রবীন্দ্র সদনের এক কর্মচারী এসে বললেন, ‘দাদা, আপনার সঙ্গে সুবিমল গোস্বামী একটু দেখা করতে চান।’ আমি বললাম, ‘সুবিমল গোস্বামী কে?’ একথা বলতে বলতেই আমার জ্ঞান ফিরেছে! ‘চুনীবাবু! চুনী!’ ভদ্রলোক বললেন, ‘হ্যাঁ’। ‘কী আশ্চর্য! আপনি ওঁকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন!’ আমি ছুট্টে গিয়ে দরজা খুললাম। দেখলাম দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমার হিরো, আমার ভালোবাসা– চুনী গোস্বামী!
আমার জন্ম ১৯৪৯ সালে, কটকে। মাত্র সাড়ে ৪ বছর বয়সে চলে আসি কলকাতায়। ‘ফুটবল’ নামে যে একটা খেলা রয়েছে, তা কটকে থাকাকালীন বিন্দুমাত্র জানতে পারিনি। কলকাতায়, ওই বছর পাঁচেক বয়সে, প্রথম ফুটবল দেখলাম। আমার ফুটবল খেলা সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয় আরও বছর দুই পেরিয়ে। আর সত্যি বলতে, আশপাশের সবাই– আমাদের পাড়ায়, তখনকার ওই মুদিয়ালিতে মোহনবাগানের সাপোর্টার থইথই করছেন। তাঁদের দেখাদিখি, আমিও মোহনবাগানের সাপোর্টার। খুবই জোরালো সমর্থক আর কী! আর মোহনবাগানের হিরো ছিলেন ‘চুনী’। ‘সুবিমল গোস্বামী’ নামটা সকলেই জানত, কিন্তু ডাকা হত ‘চুনী গোস্বামী’ বলেই। আদর করে বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেই ‘চুন্নু মিঁয়া’ও বলতেন কেউ কেউ। চুনী গোস্বামীকে কী প্রচণ্ড যে ভালোবেসেছি, আমার বন্ধুবান্ধবরাই জানে। আমার সারাজীবনের বিরাট বিরাট বিরাট মাপের অণুপ্রেরণা তিনি।
ছোটবেলায় কী একটা সিনেমা দেখতে গিয়ে, নিউজ রিলে দেখেছিলাম আফগানিস্থান বনাম ভারতের ফুটবল ম্যাচ। সেই ম্যাচে একটাই গোল হয়েছিল। সেই একটিমাত্র গোল করেছিলেন আমাদের চুনী গোস্বামী। বোধহয় সেটা, প্রি-অলিম্পিকস বা কিছু। এমনই পাগল ছিলাম আমরা, যে, সরস্বতী পুজোর ফুল-পাতা যেরকম বইয়ের মধ্যে রাখা হত, আমরা রাখতাম চুনী গোস্বামীর ছবি। খবরের কাগজ থেকে কেটে, পড়ার বইয়ের মধ্যে রেখে দিতাম তাঁর ছবি। বিশেষ করে, অঙ্ক বইয়ের মধ্যেই, কারণ অঙ্কে ফেল করতাম।
আমাদের পাড়ায়, ইস্টবেঙ্গলের যাঁরা সাপোর্টার ছিলেন, চুনীর প্রতি তাঁদের রাগ ছিল প্রবল। কেন? ওঁরা বলতেন, চুনী পূর্ববঙ্গীয়। তাতে কিছু আসে-যায় না। আমি পশ্চিমবঙ্গীয়। আমি বুঝেছিলাম, চুনী গোস্বামী মানেই মোহনবাগান, আর মোহনবাগান মানেই চুনী গোস্বামী।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আমি যখন বাংলা খেয়াল গাইতে শুরু করেছি, যে ব্যাপারে আমি ছোট থেকেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তখন অনেকেই বলেছেন, ‘কেন খেয়াল? এ তো আধুনিক গানের লোক।’ তখন আমার চুনী গোস্বামীর কথা মনে হয়েছে। একজন মানুষ ছিলেন যিনি ফুটবল খেলে আমাদের উন্মাদ করে দিয়েছিলেন। আমাদের গর্ব, ভারতের গর্ব, ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক তিনি। সেই চুনী গোস্বামী একদিন, পরিণত বয়সে, ফুটবল থেকে ক্রিকেটে এলেন। রঞ্জি ট্রফি খেললেন। আমি যদ্দুর জানি, বাংলা দলের অধিনায়কও হয়েছিলেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
