বড়রা নিজেরা প্লে করার পাশাপাশি শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি থেকে ক্লাবের দল আনিয়ে হোল নাইটও হত। পয়সা নিত না, গাড়ি ভাড়াও না। এই দলগুলোর নিজেদের এলাকায় এমনি বদনাম ছিল যে তিরিশ-চল্লিশ কিলোমিটার তফাতে না গেলে স্টেজে উঠলেই অডিয়েন্স ‘নামাইয়া দে, নামাইয়া দে’ বলে চেঁচামেচি জুড়ত। সে সময় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে নানারকম গোঁজ প্রার্থী তুলে ম্যানেজ দেওয়াই রেওয়াজ ছিল।
১৯.
দিনু জেঠু সারাজীবনে কোনও দিন হাফ ডে-র বেশি কাজ করেননি। ওঁর ‘হাফ পাউন্ড’ নামটা শুনেছিলাম যাদবজিরই দেওয়া। আমরা অবিশ্যি সামনে ওই নামে কখনওই ডাকতাম না। রমা জেঠিমা বড়ই স্নেহশীলা রমণী ছিলেন এবং যখন খুশি ঘেমে-নেয়ে রাস্তার ওপর ওদের সদর-ওপচানো খোলা বারান্দায় বসে পড়লেই হত– গামছা দিয়ে গা মুছিয়ে, গেলাসে শরবত, নাড়ু, মোয়া বেড়ে, ‘যা হয়েছে তাই দিয়ে দুটো খেয়ে যা’ ইতাদি আদরের সীমা ছিল না। আমরাও ওদের গাছের কাঁঠাল, পেয়ারা, জামরুল চুরি করে, পুজোর সময় একবারে পাঁচ টাকা চাঁদা ‘দিতেই হবে, দিতেই হবে’ বলে চেঁচামেচি জুড়ে, বছরের কোনও একটা দিন– এখন আর মনে নেই কোন দিন– লুচি, ছোলার ডাল, পান্তুয়া গান্ডেপিণ্ডে গিলে সে আদরের পুরোটাই সুদে-আসলে ফিরিয়ে দিতাম।
দিনু জেঠুকে কেউ কোনও দিন হাসিমুখ ছাড়া দেখেনি। একবার পুজোর থিয়েটারে ওঁকে সিরাজ সাজানোর পরিকল্পনা হয়েছিল। তিন-চার হপ্তা এক নাগাড়ে তালিমের পর নাকি সামান্য ভুরু কোঁচকানো সম্ভব হতে ভটচাজ কাকু এক দৌড়ে সেবক কালীবাড়িতে পুজো দিয়ে আসে– ‘হইসে! খানিকটা হইলেও হইসে তো! এইডাই ড্যাভেলাফম্যান্ট!’ হাকিম পাড়ার কল্যাণবাবু সে যুগে নাকের ওপর দড়ি বাঁধা চশমা চাপিয়ে, স্কুটার চালিয়ে, মান্ধাতা আমলের সাট ব্যাগে পুড়ে মহলায় আসতেন– তুখড় ডিরেক্টর হিসেবে খ্যাতি ছাড়াও ঐতিহাসিক যে পালাই ধরতেন, মেল ফিমেল সব পার্ট এবং কলকাতার স্টেজের সমস্ত গান ওঁর মুখস্থ ছিল। তিনি গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন ‘সিরাজ হাসিমুখে মৃত্যুবরণ কললে পার্টিতে আমার থাকা মুশকিল হবে। তোমাদের সঙ্গে মিশি বটে, তবে নেতাজির দেখানো পথে স্বাধীনতার আদর্শে বলিয়ান যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হলে সিরাজের মুখখানা বেদনাবিধুর হওয়া দরকার।’ এরকম বাংলা উনি একটানা বলে যেতে পারতেন, অতএব বাকিরা তর্কে না গিয়ে দিনু জেঠাকে ঘসেটি বা ওইরকম ফিমেল পার্টে ভিড়িয়ে দেয়। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোয় ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রায় সকলে এরপর একদিন দক্ষিণন্থী হয়ে যাবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
