ঘরানার ছায়াপথ ধরেই লারার উত্তরণ; এবং ব্রায়ান লারাই সেই বিলুপ্ত ক্যারিবিয়ান ঘরানার শেষ তারা। সমালোচকরা যতই কাঁটাছেড়া করুন না কেন, লারার মন্তব্য ও ইনিংসে চিরকাল ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের সেই আত্মাই প্রতিফলিত হয়। আর এই মননশীলতার জন্যই, লারা হয়ে ওঠেন ক্রিকেটের এক অনন্য চরিত্র। যেরকম চরিত্রদের আকর্ষণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ ক্রিকেট-অনুরাগী হয়ে পড়েন।
ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে এক ট্র্যাজিক নায়ক। ব্যাট হাতে একা কুম্ভ। বাইশ গজে তাঁর ব্যাট উপহার দিয়ে চলেছে বিস্ময়ের পর বিস্ময়। কিন্তু তাও পুনরুদ্ধার করা গেল না গারফিল্ড সোবার্স-রোহান কানহাই-ক্লাইভ লয়েড-ভিভ রিচার্ডসদের বিশ্বসেরার মুকুট! একদিন থেমে গেল ত্রিনিদাদের রাজপুত্রের ব্যাট, ক্রিকেট ইতিহাসে ট্র্যাজিক হিরো হয়েই রয়ে গেলেন ব্রায়ান চার্লস লারা! সম্প্রতি কলকাতায় লারার আসা ফিরিয়ে আনল একরাশ স্মৃতি।
’৯৩-এর জানুয়ারি, সিডনিতে ক্রিকেট আকাশ। লারা নামক নক্ষত্রের জন্ম হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার ৫০০ রানের জবাবে শুরুতেই দুই ওপেনারকে হারিয়ে চাপের মুখে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অ্যালেন বর্ডারের টিমের আগ্রাসী বোলিংয়ের বিরুদ্ধে দুরন্ত স্ট্রোক-প্লে নির্ভর কাউন্টার-অ্যাটাক শুরু করলেন এক বাঁ-হাতি! আগের প্রজন্মের ওয়েস্ট ইন্ডিজের সুপারস্টারদের মতো শক্তি-নির্ভর স্ট্রোক নয়, মধুর টাইমিং-সর্বস্ব লারার ব্যাটে ছিল ক্যারিবিয়ান-ক্যালিপসোর সুর-মূর্ছনা, যা শুধু উপস্থিত দর্শকদেরই নয়, সম্মোহিত করল সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বকে। ২৭৭-এ থামলেন লারা। ওই টেস্ট ড্র হলেও, লারার এই ইনিংস ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ানদের পাল্টা স্নায়ুর চাপে ফেলে সিরিজের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ০-১ পিছিয়ে থাকা রিচি রিচার্ডসনের দল পরের দুটো টেস্ট জিতে ২-১-এ ফ্রাঙ্ক ওরেল ট্রফি দখল করে দেশে ফেরে। লারার জীবনে সিডনির এই ইনিংসের গুরুত্ব এতটাই যে, তাঁর প্রথম কন্যার নাম রেখেছেন ‘সিডনি’।
সেন্ট জন্স, অ্যান্টিগুয়া। ইংল্যান্ডের অ্যাঙ্গাস ফ্রেজারের বল হুক করে ডিপ মিড উইকেট বাউন্ডারিতে পাঠানোর মুহূর্তে রচিত হল এক মহাকাব্য। গ্যালারি থেকে মাঠে নেমে এসে জড়িয়ে ধরলেন স্যর গ্যারি সোবার্স। সোবার্সের উচ্ছ্বসিত, ২৬ বছর পর তাঁর সর্বোচ্চ টেস্ট ইনিংসের রেকর্ড ভেঙেছেন তাঁরই ঘরানার এক ক্রিকেটার– ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর ব্রায়ান লারা। লারা থামলেন ৩৭৫-এ। এর কিছুদিনের মধ্যেই ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে ওয়ারউইকশায়ারে যোগ দিলেন লারা, ও প্রথম মরশুমেই ডারহামের বিরুদ্ধে অপরাজিত ৫০১ রানের ইনিংস খেলে আবার ইতিহাস গড়লেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পাক-ওপেনার