যে মেয়েটি বাংলা সিনেমহলে ধূমকেতুর মতো উদয় হয়ে আবার ধূমকেতুর মতোই দ্রুত মিলিয়ে গিয়েছিলেন, সেই মহুয়া রায়চৌধুরীর বহুবর্ণ জীবনকে এমনই নানা গল্পে ধরতে চেয়েছেন দীপারুণ ভট্টাচার্য। আর এইসব গল্পের উচ্ছ্বাস থেকে বারে বারে উঁকি দিয়ে গিয়েছেন এক একলা নারী। ছোটবেলা থেকে দৌড় যাঁকে কোথাও থিতু হতে দেয়নি। না ভালোবাসায়, না উচ্চাশায়। অকালপ্রয়াণের সময়ও মহুয়ার হাতে ছিল কুড়িটা ছবি। জীবনের শেষ শটে সংলাপ বলেছিলেন, ‘আমি ভালো নেই… আমি ভালো নেই’।
‘তুমি সাইকেল চড়তে পারো?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি গাছে উঠতে পারো?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি নাচতে পারো?’
‘হ্যাঁ!’
একনাগাড়ে হ্যাঁ আর হ্যাঁ। শুনতে শুনতে ইন্টারভিউয়ারের বোধহয় ভালো লাগছিল না। তাই পরের প্রশ্নটাই গুগলি, ‘তুমি না বলতে পারো?’ এমন বেমক্কা প্রশ্নে আনকোরা কারও ঘাবড়ে যাওয়ারই কথা। কিন্তু বছর তেরোর মেয়েটা সপাট জবাব দিল, ‘হ্যাঁ পারি।’ তারপর এক মুহূর্ত থেমে বুঝিয়ে দিল, ‘আপনার সিনেমায় যদি এইসব না জানতে হয়, তাহলে আমি না-ও বলতে পারি।’ এহেন উত্তর শুনে দুঁদে পরিচালকেরই প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার জোগাড়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: পৃথিবীর খাদ্যচক্রে সক্কলে একে অন্যের খাবার
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কিন্তু মহুয়া তো এরকমই। ছটফটে, বেপরোয়া, দুঃসাহসী, আর ঠিক ততটাই খামখেয়ালি। তার খেয়ালের তোড়ে কে যে কখন ভেসে যাবে তার ঠিক নেই। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল রবি বসুর সঙ্গে। তিনি অবশ্য সিনেজগতের কেউ নন, কিন্তু ফিল্ম সাংবাদিকতা করার সুবাদে পরিচালক আর কলাকুশলীদের সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠাবসা। নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের একটা ছবির সেটে গিয়ে পৌঁছেছেন সবে, যেখানে আবার প্রোডাকশনে কাজ করছেন তাঁর ছেলে অশোক। গ্রামের লোকেশনের সামনে রবি বসুকে রিকশা থেকে নামতে দেখেই মহুয়ার চিৎকার, ‘এ মা, তুমি এতক্ষণে এলে! একটু আগেই তো তোমার ছেলের বিয়ে হয়ে গেল!’ শুনে ভদ্রলোক আঁতকে ওঠেন আর কি! ছেলের বিয়ের কথা তিনি ভেবেই ওঠেননি এখনও, সেখানে কিনা তাঁর অনুপস্থিতিতেই ছেলে বিয়ে সেরে ফেলল! মহুয়ার অবশ্য হেলদোল নেই। পাশে বছর বারো-তেরোর একটা মেয়ে লাজুকভাবে বসে ছিল, তার পরনে লাল চেলি, কপালে চন্দনের ফোঁটা। তাকে হুকুম দেওয়া হল, ‘যাও তো মা, তোমার শ্বশুরকে প্রণাম করে এসো।’ রবিবাবু এদিক-ওদিক তাকাতে গিয়ে আরও মুশকিলে পড়লেন। দেখলেন, একটু দূরে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে কথা বলছে অশোক, আর তার পরনে, কী আশ্চর্য, বরবেশ! গাছের ডালে একটা টোপরও ঝোলানো রয়েছে যে! বেচারা শ্বশুরমশাই মূর্ছা যাবেন কি যাবেন না ভাবতে ভাবতে শুনতে পেলেন মহুয়ার খিলখিল হাসি, ‘দেখে যাও, আমার একটুখানি অ্যাক্টিং-এর ঠেলায় তোমাদের ফিল্ম ক্রিটিক কেমন কুপোকাত হয়ে পড়েছেন!’
