তীব্র আক্রোশে চারাটিকে মাটি থেকে উপড়ে, পা দিয়ে দলে দিয়ে যেন নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইল ছেলেটি। সন্ন্যাসী শান্ত চোখে ছেলেটির কার্যকলাপ দেখছিলেন। সে একটু শান্ত হলে ধীর গলায় তিনি বললেন, কুমার, ভেবে দেখেছ, এই রাজ্যের অধিবাসীরা যদি তোমার সম্পর্কে এই একই কথা বলে?
১৭.
বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্ত মনে মনে ভাবলেন, এই তরুণ সন্ন্যাসীই পারবেন আমার সমস্যার সমাধান করতে।
রাজপ্রাসাদের গবাক্ষ থেকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে তিনি মানুষটিকে পর্যবেক্ষণ করলেন। রাজ-উদ্যানে সন্ন্যাসী পায়চারি করছিলেন। তাঁর স্থিতধী চেহারায় বোঝা যায়, ইন্দ্রিয়সমূহ শান্ত। এদিক-ওদিক না তাকিয়ে তিনি সামনের দিকে যুগ-পরিমাণ মাত্র (লাঙলের ফাল যতটুকু দীর্ঘ) ভূমিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন। এত পরাক্রান্ত, কিন্তু হিসেবি তাঁর পদচারণা যে, মনে হচ্ছে প্রতি পদক্ষেপে যেন সহস্র স্বর্ণমুদ্রার এক একটি স্থবিকা (থলি) নামিয়ে রাখছেন।
রাজা ভাবলেন, আমার মতিচ্ছন্ন ছেলেকে সুপথে আনার সব চেষ্টাই তো ব্যর্থ হয়েছে; নানা জনের নানা উপদেশ, শাসন, হুঁশিয়ারি কোনও কিছুতেই কোনও ফল হয়নি। আমি অপেক্ষা করছিলাম কোনও দৈবী যোগাযোগের। আজ মন বলছে, সেই সুযোগ সমাগত।
সন্ন্যাসী প্রথমে রাজপ্রাসাদে আসতে রাজি হচ্ছিলেন না। রাজার প্রধান অমাত্যের বারংবার অনুরোধে রাজসভায় এলেন। রাজা তাঁকে সাদা ছাতায় ঢাকা সোনার সিংহাসনে বসতে দিলেন। তাঁর নিজের জন্য বানানো নানা সুখাদ্য সন্ন্যাসীকে পরিবেশন করলেন। তারপর একান্তে তাঁর ছেলের কথা পাড়লেন: সে বড় ক্রোধপরায়ণ, উগ্র এবং নিষ্ঠুর; এই সুজলা সুফলা রাজ্যের উত্তরাধিকারী হওয়ার পক্ষে এখনও পর্যন্ত একান্তই অযোগ্য। হে মহাপ্রাণ, আপনি ওর দায়িত্ব নিন।
রাজন, আমি হিমালয়ে থাকি। সেখানের বাতাস, ফলমূলেই জীবনধারণ। মাত্র কয়েক দিনের জন্য সমতলে এসেছি। আমার পক্ষে কি এই দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব? রাজ্যশাসনের কীই বা জানি যে শিক্ষা দেব?
