সম্প্রতি সলিল চৌধুরীর সংগীতের দুনিয়া নিয়ে একটি প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে দেখলাম সলিল চৌধুরীর সংগীতের বিপুল কর্মকাণ্ডের মধ্যে শুধুমাত্র তাঁর গণসংগীত সৃষ্টির কাজটিকেই বাংলা সংগীতের পরম্পরায় স্বতন্ত্র অবদান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর কিছুর উল্লেখ বা আলোচনা অনুপস্থিত। প্রবন্ধটি রোববার.ইন-এই প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ, রুদ্রাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের লেখা: ‘বাংলা গানে সলিল ছিলেন, তবু আজকের বাংলা গান পারিপার্শ্বিকতা বিমুখ’।
সলিল চৌধুরী একটা কথা প্রায়ই বলতেন যে, একটা জবরদস্ত মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠার নেপথ্যে প্রয়োজন শিল্পরসিক আর শিক্ষিত শিল্প সমালোচক। ‘শিক্ষিত শিল্প সমালোচক’ কথাটা খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করতেন, কারণ এ ব্যাপার তাঁর ক্ষোভের শেষ ছিল না। ঘনিষ্ঠ মহলে সলিল দুঃখ করে বলতেন, কোনও সংগীত সম্পর্কিত আলোচনাতে সমালোচকরা লেখেন ‘ইহা আমার ভালো লাগিল,অথবা; ইহা আমার ভালো লাগিল না’, কিন্তু সংগীতের ব্যাকরণ, কাঠামোগত প্রয়োগের মুনশিয়ানা নিয়ে আলোচনা কোথায়? কারণ দুর্ভাগা দেশে অধিকাংশ সংগীত সমালোচক সংগীতের ব্যাকরণ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না!
পৃথিবীর গাড়িটা থামিয়ে অন্য অজানা গ্রহের গাড়ি ধরে অনন্তে পাড়ি দিয়েছেন সলিল অনেক দিন হল, প্রায় তিন দশকের কাছাকাছি। তাঁর কাজের বিপুল ব্যাপ্তি এবং অবদান নিয়ে কি আমরা সত্যি কোনও মূল্যায়ন করেছি বা করতে চেয়েছি? না কি সংগীত সমালোচনা এখনও অন্ধের হস্তী-দর্শনের মতোই একটা অসম্পূর্ণ এবং বিকৃত একটি বিবরণ হিসেবে থেকে গেছে? এই অসম্পূর্ণতার ফলশ্রুতি হিসেবে অন্যান্য সংগীত স্রষ্টার ক্ষেত্রেও সেই এক বিড়ম্বনা এবং বঞ্চনার গল্প তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি সলিল চৌধুরীর সংগীতের দুনিয়া নিয়ে একটি প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে দেখলাম সলিল চৌধুরীর সংগীতের বিপুল কর্মকাণ্ডের মধ্যে শুধুমাত্র তাঁর গণসংগীত সৃষ্টির কাজটিকেই বাংলা সংগীতের পরম্পরায় স্বতন্ত্র অবদান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর কিছুর উল্লেখ বা আলোচনা অনুপস্থিত। প্রবন্ধটি রোববার.ইন-এই প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ, রুদ্রাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের লেখা: ‘বাংলা গানে সলিল ছিলেন, তবু আজকের বাংলা গান পারিপার্শ্বিকতা বিমুখ’।
আরও পড়ুন: বাংলা গানে সলিল ছিলেন, তবু আজকের বাংলা গান পারিপার্শ্বিকতা বিমুখ