এমন হঠকারী কাণ্ডকারখানা মানাত মহুয়া রায়চৌধুরীকেই। উঁহু, নামটা ভুল হল। সোনালি রায়চৌধুরী। না, তাও তো না। তাহলে কি শিপ্রা বলব? সেই কবে থেকে নিজের নামটা খালি হারিয়েই গেছে। নিজেকেও কি ঠিক খুঁজে পাওয়া গেল কোনও দিন? মহুয়া সে উত্তর খুঁজেছিলেন, নাকি খুঁজতে চাননি, তাই বা কে বলবে!
তিন অক্ষরের নাম ছাড়া নাকি হিট নায়িকা হয় না। তাই ছোট মেয়েকে নাচের অনুষ্ঠানে নামানোর আগে বাবা নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী নাম বদলে দিলেন। শিপ্রা থেকে সোনালি। নিজে এককালে উদয়শংকরের দলে ছিলেন, নামী এডিটরের শাগরেদি করেছেন, যশ আর অর্থের আশায় বম্বেও পাড়ি দিয়েছিলেন, কিন্তু কপালে শিকে ছেঁড়েনি। তাই ছোট মেয়ের রূপ-গুণের উপর ভরসা করে তিনি শেষ বাজি ধরেছিলেন। সেবার আসর বসেছে উত্তর কলকাতার চৌধুরীপাড়ায়। সেকালের কলকাতায় এইসব পাড়ার জলসার টান কম ছিল না আদৌ। কখনও হেমন্ত-মান্না তো কখনও আশা-সন্ধ্যা, তো কখনও উত্তম-সাবিত্রী, তাবড় তাবড় মুখের দেখা মিলত এইসব অস্থায়ী মঞ্চে। সেদিনও সেই আসরে হাজির ছিলেন সুচিত্রা সেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা। তাঁদের সামনেই স্টেজে উঠল একটা সাত বছরের পুঁচকে মেয়ে। আর তারপর, তালে তালে গোটা স্টেজের দখল নিল দু’খানি পা। কে জানে, ‘দাদার কীর্তি’-তে চিত্রাঙ্গদাবেশী মহুয়ার নাচে মোহিত হয়ে যাওয়া তাপস পালের মতো সেদিনও কেউ বলেছিল কি না, “ছিল মন তোমার প্রতীক্ষা করি/ যুগে যুগে দিনরাত্রি ধরি’”…
……………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: বাঙালির প্রেম, শরীর, বন্ধুতা: এক অন্য অনুসন্ধান
……………………………………………………………………………………………………………………………………
না না, একজন বলেছিল বইকি। সেও স্টেজে গান গায় ছোট থেকেই। কিশোরকণ্ঠী। সেই সূত্রেই মাস্টার তিলকের আলাপ হয়েছিল সোনালির সঙ্গে। স্টেজের পিছনে বসে গল্প। তারপর স্কুল পালিয়ে দেখা করা। সোনালি তখন স্কুলের ফার্স্ট গার্ল। তিলক অবশ্য বয়সে বেশ খানিকটা বড়ই। গান-সিনেমায় সেভাবে নিজের জায়গা করে নিতে না পেরে ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢুকলেন তিলক চক্রবর্তী। আর কিছুদিন পরেই তাঁকে বিয়ে করে বসলেন মাত্র আঠেরো বছরের মহুয়া। হ্যাঁ, ততদিনে তিনি আর সোনালি নেই। বছর তেরো বয়সে প্রথম সিনেমায় সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিলেছে নতুন নামও। এর আগেও বাবা কম ধরা-করা করেননি। কিন্তু একটা সিনেমা এক সপ্তাহ শুটিংয়ের