একদিন, বাংলা আধুনিক গানে আমি নাম করে গেলাম। তখন অনেকেই আমাকে দিয়ে চ্যারিটি শো করাতেন। তাদের মধ্যে ছিল উয়াড়ি ক্লাব-ও। অনেক খেলোয়াড় উয়াড়ি ক্লাবে ঢুকে পরে অন্য বড় দলে চলে যেতেন। সেই উয়াড়ি ক্লাবের চ্যারিটি শো-তে আমি একক অনুষ্ঠান করছি রবীন্দ্রসদনে। আমি একা, আমার সঙ্গে কেউ বাজাতেন না। গিটারটা একটু দেখছি, মকশো করছি গ্রিন রুমে বসে। এমন সময় রবীন্দ্র সদনের এক কর্মচারী এসে বললেন, ‘দাদা, আপনার সঙ্গে সুবিমল গোস্বামী একটু দেখা করতে চান।’ আমি বললাম, ‘সুবিমল গোস্বামী কে?’ একথা বলতে বলতেই আমার জ্ঞান ফিরেছে! ‘চুনীবাবু! চুনী!’ ভদ্রলোক বললেন, ‘হ্যাঁ’। ‘কী আশ্চর্য! আপনি ওঁকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন!’ আমি ছুট্টে গিয়ে দরজা খুললাম। দেখলাম দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমার হিরো, আমার ভালোবাসা– চুনী গোস্বামী!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: জনপ্রিয়তাকে দেবারতি মিত্র নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন স্থির পরিশ্রমের একাগ্র আগুনে
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ছোটবেলা থেকে যদি কাউকে ‘হিরো’ ভাবি আমি, তিনি তো চুনী গোস্বামীই। আমি প্রায় কেঁদেই ফেলতাম। তখন আমার কিন্তু ৪৪-৪৫। আমি সোজা ওঁর পায়ে পড়ে গেলাম। কোনও কথাবার্তা নেই, সটান ধুপ করে ওঁর পায়ে পড়ে গেলাম। উনি বললেন, ‘করেন কী! করেন কী!’ আমিও বললাম, ‘আপনিই বা করেন কী! আপনি ভেতরে আসুন, আপনি জানেন না কী হচ্ছে আমার বুকের ভেতরে!’ সেই প্রথম চুনী গোস্বামীকে এত কাছ থেকে দেখছি। এর আগে, মাত্র একবার, খেলার মাঠে। আমরা দু’জন দু’জনকে খানিকক্ষণ জড়িয়ে ধরলাম। আমার জীবনের পবিত্রতম মুহূর্তগুলোর একটা। একটা রোমান্টিক মুহূর্ত।
আমি যখন বাংলা খেয়াল গাইতে শুরু করেছি, যে ব্যাপারে আমি ছোট থেকেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তখন অনেকেই বলেছেন, ‘কেন খেয়াল? এ তো আধুনিক গানের লোক।’ তখন আমার চুনী গোস্বামীর কথা মনে হয়েছে। একজন মানুষ ছিলেন যিনি ফুটবল খেলে আমাদের উন্মাদ করে দিয়েছিলেন। আমাদের গর্ব, ভারতের গর্ব, ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক তিনি। সেই চুনী গোস্বামী একদিন, পরিণত বয়সে, ফুটবল থেকে ক্রিকেটে এলেন। রঞ্জি ট্রফি খেললেন। আমি যদ্দুর জানি, বাংলা দলের অধিনায়কও হয়েছিলেন।
চুনী গোস্বামী যেমন ফুটবল থেকে ক্রিকেটে এসেছেন পরিণত বয়সে, এই অধম, কবীর সুমন কেন বাংলা আধুনিক গান থেকে বাংলা খেয়ালে আসতে পারবে না? এতে এত বিস্মিত হওয়ার সত্যিই কি কিছু আছে! এই ২০ জানুয়ারি, রাজ্য ক্লাসিকাল মিউজিক কনফারেন্সে আমি পূর্ণাঙ্গ বাংলা খেয়াল গাইতে উঠব। জানি বহু লোক প্যাঁক দেবেন। কিন্তু আমি তাঁদের কথা নিশ্চিন্তে উড়িয়ে দেব এই বলে যে, ‘আমি, কবীর সুমন– চুনী গোস্বামীর শহরের লোক!’
আমাকে মাঝে মাঝে বম্বে ডাইং-এর ফ্যাক্টরিতে পাঠাতেন মিসেস ওয়াড়িয়া। তোয়ালে, বিছানা চাদর, বালিশের ওয়াড় এমনকী, লুঙ্গিরও ডিজাইন। শিল্পের এই বিচিত্র ব্যবহার ভুলব না। লোকে বলে, ফ্যাশন ধনীদের জন্য। আসলে সমস্ত কিছুই শেষ পর্যন্ত চাপানো হয় দরিদ্র শ্রেণি আর সাধারণ নাগরিকের ঘাড়ে।