আটের দশকে সেক্স সিম্বল ছিলেন সিল্ক স্মিতা। ‘আলাইগাল ওইবাতিল্লাই’ বা ‘মুন্ড্রম পিরাই’-এর (হিন্দি রিমেক, ‘সদমা’) মতো সিনেমায় কাজ করেও, ভবিতব্য মুছতে পারেননি তিনি। মানুষের মনে ধরল শুধু তাঁর বিকিনি-অবতার। বছরের পর বছর পড়ে থাকা সিনেমা বেরতে থাকল কেবলমাত্র স্মিতার একটা অ্যাপিয়ারেন্স বসিয়ে। সফট পর্নে, আজও, কাল্ট তাঁর ‘লয়নম’ (হিন্দি রিমেক, ‘রেশমা কি জওয়ানি’; সুপারহিট ‘শীলা কি জওয়ানি’ গানের মূল সূত্র ওই নামটাই)।
ইস্তফা দিতে, বাস্তবিক, বাধ্য হলেন বিজয় আনন্দ। প্রশ্ন তুললেন, “ভারতের টিভিতে ‘বেওয়াচ’ চলে, অথচ সিনেমায় একটা চুমু চলে না?” ছয়ের দশকের ধুন্ধুমার ফিল্মমেকার বিজয়, তিরুবনন্তপুরমের অফিসে, হিসেব কষে দেখালেন, শুধুমাত্র কেরালাতেই, ৬৪% সিনেমায় থাকে নগ্নতা ও যৌনতা। প্রস্তাব দিলেন, এমন কয়েকটা সিনেমাহল হোক, যেখানে ‘XA’ রেটিং দিয়ে, অ্যাডাল্ট ফিল্ম আইনত দেখানো হবে। তাতে কালোবাজারি আটকাবে, ট্যাক্সও পাবে সরকার।
কিন্তু, এ দেশের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে! যথারীতি, রইরই পড়ে গেল তাঁর কথায়। ক’দিন পরেই, সিবিএফসি-র (যেটাকে আমরা আশ্চর্য কারণে ‘সেন্সর বোর্ড’ বলি) চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিলেন তিনি। আক্ষেপ করলেন, ‘কাল অবধি মুদির দোকান চালিয়ে, আজ সকলে সিনেমা-বোদ্ধা হয়েছেন!’
বিজয় পর্যুদস্ত হওয়াতে, খুশিই হলেন কেরালার মুভি-মাফিয়ারা। নিষিদ্ধ ফল খোলাবাজারে বিকোলে, ব্যবসায়ীদের তো মন্দাই! যদিও, সত্যি বলতে, যৌনতা-বিষয়ক সিনেমায় অনেক এগিয়ে ছিল ঈশ্বরের আপন দেশ। ভারতের প্রথম ইরোটিক থ্রিলার ওখানেই, ‘পুনর্জন্মম’ (১৯৭২)। ‘আবালুডে রাবুকাল’ (১৯৭৮), প্রথম ‘A’ রেটেড মালয়ালাম ফিল্ম। ওই বছরের, ‘রতিনির্বেদম’, যা মালয়ালাম ইন্ডাস্ট্রিতে একটা ল্যান্ডমার্ক।
আটের দশকে, ভিসিআর-এর হুজুগে, ভাঁটা পড়েছিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। যেসব সিনেমা শহরে চলছিল, গ্রামে-মফস্সলে সেগুলো চলছিল না। মামুট্টি-মোহনলালের মতো স্টার-জুটির সুপারহিট ‘বার্তা’ থেকেও মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন আত্তিঙ্গালের লোকজন। এরকম সময়ে, পোক্ত ডিরেক্টর ক্রসবেল্ট মণির দরকার পড়ল টাকাপয়সা। তিনি একটা রেপ রিভেঞ্জ ড্রামা বানালেন, ‘ওট্টায়ান’। এবং, ধর্ষণের দৃশ্যে সত্যি-সত্যি নগ্নতা ঢুকিয়ে দিলেন। দু’সপ্তা পর, যতক্ষণে সেন্সরের বাবুরা এলেন, ততক্ষণে ১০ লাখে বানানো সিনেমা ১২ লাখের ব্যবসা করে ফেলল।