কী ধরনের গানকে আমরা গণসংগীত বুঝি? এক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের ‘নিউ সং মুভমেন্ট’ থেকে উঠে আসা সংজ্ঞাকে যদি মান্যতা দিই, তাহলে বৃহত্তর মানুষের জীবনস্বার্থ এবং দুর্দশার কথা নিয়ে তৈরি যে গান, তাকেই আমরা গণসংগীত বলতে পারি। এবার আসি সলিল চৌধুরীর কথায়, সলিল চৌধুরী কী কাজ করেছেন, যা তাঁর আগে কেউ এই উপমহাদেশে করেননি? সেটা গণসংগীত বা প্রতিবাদী গান তৈরির মতো বিষয়? না। সলিল পাশ্চত্যের সংগীত, বিশেষ করে মার্গ সংগীতের অর্কেস্ট্রেশনের প্রয়োগকৌশল নিয়ে এলেন ভারতীয় আধুনিক গানে। গানের নেপথ্যে ‘অব্লিগেটো’র প্রয়োগ তাঁর আগে ভারতীয় সংগীতে সেভাবে শোনা যায়নি। ‘অব্লিগেটো’ হল এক বিশেষ ধরনের কোরাস ভায়োলিন, যা গানের মূল সুর থেকে একেবারে আলাদা, অথচ নেপথ্য থেকে অদ্ভুত ব্যঞ্জনা তৈরি করে। ‘শোনো কোনও একদিন’ গানটি যদি খেয়াল করে শুনি, তাহলে দেখা যাবে গানের প্রতিটি স্তবকে একটা করে স্কেল চেঞ্জ হচ্ছে। অদ্ভুত মজার সুর, একে থিওরিস্টরা বলেন ‘ডিসেপটিভ ক্যাডান্স’– এমন প্রয়োগকৌশল এমন সুরশৈলী খুব বেশি এই উপমহাদেশে নেই। আর এ এক মহাসমুদ্র ,আমি কয়েকটা উদাহরণ দিলাম মাত্র। বিশদে লেখার জন্য একটা প্রবন্ধ ‘অকিঞ্চিৎকর’ বললেও কম বলা হবে।
আবার একটু সাম্প্রতিক প্রবন্ধটির প্রসঙ্গে আসি, সেখানে লেখক লিখেছেন সলিল চৌধুরীর পরে আর কাউকে বাংলায় সেভাবে গণসংগীত রচনা এবং গাইতে দেখা যায়নি। কী আশ্চর্য ! নয়ের দশকের গোড়া থেকে কবীর সুমন, নচিকেতা চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্ত এবং আরও অনেকে মিলে তাহলে কী করেছেন? কবীর সুমনের গানের প্রভাব গোটা বঙ্গসংস্কৃতির আনাচকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে। এসব অস্বীকার করে কোথায় পালাবেন রুদ্রাঞ্জনবাবু ? আর আপনি নস্যাৎ করলেই তো সেটা নস্যাৎ হয়ে যাবে না, তাই না? জর্জ সান্তায়ানা স্প্যানিশ আমেরিকান দার্শনিক ও লেখক ‘পোয়েট্রি অফ বারবারিসম’ প্রবন্ধে কবি রবার্ট ব্রাউনিংকে নস্যাৎ করেছিলেন। পাতে দেওয়ার মতো নয় এমন একজন কবি– গোদা বাংলা করলে এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন প্রবন্ধ জুড়ে। কিন্তু সত্যি কি নস্যাৎ করতে পেরেছেন তিনি? প্রবন্ধটি ভিন্নমত ভিন্নস্বর হিসেবে থেকে গেছে। ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ গানটির উল্লেখ করে এই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, হাল আমলে গানবাজনার মধ্য দিয়ে এমনতর স্বার্থপর মনোবৃত্তি প্রকাশ পাচ্ছে, যা গণসংগীতের যৌথতার জীবনদর্শন থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। কিন্তু মুশকিল হল, কোনও একটি বিশেষ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত গানকে শিখণ্ডির মতো খাড়া করা কি উচিত হল? যেখানে আমরা জানি যে, সিনেমার গান সবসময়ই কন্টেক্সটচুয়াল, অর্থাৎ সেই বিশেষ দৃশ্য়ের চরিত্রের মানসিক অবস্থা এবং দৃশ্যের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি হয়।
আরও পড়ুন: ‘আকাশবাণী’র সিগনেচার টিউন তৈরি করেও তিনি চির-উপেক্ষিত
আসলে সিনেমার গান বা বেসিক গান যাই হোক, সেই গান উতরোবে তার নিজস্ব শিল্পগুণে। মানুষের মনে তা থেকে যাবে। আর আমরা জানি, মহাকালের ছাঁকনির চেয়ে বড় ছাঁকনি নেই। যা থাকার তা থেকে যাবে। দুঃখের বিষয় ,সলিল চৌধুরীর আক্ষেপের বিষয়টিও বর্তমানে রয়ে গাছে। সংগীত এবং সংগীতের ব্যাকরণ সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিরা সংগীতকারদের নিয়ে প্রবন্ধ লিখছেন। ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলিতেছে।’
এটাই বড় দুঃখের।