হানিফ মহম্মদের সর্বোচ্চ ৪৯৯ রানের রেকর্ডও ভেঙে গেল! উঁচু ব্যাকলিফ্ট, নিখুঁত টাইমিং, সমস্ত ক্রিকেটীয় শটের সম্ভার আর বড় ইনিংস খেলার টেম্পারামেন্ট নিয়ে ২৬ বছর বয়সি বাঁ-হাতির ব্যাট তখন পেন্ডুলামের মতো দোলাচ্ছেন ক্রিকেটবিশ্বকে। গ্রিনিজ-রিচার্ডস-হেইনস-মার্শাল-হোল্ডিং-গার্নার-দুজঁরা তখন অবসর নিয়ে ফেলেছেন। ক্লাইভ লয়েড বা ভিড রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজের গরিমা তখন ফিকে হতে শুরু করেছে। অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকার উত্থান পর্ব চলছে বিশ্ব-ক্রিকেটে। এমন একটা সন্ধিক্ষণে জিনিয়াস লারার আবির্ভাব।
এভার্টন উইকস, গ্যারি সোবার্স, ভিভ রিচার্ডস– কিংবদন্তি ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানদের ক্রিকেট-ঘরানাকে আরও মহিমান্বিত করে তুলল ত্রিনিদাদের রাজপুত্রের ব্যাট। যে ধ্রুপদী ঘরানার মূল উপাদান ছিল বিধ্বংসী স্ট্রোক প্লে আর আগ্রাসী ফাস্ট বোলিং। লারা এর সঙ্গে যোগ করলেন অভূতপূর্ব কল্পনাশক্তি আর উদ্ভাবনী-ক্ষমতা সমৃদ্ধ ব্যাটিং-শৈলী, যা সেরা বোলিংকে সাধারণ মানে নামিয়ে এনে অচিরেই পার করে দিত দুশোর গণ্ডি। যার প্রভাবে, প্রথম ২০-২৫টা বল খেলতেন সোজা ব্যাটে সতর্ক হয়ে, তারপর ইনিংস যত এগত, ততই দুর্বার গতিতে ছুটত স্কোরবোর্ড। টেস্ট-ইতিহাসে স্যর ডন ব্র্যাডম্যানের ১২টার পরই তাঁর নামের পাশে রয়েছে ন’টা ডাবল-সেঞ্চুরি। অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ-আফ্রিকা, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, কোথায় না দ্বিশতরান করেছেন লারা? কিছুদিনের মধ্যেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল হয়ে পড়ল ব্রায়ান লারার উইলোর ওপর। একক দক্ষতায় লারা বহু স্মরণীয় টেস্ট ও ওয়ান-ডে ম্যাচ জেতালেন, কিন্তু ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের নতুন প্রজন্ম সেই উৎকর্ষ সৃষ্টি করার ধারেকাছেও যেতে পারল না; লারাও পারলেন না তাঁদের ক্রিকেট-সাম্রাজ্যের পতন রোধ করতে! তাঁর অবসর নেওয়ার পরই বিলুপ্ত হয়ে গেল সব থেকে আকর্ষক ঘরানার ক্রিকেট।
তবুও লারা মনে করেন, বিশ্বক্রিকেটের এক অসাধারণ সময়ে তিনি বড় হয়ে উঠেছিলেন। হয়তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণযুগের শেষের শুরু হয়ে গিয়েছিল তখন, কিন্তু দীর্ঘ ১৭ বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতিনিধিত্ব করা, সমসাময়িক অন্যান্য দেশের নক্ষত্রর সঙ্গে, যা তিনি আজও উপভোগ করেন! সাম্প্রতিক ভারত ও কলকাতা সফরে এসে লারার অভিব্যক্তি, ‘দীর্ঘ ক্রিকেট-কেরিয়ার উপহার দিয়েছে কিছু দুরন্ত মুহূর্ত ও সমসাময়িক ক্রিকেটারদের সঙ্গে অসাধারণ কিছু বন্ধুত্বের সম্পর্ক।’
