিল হঠাৎ সে আগে আগে চলতে শুরু করল। আমিও তার পিছন-পিছন চলতে শুরু করলাম। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে আবার সে আমার পাশে পাশে চলতে লাগল। বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখি সদর দরজা বন্ধ। মা-কে সারপ্রাইজ দেব বলে জানায়নি আজ আসছি। তাই বাড়ির কাজের লোক মোহনদাকে ডাক দিলাম। তারপর পাশ ফিরেই দেখি আমার সঙ্গী উধাও! ভাবলাম বাড়ি পর্যন্ত যখন এসেছে, আশা করি কাল সকালে দেখতে পাব। আবার ডাকতেই মোহনদা এসে দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘আরে ছোট কত্তা তুমি? আসবে জানাওনি তো!’
আরও পড়ুন: একঝলকে যা দেখলাম ওর মুখটা বিবর্ণ, ফ্যাকাসে
আমি বললাম, ‘আগে বলো মা কই? আর আমার ব্যাগটা আমার ঘরে দিয়ে এসো।’
মোহনদা সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, ‘তুমি আমাদের পাড়ায় ঢোকার বাঁকটা পেরলে কী করে?’
আমি, ‘কেন? কী ব্যাপার?’
মোহনদা, ‘বৃষ্টির জলকাদা জমে সাহার আর রাস্তা এক হয়ে গেছে যে।’
বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রামের এক অংশে বাড়ির আবর্জনা ফেলার জায়গাকে ‘সাহার’ বলা হয়। আবর্জনা ফেলার জন্য কোনও একটি নির্দিষ্ট জায়গায় প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাত গর্ত করা হয়। ধীরে ধীরে আবর্জনা-নোংরা জল জমে সেটি দুর্ভেদ্য কূপে পরিণত হয়। কেউ অজান্তে সেখানে পড়ে গিয়ে ডুবে গেলে মৃত্যু অবধারিত। আজ ভাগ্যিস বেড়ালটাকে অনুসরণ করছিলাম নইলে সোজা ওই গর্তে পড়তাম।
আমি সে কথা না বলে বললাম, ‘মোবাইলের টর্চ ছিল অসুবিধা হয়নি। তুমি বলো না মা কোথায়?’
মোহনদা: বড় কত্তা, গিন্নিমা সবাই বাগানে।
আমি: কেন এত রাতে বাগানে কেন?
মোহনদা: আর বলো না গো, গিন্নিমা ক’দিন থেকে একটা বেড়াল পুষেছিলেন। রোজ দু’বেলা গিন্নিমা খেতে দিতেন। রাতে গোয়াল ঘরের পাশে শুয়ে থাকত। আজ বিকেলে গিন্নিমা বাগানে ওই লেবু গাছটার পাশে বেড়ালটাকে বিস্কুট খেতে দিয়েছিলেন। তখন হঠাৎ চারিদিক কালো করে মেঘ করল। খুব বৃষ্টি শুরু হল। আর থেকে থেকে বাজ পড়ছিল। হঠাৎ জোর একটা বাজ পড়ল ওই লেবু গাছটার ওপর। আর তাতেই…
মোহনদা কথা শেষ করল না। আমি যা বোঝার বুঝে গিয়েছি ততক্ষণে।
আরও পড়ুন: আমার ঘরের সেই হঠাৎ অতিথি
হয়তো আমার মনের ভুল। এটা হয়তো অন্য কোনও বেড়াল। কিন্তু আমার পঞ্চেন্দ্রিয় বারবার আমাকে জানান দিতে লাগল এই বেড়াল আর আমার পথসঙ্গী বেড়াল একই। অনেক সময় মানুষের সচেতন মন এবং অবচেতন মনের লড়াইয়ে অবচেতন মন হয়তো সত্যিটা জানান দিয়ে যায়। সেই নিঃসঙ্গ রাতের অজানা সঙ্গী যে একপ্রকার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল আর কখনও তার দেখা পাইনি। আজ অবধি এই রহস্যের মীমাংসা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী