দেশের সংসদে মাসিকের সময়ের সবেতন ছুটির প্রসঙ্গ উত্থাপনমাত্রেই স্মৃতি ইরানি মাসিককে একটি প্রতিবন্ধকতা বা ‘হ্যান্ডিক্যাপ’ হিসেবে উল্লেখ করেন। যে প্রশ্নের মূলে ছিল মালিকপক্ষকে শ্রমিকের প্রতি আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে বাধ্য করা, সেই প্রশ্নটিকেই মন্ত্রী ঘুরিয়ে দিতে চান নারীর তথাকথিত প্রতিবন্ধকতার ইঙ্গিতে। লিখছেন সুপর্ণা মজুমদার, দিশা ঘোষ, মৌমিতা প্রামাণিক, সুব্রত সিন্হা।
১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ রাজ্যসভায় রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সাংসদ মনোজ কুমার ঝা প্রশ্ন করেন, মাসিক চলাকালীন কর্মরতা মেয়েদের সবেতন ছুটি দিতে নিয়োগকর্তাদের বাধ্য করার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না। প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি মন্তব্য করেন যে, ঋতুস্রাব কোনও প্রতিবন্ধকতা নয়, তাই মাসিক চলাকালীন মেয়েদের সবেতন ছুটির প্রয়োজন নেই। তিনি আরও বলেন যে, মহিলাদের জীবনে এটা খুব স্বাভাবিক বিষয়, বরং মাসিক ছুটি সমান সুযোগের ক্ষেত্রে ভেদাভেদ তৈরি করবে। প্রশ্নোত্তরের বয়ান নিম্নরূপ:
মনোজ কুমার ঝা: Sir, my question is this. What measures are being placed to make compulsory provisions for employers to grant certain number of paid menstrual leave to female employees?
স্মৃতি ইরানি: Sir, as the gentleman would concede that as a menstruating woman, I can very particularly, in this House say that menstruation and menstrual cycle is not a handicap. It is a natural part of a woman’s life journey. Given that women today are opting for more and more economic opportunities, I will just put my personal view on this, as I am not the officiating Ministry. We should not propose issues where women, in some way, are denied an equal opportunity just because somebody who does not menstruate has a particular view point towards menstruation.
জীবনধারা, খাদ্যাভাস, দূষণ, দুশ্চিন্তা– নানা কারণে পিরিয়ডের সময় নারীদের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগতে হয়। ডিসমেনোরিয়া, এন্ড্রোমেট্রিওসিস, ক্র্যাম্প, পলিসিস্টিক ওভারি ইত্যাদির জন্য ব্যক্তিভেদে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ‘মেনস্ট্রুয়েটিং উওম্যান’ বলেই তাই একজন নারী কখনওই প্রত্যেক নারীর হয়ে মেনস্ট্রুয়াল লিভের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে একবাক্যে নাকচ করতে পারেন না। উল্লেখ্য, এই প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণভাবেই বেতনভুক কর্মরতা নারীদের জন্যই– গৃহকর্ম, কৃষিক্ষেত্র প্রভৃতির সঙ্গে সংযুক্ত শ্রমজীবী নারীদের অধিকারের প্রশ্ন এর মধ্যে উহ্যই থেকে যায়। একই সঙ্গে এই প্রশ্নও ওঠে, স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া হলেই যদি তা পুঁজির দায়িত্বশীলতার চৌহদ্দির বাইরে চলে যায়, তাহলে কি নারীর গর্ভধারণ ক্ষমতাকেও স্বাভাবিক ঘটনা বলে মাতৃত্বকালীন ছুটিকেও উপেক্ষা করা হবে? না কি আলাদা আসনপিঁড়ি তার বংশরক্ষার পিতৃতান্ত্রিক দায়ে?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: ঋতুকালীন সবেতন ছুটি মহিলাদের উৎপাদনমূলক শ্রমেরই অংশ
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
স্মৃতি ইরানি যে মাসিককালীন সবেতন ছুটির দাবিকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবেই শুধু দেখতে চাইছেন, সে-বিষয়ে আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা হয়তো বোঝা যাবে মহারাষ্ট্রের বীড়ের আখের খেতের মহিলা শ্রমিকদের দিকে তাকালে। এই ‘প্রতিবন্ধকতা’র মানসিকতার শিকার হয়েই সেখানে কাজ পাওয়ার জন্য বাধ্য হয়েই হিস্টেরেক্টমি করিয়ে নিতে হয় হাজার হাজার মধ্যবয়সি মহিলাকে, কারণ ‘মেনস্ট্রুয়েটিং উওম্যান’-দের চাষের কাজে নিয়োগ করতে খেতমালিকরা অনিচ্ছুক। আর এই অপ্রয়োজনীয় আর অকাল হিস্টেরেক্টমির বাধ্যতামূলক শিকার হয়ে প্রবল শারীরিক আর মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাঁদের। পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়া-কে জ্যোতি শিনোলি জানান, ‘জরায়ুটা বাদ দেওয়ার পরই সব সমস্যার শুরু’। মাসিকের সময় সবেতন ছুটির দাবি তো শোষণের বিরুদ্ধে এইসব শ্রমিকের মর্যাদাপূর্ণ জীবনের সাংবিধানিক অধিকারেই নিরিখেই। রাষ্ট্র কি তা নিয়ে সচেতন?