লারার প্রথম ভারত সফর আজ থেকে ঠিক ৩০ বছর আগে, সিএবি হিরক জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত হিরো কাপে। লারা তখনও লারা হননি, মানে বিশ্বরেকর্ড করে পর্বতশৃঙ্গ স্পর্শ করে ফেলেননি, তবে সিডনিতে দ্বিশতরান করে নিজের জাত চিনিয়েছেন। নভেম্বরের এক মৃদু শীতের সন্ধ্যায়, ইডেন-গার্ডেনসে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে, তিনি দেখালেন দুরন্ত ক্যারিবিয়ান স্ট্রোক প্লে-র নিদর্শন। ফাইনালে ভারতের সামনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, প্রথম লারা-সচিন দ্বৈরথ। কপিলদেব তখনও খেলছেন। অনুষ্ঠানে নিজের স্মারক বক্তৃতায় কপিলকে বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করলেন লারা। সেই কপিল-সচিনের টিমের কাছে, ইডেনের এক লাখ দর্শকের সামনে ’৮৩-র সেই ফাইনালের মতোই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং, সচিনের ভাসিয়ে দেওয়া বলে লারা ক্লিন বোল্ড হওয়ার পর। ৩৩ রানে আউট হওয়ার আগে ছ’টা বাউন্ডারি মারেন ত্রিনিদাদের রাজপুত্র, সেট হয়ে যাওয়ার পর তাঁর আউটই ছিল ওই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। কিন্তু ইডেনের আবহে মুগ্ধ হলেও কোনও দিন ইডেনে টেস্ট খেলা হয়ে উঠল না লারার, যে আক্ষেপ তিনি অবসর নেওয়ার পরও করেছেন সংবাদমাধ্যমে। ইডেনের দর্শকরাও বহুযুগ ধরে এভার্টন উইকস থেকে রোহান কানহাই, গ্যারি সোবার্স থেকে ভিভ রিচার্ডস, ক্যারিবিয়ান-ক্যালিপসো ক্রিকেট তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে এসেছেন, কিন্তু লারাকে নিয়ে একটা অপূর্ণতা রয়েই গেছে কলকাতার। কিন্তু এমনই তাঁর ক্যারিশমা, যে অবসর নেওয়ার ১৬-১৭ বছর পরও তিনি এই শহরে পা রাখলে সমস্ত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যান।
ক্রিকেটার লারার কি কোনও বিশেষ আক্ষেপ রয়ে গিয়েছে? লারাকে তৈরি করার পিছনে যাঁর সবথেকে বড় অবদান, সেই বান্টি লারার আকস্মিক মৃত্যু। ‘তখন আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমে, কিন্তু টেস্ট অভিষেক হয়নি। ম্যাচের দিন সকালে ক্লাইভ লয়েড ড্রেসিং-রুমের দরজায় কড়া নেড়ে আমাকে আলাদা করে ডাকলেন। তখনই বুঝেছিলাম, কোনও দুঃসংবাদ অপেক্ষা করে আছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে আমার টেস্ট খেলা দেখে যেতে পারলেন না বাবা…।’
এহেন লারা নিজেকে টেস্ট-মেটিরিয়াল মনে করতেন, একদিনের ক্রিকেট তেমন পছন্দ করতেন না। কিন্তু লারারা এমনই জিনিয়াস, যে ওডিআই-তেও তার দশ হাজারের বেশি রান, গড় ৪০-এর ওপর। করাচির এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে তাঁর ব্যাট আছড়ে ভেঙেছিল বব উলমারের ল্যাপটপ। প্রিন্স অফ পোর্ট অফ স্পেনের ধ্রুপদী শতরানের কাছে হার মানল উলমার-হ্যান্সি ক্রোনিয়ের প্রযুক্তি-নির্ভর ক্রিকেট; ৯৬-এর বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বাড়ি পাঠিয়ে যেতে হল হট ফেভারিট দক্ষিণ আফ্রিকাকে। নিজের কলামে দক্ষিণ আফ্রিকা কোচ উলমার লিখেছিলেন, ‘সেদিন সকালে মাঠে লারা মাঠে মুখোমুখি হতেই ব্রায়ান আমাকে বলল, সরি বব, আজ আমি নিচ্ছি! যে আত্মপ্রত্যয় ছিল ওর গলায়, তখনই বুঝে যাই আজ কপালে দুঃখ আছে।’ গ্রুপ লিগে বিশ্বকাপের নবাগত কেনিয়ার কাছে হেরে তখন প্রবল চাপে রিচি রিচার্ডসনের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই পরিস্থিতিতে লারার একটা মন্তব্যকে কেন্দ্র করে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়। প্রতিযোগিতার সেরা দলের বিরুদ্ধে ডু অর ডাই ম্যাচের আগে ক্যারিবিয়ান সুপারস্টার বলে দিলেন, ‘সাদা চামড়ার দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হারতে আমি ঘৃণা করি!’ তারপরের ঘটনা ইতিহাস; সেদিন ব্রায়ান লারার ব্যাটিং-এ ছিল স্বাধীনতার ছন্দ, ক্যালিপসো ঘরানাকে আরও বিস্তৃত করলেন স্বকীয় শৈল্পিক-স্টাইলে।
ঔপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সৃজনশীল উপাদান হিসেবে ক্রিকেট তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, এবং বিবর্তিত হয় এক নতুন ক্যারিবিয়ান ঘরানায়। ইতিহাসবিদ সিএলআর জেমস দেখিয়েছেন, ফ্রাঙ্ক ওরেলের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ক্রিকেট সেদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে ওঠে। সামাজিক আন্দোলনের স্পিরিটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটাররা তাই ব্রিটিশ কপিবুক ক্রিকেটের সীমানার বাইরে গিয়ে সৃষ্টি করলেন স্বদেশীয় ক্যালিপসো সংগীতের মতোই, এক নয়া স্টাইলের ক্রিকেটের। আগ্রাসী ক্রিকেটে শুধু বিনোদনের উপাদান নয়, ছিল বিশ্বক্রিকেটের সেরা শক্তি তথা ঔপনিবেশিক প্রভুদের পরাস্ত করার অদম্য জেদ আর পেশাদারিত্ব। সেই ঘরানার ছায়াপথ ধরেই লারার উত্তরণ; এবং ব্রায়ান লারাই সেই বিলুপ্ত ক্যারিবিয়ান ঘরানার শেষ তারা। সমালোচকরা যতই কাঁটাছেড়া করুন না কেন, লারার মন্তব্য ও ইনিংসে চিরকাল ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের সেই আত্মাই প্রতিফলিত হয়। আর এই মননশীলতার জন্যই, লারা হয়ে ওঠেন ক্রিকেটের এক অনন্য চরিত্র। যেরকম চরিত্রদের আকর্ষণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ ক্রিকেট-অনুরাগী হয়ে পড়েন।
খেলোয়াড়ি জীবনে যাঁকে তাঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হত, সেই শচীন তেন্ডুলকার এদেশে লারার অন্যতম প্রিয় বন্ধু। ২০০৩ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের আগে ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন স্বয়ং শচীন তেন্ডুলকার, ‘লারাকে ছুড়ে ফেলবেন না। ও বিরল প্রজাতির ব্যাটসম্যান।’ নানা সমস্যায় জর্জরিত লারা তখন সাময়িক বিরতি নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন পন্টিং-জয়সূর্য-জ্যাক ক্যালিসরা। শচীনের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে দিয়ে কেপটাউনে প্রথম ম্যাচেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে দুরন্ত সেঞ্চুরি করলেন লারা। শেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রা বা মুথাইয়া মুরলীধরন– সমসাময়িক সেরা বোলারদের সঙ্গে তাঁর দ্বৈরথ ক্রিকেটীয় গুণমানে নয়া দিগন্ত উন্মোচন করত। ২০০১ সাল, শচীন