পরেই বন্ধ হয়ে গেল। সুখেন দাসের প্রযোজনায় পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি ‘নয়া মিছিল’-এ ডাক পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু রোগাসোগা কিশোরীকে মনে ধরেনি পরিচালকের। এই সময়ে সুচিত্রা সেনের ব্যক্তিগত রূপটানশিল্পী জামালভাইয়ের দৌলতে হঠাৎ করেই ডাক পড়ল তরুণ মজুমদারের কাছে, আর এক দেখাতেই তাঁকে পছন্দ করে বসলেন সন্ধ্যা রায়। কনেবউ সেজে ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ছবির নায়িকা হল যে কিশোরী, তরুণ মজুমদার নিজেই তার নাম দিলেন ‘মহুয়া’।
নায়িকা হয়ে ওঠার সেই শুরু। এরপর ‘যে যেখানে দাঁড়িয়ে’, ‘রাজা’, ‘বাঘবন্দী খেলা’। পরের পর সিনেমার অফার। স্কুল পালিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করা মহুয়ার আর পার্কে বসার জো নেই। উপায় নেই ট্রেনে বাসে ওঠারও। এদিকে তিলক বাড়িতে এলেই বাবার ভ্রূ কুঁচকে যায়। মহুয়ার টাকাতেই গোটা সংসার চলে এখন। তাই মেয়ের বিয়ের ভাবনায় যে বাবার অনীহা, সে কথা প্রিয় বন্ধু রত্নার কাছে প্রকাশ করেই ফেললেন মহুয়া। আবার ব্যস্ত নায়িকাকে পুত্রবধূ করতে তিলকের বাড়িতেও আপত্তি। তিতিবিরক্ত হয়ে কার্যত পালিয়েই বিয়ে সারলেন মহুয়া। রেজিস্ট্রি হয়ে যাওয়ার পর নববধূকে বরণ করে নিলেন খোদ উত্তমকুমার আর সুপ্রিয়া দেবী।
যে মেয়েটি বাংলা সিনেমহলে ধূমকেতুর মতো উদয় হয়ে আবার ধূমকেতুর মতোই দ্রুত মিলিয়ে গিয়েছিলেন, সেই মহুয়া রায়চৌধুরীর বহুবর্ণ জীবনকে এমনই নানা গল্পে ধরতে চেয়েছেন দীপারুণ ভট্টাচার্য। আর এইসব গল্পের উচ্ছ্বাস থেকে বারে বারে উঁকি দিয়ে গিয়েছেন এক একলা নারী। ছোটবেলা থেকে দৌড় যাঁকে কোথাও থিতু হতে দেয়নি। না ভালোবাসায়, না উচ্চাশায়। অকালপ্রয়াণের সময়ও মহুয়ার হাতে ছিল কুড়িটা ছবি। জীবনের শেষ শটে সংলাপ বলেছিলেন, ‘আমি ভালো নেই… আমি ভালো নেই’। ক’দিন বাদেই যে আগুন গ্রাস করে নেবে তাঁকে, সেই ভালো না-থাকার আঁচ কি সেদিনই পাওয়া গিয়েছিল? সে উত্তর আজও মেলেনি। স্টোভ ফেটে মহুয়ার মৃত্যু দুর্ঘটনা নাকি আত্মহত্যা নাকি এর নেপথ্যে অন্য কোনও কারণ লুকিয়ে ছিল, সে সংশয় রয়েই গিয়েছে তাঁর অনুরাগীদের মনে। ‘নিঃসঙ্গ মহুয়া’ বইটিতে সেই সংশয়ের পালটা কোনও সদুত্তর মেলেনি, উপরন্তু ঘুরপথে আত্মহত্যা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াসটি খানিক দুর্বল হয়েই রইল।
নিঃসঙ্গ মহুয়া: তারার অনিঃশেষ আলো
দীপারুণ ভট্টাচার্য
দীপ প্রকাশন। মূল্য ২৭৫