আরও পড়ুন: লকআপে বসে স্টোরিটেলিংয়ের জোরে পুলিশকে বন্ধু বানিয়েছিলেন রাম গোপাল বর্মা
চন্দ্রশেখরন ভাবলেন, সাদা-কালো আর্ট ফিল্ম বানাবেন, ‘ধূমম’। পয়সার অভাবে আটকে গেল কাজ। দু’-এক জায়গায় সত্যি-সত্যি যৌনমিলন দেখিয়ে, নিজেই রিলিজ করলেন, এদিক ওদিক গাঁয়ে-গঞ্জে। পাবলিসিটির রেস্ত ছিল না; জাস্ট মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে, সিনেমা হিট হয়ে গেল।
হাতে-গরম মুনাফা দেখে, অনেকেই, রাতারাতি, নগ্ন দৃশ্য বসিয়ে, সিনেমা রিলিজ করতে শুরু করলেন। সেন্সর বোর্ডের কাছে যেসব প্রিন্ট জমা পড়ল, সেগুলো নির্ভেজাল। পরে, প্রেক্ষাগৃহের আঁধারিতে আসলি দর্শকের কাছে পৌঁছল আদিম ভাঁড়ার। যেমন, ‘পিডিকিট্টাপুল্লি’ বা ‘কারিনাগম’। সেন্সর বোর্ড বাজেয়াপ্ত করল ‘পিডিকিট্টাপুল্লি’-র প্রিন্ট। তাজ্জব! সেখানে সেক্সের স-ও নেই! বেকসুর খালাস পেয়ে, দিন ১৫ পর, ত্রিবান্দমে, ভরপুর নগ্নতা বসিয়ে, আবার হাউজফুল হল ‘পিডিকিট্টাপুল্লি’।
আটের দশকে সেক্স সিম্বল ছিলেন সিল্ক স্মিতা। ‘আলাইগাল ওইবাতিল্লাই’ বা ‘মুন্ড্রম পিরাই’-এর (হিন্দি রিমেক, ‘সদমা’) মতো সিনেমায় কাজ করেও, ভবিতব্য মুছতে পারেননি তিনি। মানুষের মনে ধরল শুধু তাঁর বিকিনি-অবতার। বছরের পর বছর পড়ে থাকা সিনেমা বেরতে থাকল কেবলমাত্র স্মিতার একটা অ্যাপিয়ারেন্স বসিয়ে। সফট পর্নে, আজও, কাল্ট তাঁর ‘লয়নম’ (হিন্দি রিমেক, ‘রেশমা কি জওয়ানি’; সুপারহিট ‘শীলা কি জওয়ানি’ গানের মূল সূত্র ওই নামটাই)।
আটের দশকের শেষে, ‘আদ্যপাপম’-এর বক্স অফিস কালেকশনে মাথা ঘুরে গেল অনেকের। মাত্র সাড়ে ৭ লাখে বানানো সিনেমা ব্যবসা করল আড়াই কোটির। নায়িকা অভিলাষার বৃহস্পতি তখন তুঙ্গে। ডিরেক্টর চন্দ্রকুমার বুক বাজিয়ে বললেন, ‘মামুট্টির মুখ আর অভিলাষার ঊরু– দুটো একই দরে বিকোয়।’
বাত্তিয়ুরকাবুতে, শোয়ের আগে ও পরে, এত ভিড় হত, হল-মুখী রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। গুরুবায়ুরে, রোজ, পৌঁছত গাড়ি-বোঝাই কিশোর ও তরুণ। সেখানে জাগ্রত গুরুবায়ুরপ্পনের (কৃষ্ণ) মন্দির। মন্দিরের গেট থেকে ৩০০ ফুট দূরেই, ‘শ্রীকৃষ্ণ থিয়েটার’; যেখানে রমরমিয়ে চলত অ্যাডাল্ট ফিল্ম। বাড়িতে জানত, ছেলে গেছে তীর্থযাত্রায়, কৃষ্ণের পুজো দিতে। এমন কথাকে কি সর্বাংশে মিথ্যে বলা যায়?