আপনি অনুগ্রহ করে শুধু তার মন পরিবর্তন করে দিন। সেটা যদি সম্ভব হয়, তারপর তাকে যুবরাজের উপযুক্ত করে তোলার মতো প্রাজ্ঞ শিক্ষকেরা এখানে রয়েছেন।
বেশ আমি চেষ্টা করব।
মহারাজ নিজে ছেলেকে পৌঁছে দিলেন সন্ন্যাসীর কুটিরে। সন্ন্যাসী তাকে সস্নেহে কাছে ডেকে নিলেন। সাধারণভাবে আলাপচারী শুরু করলেন। বারাণসীর দ্রষ্টব্যের কথা জিজ্ঞেস করলেন। কুমার জানতে চাইলেন হিমালয়ে সাধুজীবনের কৃচ্ছ্রতার কথা।
সন্ন্যাসী খেয়াল করলেন, ছেলেটি মেধাবী। তাছাড়া বাইরের বড় জগৎ সম্পর্কে সে সচেতন এবং কৌতুহলী। তাঁর মনে হল, এমন ছেলেকে সংশোধন করা খুব দরকার।
তিনি বিকেলবেলা ছেলেটিকে নিয়ে হাঁটতে বেরলেন। বন্ধুর মতো গল্প করতে করতে চললেন। ছেলেটিকে কিছু গাছ চেনালেন। ছেলেটিও চেনাল কয়েকটি। পথের ধারে একটি ছোট চারাগাছ দেখে সন্ন্যাসী হঠাৎ বললেন, কুমার, এই গাছটি চেনো?
খুবই ছোট চারা। মাটি ফুঁড়ে সবে মাত্র দু’টি-তিনটি উজ্জ্বল সবুজ পাতা হালকা হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে। গাছ চেনার নেশায় ছেলেটি হাঁটু গেড়ে মাটির ওপর বসে ঝুঁকে পড়ে চারাটি কাছ থেকে দেখল। কিন্তু ঠাওর করতে পারল না। ছোট একটা পাতা ছিঁড়ে নাকের কাছে এনে গন্ধ শুঁকল। তা-ও চেনা গেল না। তখন ছেঁড়া পাতার টুকরোটা জিভে ঠেকাল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন নব জাতক-এর অন্য পর্ব: নেপথ্য থেকে যে নেতৃত্ব দেয়, তাকে অস্বীকার করা যায় না
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ঠেকিয়েই থুঃ থুঃ করে ফেলে দিল।
কী হল কুমার?
কী বিকট তেতো! এত ছোট চারাই যদি এমন হয়, বড় বৃক্ষ হলে না জানি কেমন বিষাক্ত হবে? কত পশু, পাখি, মানুষের বিপদ ডেকে আনবে!
বলতে বলতে কেমন এক তীব্র আক্রোশে চারাটিকে মাটি থেকে উপড়ে, পা দিয়ে দলে দিয়ে যেন নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইল ছেলেটি।
সন্ন্যাসী শান্ত চোখে ছেলেটির কার্যকলাপ দেখছিলেন। সে একটু শান্ত হলে ধীর গলায় তিনি বললেন, কুমার, ভেবে দেখেছ, এই রাজ্যের অধিবাসীরা যদি তোমার সম্পর্কে এই একই কথা বলে?
সপ্রশ্ন চোখে রাজার বিপথগামী পুত্র তাকাল সন্ন্যাসীর দিকে।
যদি তারা বলে, আমাদের রাজকুমার বাল্যেই উগ্র আর নিষ্ঠুর, রাজপদ পেলে না জানি কী ভীষণ বিপদ ডেকে আনবে? তাই যদি তারা তোমাকে এখন… কথা অসমাপ্ত রেখে সন্ন্যাসী মৃদু হাসতে হাসতে ছেলেটিকে নকল করে চারাগাছ উপড়ে পা দিয়ে দলে দেওয়ার মূকাভিনয় করলেন।
এক একটি সংলাপের আশ্চর্য ক্ষমতা থাকে। উচ্চারিত শব্দ, কথকের ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ সব পারস্পরিক বিক্রিয়ায় শ্রোতার মনে এক বিস্ফোরণের জন্ম দেয়। যেমন সন্ন্যাসীর এই কথাক’টি।
ছেলেটি মাথা নীচু করল। ঘাড়টি সামান্য নাড়াল। তারপর ছেলেটি স্থির করল, সে বদলে যাবে। আমূল বদলে যাবে। বদলাতে তাকে হবেই।
কিছুদিনের মধ্যেই মহারাজ এবং তাঁর প্রজারা বুঝতে পারলেন, রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাজা নিয়ে তাঁদের আর দুশ্চিন্তা নেই।
(একপর্ণ জাতক)