উল্লেখ্য, উদ্ধৃত মন্তব্যের আগেই আরেকটি প্রশ্নের উত্তরে নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী স্যানিটারি ন্যাপকিনে ফ্যালেট জাতীয় ক্ষতিকারক রাসায়ণিকের ব্যবহার রোধের কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, সে-প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত কাঁচামাল নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তাঁর মন্ত্রকের কোনও ভূমিকাই থাকতে পারে না, এবং প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে ১০,০০০ জন ঔষধি কেন্দ্র থেকে এক টাকায় স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায় এবং তা থেকে কোনও সমস্যার কথা তাঁর গোচরে আসেনি। সঙ্গত কারণেই এই প্রশ্ন উঠে এসেছে, একজন ‘মেনস্ট্রুয়েটিং উওম্যান’ হিসেবে সেই এক টাকার ন্যাপকিন তিনি নিজে কখনও ব্যবহার করে দেখেছেন কি না।
মাথায় রাখা দরকার, নারীবাদী আন্দোলনের মধ্যে মাসিককালীন সবেতন ছুটি কিন্তু খুব অভিনব কোনও দাবি নয়। মহিলাদের জন্য মাসিককালীন সবেতন ছুটির রাষ্ট্রীয় নীতি প্রথম গৃহীত হয়েছিল সমাজতন্ত্রী রাশিয়ায়, প্রায় একশো বছর আগে। পরবর্তীকালে যেমন জাপান (১৯৪৭), দক্ষিণ কোরিয়া (২০০১), তাইওয়ান (২০১৩), জাম্বিয়া (২০১৫), ভিয়েতনাম (২০২০), স্পেন (২০২৩)– এইসব দেশেও মাসিকের সময় মহিলা কর্মীদের জন্য সবেতন ছুটির, কোথাও কোথাও অন্যথায় ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে। ভারতেও কেরল এবং বিহারে ১৯৯০ থেকেই মাসিককালীন ছুটি দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
এইসব তথ্য সরিয়ে রাখলেও স্মৃতি ইরানির কথা তিনটি কারণে বিশেষভাবে ভেবে দেখা দরকার। প্রথমত, দেশের সংসদে মাসিকের সময়ের সবেতন ছুটির প্রসঙ্গ উত্থাপনমাত্রেই স্মৃতি ইরানি মাসিককে একটি প্রতিবন্ধকতা বা ‘হ্যান্ডিক্যাপ’ হিসেবে উল্লেখ করেন। যে প্রশ্নের মূলে ছিল মালিকপক্ষকে শ্রমিকের প্রতি আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে বাধ্য করা, সেই প্রশ্নটিকেই মন্ত্রী ঘুরিয়ে দিতে চান নারীর তথাকথিত প্রতিবন্ধকতার ইঙ্গিতে।
দ্বিতীয়ত, তাঁর এই মন্তব্যই বুঝিয়ে দেয়, সবেতন কর্মক্ষেত্র মানে তাঁর অভিধানে কেবলমাত্র পুরুষের বিচরণক্ষেত্র। নারীশরীর সেখানে নিম্নমানের পরিবর্তমাত্র– পুরুষ শরীরের থেকে তার নিতান্ত শারীরবৃত্তীয় পার্থক্যও কেবলমাত্র প্রতিবন্ধকতা হিসেবেই বিবেচ্য।
আর তৃতীয়ত, সংসদীয়, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের প্রেক্ষাপটে ‘মেনস্ট্রুয়েটিং উওম্যান’-এর অধিকারের কথা বলার অধিকার যদি কেবল আর একজন ‘মেনস্ট্রুয়েটিং উওম্যান’-এরই থাকে, অন্য কারও নয়, তাহলে সেই যুক্তিতেই কি মণিপুরের দাঙ্গা নিয়ে অন্য রাজ্যের কোনও সাংসদ প্রশ্ন তুলতে পারবেন না? বিলকিস বানোর ধর্ষকদের সাজা ভোগার আগেই মুক্তি দিয়ে দিলেও ধর্ষিত না হলে সে-বিষয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না? গোরক্ষা, উদ্বাসন বা এরকমই কোনও জিগির তুলে নির্মম আর নির্বিচার হত্যার বিষয়ে সরব হতে গেলে কি মরে ভূত হয়ে সংসদে এসে ঢুকতে হবে?
অশোক ঘোষ মনে করতেন, ট্রাম আন্দোলন কলকাতার হকারদের একটি রাজনৈতিক চেতনা জুগিয়েছিল। এই আন্দোলন ছিল ছাত্র, শিক্ষক, কেরানি, হকার, আর উদ্বাস্তুদের লড়াই। আর ট্রাম-ডিপো মানেই হকার। এইসব দোকানেই আন্দোলনকারীদের আড্ডা বসত। দেশ-বিদেশের নানা ধরনের কথা আলোচনা হত। সকালে হয়তো কোনও এক চায়ের দোকানে জটলা পাকিয়ে খবরের কাগজ পড়া হত।