পৌরাণিক কাহিনি-ভিত্তিক ফিল্ম বানিয়ে, প্রতিষ্ঠিত ছিলেন প্রোডিউসার এস. কুমার। ‘ব্লু’ বাজারে, তাঁর নতুন নামকরণ হল ‘সেক্স’ কুমার। বলা হল, কুমারের ‘ইভিলস অফ ওয়াইন অ্যান্ড উম্যান’ একটা এডুকেশনাল ফিল্ম; ট্যাক্সেও ছাড় পেল সেটা। বাস্তবে, দর্শক দেখল সফট পর্ন। কেরালায় তখন একজনই সেন্সর অফিসার, রঙ্গনাথন। বললেন, ‘আমার একার পক্ষে এসব আটকানো অসম্ভব!’
এবার, একটু পাটিগণিত। একটা সফট পর্নের বাজেট, আটের দশকে ছিল ৭ লাখের কম। স্ক্রিপ্টের মারপ্যাঁচ, ধুরন্ধর অ্যাক্টর বা স্টার, কিংবা টেকনিক্যাল কারিকুরি? দরকার নেই। বেশিরভাগ সময়ে হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরাতেই, কোনও রিটেক ছাড়া, সোজা শুট। আর, ৩ থেকে ৬ মিনিটের ‘নীল’ দৃশ্যের বাড়তি খরচ, ৩০,০০০ টাকা। মার্কেটিং বা প্রোমোশন? আলাদা কোনও প্রয়োজন নেই। এরপর, চোখ বুজে, ব্যবসা মোটামুটি গ্যারান্টিড।
আরও পড়ুন: টিপ টিপ বরসা পানি ও বুক ঢিপ ঢিপ নাইন্টিজ
অন্ধকার হলেও, সত্যিই, বহু টেকনিশিয়ান আর শিল্পীর পরিবারে আলো জ্বালিয়েছিল এই ইন্ডাস্ট্রি। মেনস্ট্রিমে, আটের দশকের শেষে, একজন মহিলা এক্সট্রা আর্টিস্ট পেতেন দিনে ৭৫ টাকা। তিনিই এখানে পেলেন ২,০০০ টাকা। একসময়ের স্টার রতিশের হাতে কোনও কাজ ছিল না। অ্যাডাল্ট ফিল্মে ঢুকে, মাত্র ৬ মাসে, কাজ করলেন ৩০টা সিনেমায়; বললেন, ‘নইলে তো না খেয়ে মরতাম, কেউ খোঁজও নিত না…।’ অভিজ্ঞ অভিনেত্রী প্রমীলা বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি শরীর দেখাই, আমাকে রোজগার করতে হয়… আমি এসব না করলে, কোড়মবক্কমে আরও কয়েক হাজার মেয়ে অপেক্ষা করছে এই কাজ করবে বলে…।’
স্মিতার আত্মহত্যার পর, শূন্য সিংহাসনে বসলেন শাকিলা। প্রথমদিকের কয়েকটা সিনেমায় এলেন অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে। ‘কিন্নর তুম্বিকাল’ আর ‘কাল্লুবাতুকাল কাতরিনা’-এর পর, তাঁর ক্রেজ এমন হল, তুবড়ে পড়ল মেনস্ট্রিম সিনেমা; ঘায়েল হলেন বাঘা-বাঘা নায়কও। মাত্র ১২ লাখে বানানো ‘কিন্নর তুম্বিকাল’, ৬টা ভারতীয় ভাষায় ডাবড হয়ে, ব্যবসা করল ৪ কোটির। শুধু কেরালা নয়, সারা দেশে সুনামি আনল এই ‘শাকিলা তরঙ্গম’। প্রায় সব