একবার সিরাজ কোলবালিশে কাত হয়ে গান শুনতে শুনতে সিরাজি পান করছে, ভটচাজ কাকু নেশার ঘোরে স্টেজে উঠে আলুর চপ দিয়ে এসেছিল– ‘এটা দিয়ে খা ভাই, এখনও গরম আছে।’ তারপর খোনা গলায় ‘জোছনা করেছে আড়ি, আসেনা আমার বাড়ি’ গাওয়া মহিলাকে ‘ইউ শাট আপ’ বলে মাইকের সামনে হাঁটুগেড়ে বসে ‘তুম আ গয়ে হো, নুর আ গয়া হ্যায়’ গেয়ে ফাটিয়ে দেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আমাদের ছেলেবেলায় কোনও একটি নাটকের প্লট ধরে এগোনোটা জরুরি বিষয় ছিল না। অতএব পলাশির রণাঙ্গনে সিরাজ ঘায়েল হতে না হতেই রাম-রাবণের ড্রেস চাপানো জনাকতক ঢাল-তরোয়াল বাগিয়ে স্টেজে উঠে ক্যালাকেলি শুরু করে দিত। দর্শকরা কত দ্রুত ঐতিহাসিক থেকে পৌরাণিকে সুইচ করতে পারত, তা এখনকার রিমোট টেপা জেনারেশন কল্পনাও করতে পারবে না। এ সময় লাইটম্যানের পাশে ভটচাজ জেঠুকে দাঁড় করিয়ে রাখাটাই ছিল নিয়ম। একে তো ওর ইয়া তাগড়া মাসলওলা চেহারা, তারপর আবার সন্ধে থেকে একটু বিলিতি চড়িয়ে শাহেনশা টাইপের মেজাজ। লাইটম্যান পল্টুদা ‘‘এই তো তোমরা একটা প্লে-র পয়সা দিয়ে দু’তিনটে শো করে নিচ্ছ’’ বলে কেঁইমেই শুরু করলে ওর টুঁটি টিপে ‘আমরা গরিব লোক, তোদের বৈপ্লবিক সহযোগিতা আর অভিনন্দন ছাড়া কীভাবে হবে’ বলেকয়ে একটু-আধটু কম্প্রোমাইজ করানোয় ওঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না। তবে পরের দিকে ওর বিলিতি খাওয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়।
একবার সিরাজ কোলবালিশে কাত হয়ে গান শুনতে শুনতে সিরাজি পান করছে, ভটচাজকাকু নেশার ঘোরে স্টেজে উঠে আলুর চপ দিয়ে এসেছিল– ‘এটা দিয়ে খা ভাই, এখনও গরম আছে।’ তারপর খোনা গলায় ‘জোছনা করেছে আড়ি, আসেনা আমার বাড়ি’ গাওয়া মহিলাকে ‘ইউ শাট আপ’ বলে মাইকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ‘তুম আ গয়ে হো, নুর আ গয়া হ্যায়’ গেয়ে ফাটিয়ে দেন। রাজসভায় স্যান্ডো গেঞ্জি পরা একজন সুবে বাংলার নবাবকে আলুর চপ দিয়ে মাল খাইয়ে সঞ্জীব কুমারের গান শোনাচ্ছে, এর সমতুল্য এক্সপেরিমেন্টেশন পৃথিবীর নাট্য-ইতিহাসে কখনও ঘটেছে আমার অন্তত জানা নেই। তবে ওই গায়িকা মহিলা খুব আপত্তি করেছিলেন। ‘আপনাদের ওই মাতাল ভদ্রলোক থাকলে পরের বার অন্য কাউকে ডাকবেন। আমার অমন সিচুয়েশনটা মাটি করে দিলে।’ তাতে অবশ্য কেউ পাত্তা দেয়নি। মহিলা সমস্ত পালায় একই পোশাক পরে ওই গানটাই গাইতেন। মর্জিনা-আবদাল্লায় ডাকাত সর্দারের সামনে স্লো মোশানে নেচে, আকবরের দরবারে গোলাপ হাতে, ভক্ত পেল্লাদে যমের সামনে কাঁপতে কাঁপতে, এমনকী, ২৬ জানুয়ারিতে ঝাঁসির রানিতেও এক পোশাক– সবেতেই ওই এক গান। তবে একবার হেবি কালোয়াতির মাঝে কে একটা চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘জোসনা কী কইরা আইবো, তগো বাড়িতে তো হালায় খাটা পাইখানা।’ তারপর যথারীতি তুমুল হট্টগোল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পড়ুন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের কলাম ‘ঋইউনিয়ন’: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
বড়রা নিজেরা প্লে করার পাশাপাশি শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি থেকে ক্লাবের দল আনিয়ে হোল নাইটও হত। পয়সা নিত না, গাড়ি ভাড়াও না। এই দলগুলোর নিজেদের এলাকায় এমনি বদনাম ছিল যে ৩০-৪০ কিলোমিটার তফাতে না গেলে স্টেজে উঠলেই অডিয়েন্স ‘নামাইয়া দে, নামাইয়া দে’ বলে চেঁচামেচি জুড়ত। সে সময় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে নানারকম গোঁজ প্রার্থী তুলে ম্যানেজ দেওয়াই রেওয়াজ ছিল। একটা ‘নিরমা’ সাজানোই থাকত– ভালো রেসপন্স পেলে এক রাতে সাত-আটবার নাচানো কোনও ব্যাপারই না। ‘নিরমা’ অর্থাৎ ‘ওয়াশিং পাউডার নিরমা।’ গোটা কনসার্ট ঢোল, কত্তাল, ফুলুট, কন্নেট, খোল, ব্যায়লা, এসরাজ, সারেঙ্গি, হাওয়াই গিটার, তবলা, সেতার সহযোগে জিঙ্গেলটি বাজানো হত, এবং ওরকমই সাদা পোশাক পরা একটি মেয়ে স্টেজময় নেচে নেমে যেত। গোটা অডিয়েন্সও নাচত তার সঙ্গে, গাইতও। সে যারা না দেখেছে, তাদের পক্ষে বিশ্বাস করাও অসম্ভব। মাটিগাড়া বাজারের উল্টোদিকের রেললাইন পেরিয়ে গ্রামটিতে লোকাল ক্লাবে এক ডজন ‘নিরমা লেডি’ স্টেজে তোলা হয়, গানটা বেজেছিল ৪০ মিনিট। গ্রামের লোকের রেলা কাকে বলে সেবার দেখেছিলাম। নিরমা সাজা মেয়েগুলোকে প্রেমপত্র লিখে হাত কাটা ছেলেদের দেখা যেত ঢুলুঢুলু চোখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু ফলস্ও ছিল। তারা দিনের বেলায় সিমপ্যাথি আদায় করে বিনা পয়সায় সিগারেট খেত আর অন্য মেয়েদের পিছনে লাইন মারত সন্ধের পর।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন সোহিনী সরকারের কলাম ‘সোলো’: কল্পনারা ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতার মতো
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
দিনু জেঠু এসবের ঊর্ধ্বে বিচরণ করতেন। সকালে সাড়ে আটটা নাগাদ জেঠিমা খাটেই চা দিতেন। তারপর উনি হেলতে-দুলতে সামনের রাস্তায় হাঁটুরেদের দাঁড় করিয়ে বাজার সেরে খবরের কাগজ নিয়ে বসতেন। এর মধ্যে আরও বার তিনেক চা খাওয়া হয়েছে। দশটা নাগাদ হাতে একটা ফোলিও পাকড়ে রাস্তার মোড়ে পৌঁছে কারও বাইকে চেপে স্টেট ট্রান্সপোর্ট বা রেলের ইয়ার্ডে কে জানে কীসের চাকরিতে বেলা সাড়ে বারোটা থেকে বড়জোড় একটা অবধি কাটিয়েই ফের বাড়ি। দুপুরে জেঠিমার সঙ্গে বসে না খেলে নাকি বদহজম হয়। বড় সাহেব নাকি রোজই বলতেন ‘দিনুবাবু, দুপুরের পর অমুক ফাইলটা একটু দেখে দেবেন।’ দিনু জেঠু ৪০ বছরের চাকরি জীবনে লাঞ্চের পর কখনও অপিস যাননি। খেয়ে বিছানায় আধশোয়া হতেন, জেঠিমা মুখে একটা পান গুঁজে দিয়ে বলতেন ‘রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিও, কাল আবার অপিস আছে।’ এরপর কোন শালা ওঁর মুখ থেকে হাসি মুছবে? বাঙালির সত্যিই ভয় পাওয়ার কোনও কারণ আছে কি না, ভেবে দেখা দরকার।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ভয়বাংলা পর্ব ১৮: বাঙালি কি আদৌ জানে তালেগোলে সে কী হারাইয়াছে?
ভয়বাংলা পর্ব ১৭: বাঙালি জীবনের ভেজিটেরিয়ান হওয়ার ভয়
ভয়বাংলা পর্ব ১৬: বাঙাল হওয়া সত্ত্বেও যারা রাবীন্দ্রিক বাংলায় কথা কইত, তারা মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না
ভয়বাংলা পর্ব ১৫: গুষ্টিসুখের প্লেজারই অর্জি-নাল সিন
ভয়বাংলা পর্ব ১৪: কৈশোরে জাতের খোঁজ কেউ কখনও নিয়েছে বলে মনে পড়ে না
ভয়বাংলা পর্ব ১৩: নবনাৎসিগুলোর কাছে আর একটু সফিস্টিকেশন এক্সপেক্ট করেছিলাম মশাই
ভয়বাংলা পর্ব ১২: রাজসভায়, থুড়ি, লোকসভায় কেবল পাশা-খেলাটুকু হবে
ভয়বাংলা পর্ব ১১: আমাগো জয়ার বরের ফিগারটা দ্যাখোনের মতো হইসে
ভয়বাংলা পর্ব ১০: ভূতেরাও ঢিল ছোড়ে, মানুষও রেডি রাখে পাথরের স্টক
ভয়বাংলা পর্ব ৯: চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’-এর খুদে স্টোনম্যান জানলার শার্শি ভেঙেছিল খাবার জুটবে বলেই
ভয়বাংলা পর্ব ৮: ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা লোকেদের সংখ্যা আশ্চর্যরকম বৃদ্ধি পেল
ভয়বাংলা পর্ব ৭: প্রত্যেকেরই মনে হতে থাকে সে-ই অদৃশ্য ঘাতকের একমাত্র টার্গেট
ভয়বাংলা পর্ব ৬: হাতের নাগালে একখানা জলজ্যান্ত বন্দুক চালানো লোকই ছিল সহায়
ভয়বাংলা পর্ব ৫: স্টোনম্যানের একটুকরো খুনে স্টোন বাড়িতে থাকলেই সর্বরোগ থেকে মুক্তি!
ভয়বাংলা পর্ব ৪: ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর
ভয়বাংলা পর্ব ৩: বাঙালি ভূত-পেতনিরাও ভারি শুচিবায়ুগ্রস্ত!
ভয়বাংলা পর্ব ২: তবু সে দেখিল কোন ডাইনোসর!
ভয়বাংলা পর্ব ১: বাঙালির ভূতের ভয় যেন উত্তম-সুচিত্রার মতোই সাংস্কৃতিক
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………