তেন্ডুলকারের মাথায় বিশ্বসেরার শিরোপা তুলে দিয়েছেন প্রায় সব বিশেষজ্ঞ। এমন সময় শ্রীলঙ্কা সফরে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অফস্পিনার মুথাইয়া মুরলীধরন তখন ব্যাটসম্যানদের কাছে এক দুর্ভেদ্য রহস্য। মুরলীর দাপটে ক্যারিবিয়ানদের তিন-শূন্যয় টেস্ট সিরিজ হারাল শ্রীলঙ্কা, কিন্তু লারাকে টলাতে পারলেন না টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেট-শিকারী। নিজের গুহায় মুরলীকে দুরমুশ করে তিন টেস্টের সিরিজে লারা করলেন তিনটি শতরান-সহ রেকর্ড ৬৮৮ রান! একই টেস্টে প্রথম ইনিংসে দ্বিশতরানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে আবার শতরান। পরের টেস্টে আবার দুরন্ত সেঞ্চুরি; বিস্মিত মুরলী বলে ফেললেন, ‘সচিন আর যাই হোক, লারা নন।’ মুরলীর কথার সুর এরপর প্রতিধ্বনিত হয়েছে শেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রা, ওয়াসিম আক্রমদের গলায়।
২০০৩-এ ঘরের মাঠে দুর্বল জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে তাঁর ৩৭৫ রানের রেকর্ড ভেঙে দিলেন ম্যাথিউ হেডেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই অ্যান্টিগুয়ার সেন্ট জন্স, প্রতিপক্ষ সেই ইংল্যান্ড, তবে এবার আরও শক্তিশালী বোলিং-অ্যাটাক সম্পন্ন! সিরিজে ০-৩-এ পিছিয়ে শেষ টেস্ট খেলতে নামল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কঠিন চ্যালেঞ্জের আবার ইতিহাস রচনা করল লারার ব্যাট, সমস্ত নজির ভেঙে দিয়ে সৃষ্ট করল অপরাজিত ৪০০ রানের নতুন মাইল-ফলক, যা আজও অজেয়! সচিনের ব্যাটে ছিল ধারাবাহিকতা, যা না থাকার জন্য লারা বারবার সমালোচিত হয়েছেন। কোনও কোনও জিনিয়াসরা ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ হন, লারাও তাই ছিলেন; কিন্তু বারবার ক্রিকেটকে অবিশ্বাস্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে তাঁর শৈল্পিক-ব্যাটিং! স্যর ডনের পর তিনিই প্রথম টেস্টে দু’বার তিনশোর গণ্ডি পার করেন, দুটোই বিশ্বরেকর্ডের ইনিংস, যার একটা অপরাজিত ৪০০! আর ধারাবাহিক না হয়েও টেস্টে তাঁর গড় ৫২’র একটু ওপরে! সম্প্রতি বিশ্বকাপে বিরাট কোহলি সচিনের ওডিআই-তে ৪৯ টা সেঞ্চুরির রেকর্ড ভেঙে দিলেন। কিন্তু, কে ভাঙবেন লারার রেকর্ড? কোহলি, স্টিভ স্মিথ…? লারার বাজি কোহলিরা নন, তরুণ ভারতীয় ওপেনার শুভমন গিল।
নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকেই সীমিত ওভারের ক্রিকেটের যুগ উৎপাদন করতে শুরু করল ছাঁচে ঢালা একদল ‘বিশেষজ্ঞ’ ক্রিকেটার। যারা অনেকটা কমার্শিয়াল-আর্টিস্টদের মতো। অধুনা টি-২০ সেই ধারাকে আরও তরাণ্বিত করছে। এখনও রূপকথার ইনিংস খেলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়ালরা। কিন্তু লারাদের মতো ক্লাসিকাল-শিল্পী ও আকর্ষক চরিত্রের সমন্বয়ের অভাব প্রতি মুহূর্তে অনুভূত হয় ক্রিকেটবিশ্বে! ওই উঁচু ব্যাক-লিফ্ট, মধুর টাইমিং-সমৃদ্ধ ক্যারিবিয়ান ক্যালিপসোর সুর যে এখনও সম্মোহিত করে রেখেছে বহু ক্রিকেটপ্রেমীকে…..