ভারতীয় ভাষা ছাড়াও, নেপাল, চিন, শ্রীলঙ্কাতেও, ডাবড হয়ে, বেরোতে থাকল তাঁর সিনেমা। শাকিলার পারিশ্রমিক দাঁড়াল, গোটা ইউনিটের মধ্যে, সবথেকে বেশি। বাজেট বাঁচাতে, প্রোডিউসাররা তাঁকে একবার শুট করে, পুরো সিন কেটে কেটে, জুড়ে দিতে থাকলেন একাধিক সিনেমায়। ফলে, নয়ের দশকের শেষদিক থেকে, সমার্থক হয়ে গেল সফট পর্ন ও শাকিলা। শুধুমাত্র ২০০১-এই তাঁর অভিনীত সিনেমা, ২৫টারও বেশি। চিরকাল আঞ্চলিক ভাষায় কাজ করে, আক্ষরিক কতটা সর্বজনীন হওয়া যায়– শাকিলা না থাকলে, বোধহয়, আমরা জানতে পারতাম না।
মেনস্ট্রিম ইন্ডাস্ট্রিতে, মোহনলাল আর মামুট্টি যখন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বিতার শীর্ষে, তখন একই বছরে দু’জনের দুটো সিনেমা হিট হল। মজার ব্যাপার, সিনেমা দুটোর নাম প্রায় প্রতিশব্দ– ‘রাবণ প্রভু’ আর ‘রাক্ষস রাজাভু’। শাকিলা কী করলেন? তিনি একটা সিনেমা করলেন, ‘রাক্ষস রজনী’। বক্স অফিস কালেকশনে, দু’জন মেনস্ট্রিম মেগাস্টারকে টেক্কা দিয়ে দিল তাঁর সিনেমা।
‘কিন্নর তুম্বিকাল’-এ উদ্ভিন্নযৌবনা কামার্ত দাক্ষায়ণী (শাকিলা) শয্যায় পেতে চায় বান্ধবী জানকীর ভাগ্না, কিশোর গোপুকে (বিপিন রয়)। গোপু ইতস্তত করে, মাসির বান্ধবী তো তারও মাসি! এ তো পাপ, এ তো ভুল! গোপুকে আকুল আঁকড়ে, ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে ‘মদকরণী’ দাক্ষায়ণী, ‘ভুল তো সবাই করে, গোপু…’ শাকিলার স্বরে উচ্চারিত এই সংলাপ গেঁথে গেছে কেরালার রোজকার জীবনে। আপাত-ভ্রান্ত কাজে কাউকে উৎসাহ দিতে বা ইয়ার্কিচ্ছলে, মালয়ালিরা এটা প্রবাদের মতো বলেন।
মিলেনিয়াল প্রজন্ম হয়তো টেরও পাবে না, পোস্টারে একটা ‘A’ থাকলে, হৃদ-কুঠুরিতে ঘনাত কী কালবৈশাখী! পকেটে পকেটে, ২৪ ঘণ্টার ইন্টারনেটে, সেই ইন্ডাস্ট্রি এখন অন্য রূপ নিয়েছে বটে; কিন্তু, শাকিলার ঐতিহ্য মোটেও মোছেনি। ইরোটিক কমিকসের চরিত্র, সবিতা ভাবী আর ভেলাম্মার উৎসস্থল, তিনিই। দুনিয়া জুড়ে, দিনরাত, খুঁজতে থাকা ‘মাল্লু আন্টি’ বা ‘মাল্লু চেচি’-র কল্পলোকে, তিনিই। সাংঘাতিক পুরুষতান্ত্রিক একটা দুনিয়ায়, চরম বডি শেমিংয়ের একটা জগতে, তিনি আসলে উদাহরণ– হ্যাঁ, তুখড় থাপ্পড়ের।