ভারত সরকারের ‘ডায়রিয়া কন্ট্রোল বোর্ড’ দেশজুড়ে, বিশেষ করে গ্রামেগঞ্জে, ডায়রিয়াজনিত শিশু মৃত্যু,(বছরে প্রায় দেড় লাখ) রোখার জন্যে খাবার আগে হাত ধোয়ার ওপর প্রচার শুরু করে। সুতরাং খাবার আগে হাত ধোয়ার ব্যাপারটা মানুষের মনে থিতু হচ্ছিল। এই সমস্ত পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিচার করে বিজ্ঞাপন উদ্ভাবক একটি জবরদস্ত আইডিয়া ভেবে ফেললেন। লাখ লাখ মানুষ খাওয়ার জন্যে রুটি নেবেই। আর ওই রুটিতে যদি লাইফবয়-এর বিজ্ঞাপনী বক্তব্য লিখে দেওয়া যায়?
২২.
যে কোনও ব্র্যান্ড তৈরি করতে বা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতে একটা মাধ্যম বা মিডিয়ার প্রয়োজন হয়। যেমন সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, হোর্ডিং, রেডিও কিংবা টেলিভিশন। এছাড়াও আছে নানারকম আনকনভেনশনাল মিডিয়া। তা বলে রুটি? হ্যাঁ, রুটি।
সারা দুনিয়ার বিজ্ঞাপন জগৎকে চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটাল আমাদের এই দৈনন্দিন খাদ্য– হাতে গড়া রুটি। রুটি কীভাবে মিডিয়া হয়ে গেল এবং একটি ব্র্যান্ডকে সুপ্রতিষ্ঠিত করল, এবার তার গল্পই বলি।
কুম্ভ মেলা বিশ্বের সবথেকে বড় একটি ধর্মীয় মেলা, যা আমাদের দেশেই সম্ভব। এই মেলায় প্রায় ১০ কোটি মানুষ অংশ নেন। বিজ্ঞাপনী ভাষায় ‘ক্যাপটিভ অডিয়েন্স’কে একজায়গায় পাওয়া একটা বিরাট ব্যাপার। এই সুযোগ তো ছাড়া যায় না। তাই সাধারণ ব্যবহার্য্য যত প্রোডাক্ট আছে, মাথার চুল থেকে ভাতের চাল– সব প্রোডাক্ট নিয়ে কোম্পানিগুলো হাজির। আর এই লক্ষ লক্ষ মানুষ বা খদ্দেরের নজর কাড়ার জন্য সব প্রোডাক্টের মধ্যে গুঁতোগুঁতি চলে। ২০১৩ সালে এমনই এক মহা কুম্ভ মেলায় আমাদের চিরপরিচিত ‘লাইফবয়’ সাবান ঠিক করল এক নতুন ধরনের বিজ্ঞাপন করবে, যা মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াবে, সঙ্গে নজরও কাড়বে । বিজ্ঞাপনের উদ্ভাবনী শক্তিধর একটি সংস্থার ওপর ভার পড়ল এই নতুন ভাবনা নিয়ে কাজ করতে।
আমি আগেও বলেছি– যাঁরা বিজ্ঞাপনে ক্রিয়েটিভ কাজ করেন, তাঁদের জনতার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সব কিছু নজরে রাখতে হয়। কোথা থেকে যে আইডিয়া আসবে, কে জানে! বিজ্ঞাপন ভাবার আগেই জানতে হবে কাদের জন্যে বিজ্ঞাপন, তাদের বিহেভোরিয়াল প্যাটার্ন, গতিপ্রকৃতি– সব জানা দরকার। দেখা গেছে যে, এই ধরনের মেলায় পুণ্যার্থীদের খাওয়ানোর জন্য পুণ্যালোভাতুর ধনী ব্যবসায়ীরা প্রচুর লঙ্গরের ব্যবস্থা করেন। বিনা খরচে ডাল, রুটি, সবজি বিতরণ করেন। এবং এক বিশাল সংখ্যক পুণ্যার্থী ওইসব লঙ্গরে ভিড় করেন খাবারের জন্যে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রুটির ওপর বক্তব্য কীভাবে যাবে? এটাও একটা ইউনিক অবজারভেশন। দেখা গেছে যে, রুটি সেঁকার সময়, যেখানে আঁচটা লাগে, সেখানটা পুড়ে যায়। এই ক্লুটা নিয়ে তৈরি হল হিটার, যার কয়েলটা লাইফবয়ের বক্তব্য ফলো করে তৈরি হল। এবার হিটারটা গরম অবস্থায় যখন রুটির ওপর চাপ দিচ্ছে, তখনই কয়েলে লেখা বক্তব্যটা রুটির ওপর ফুটে উঠছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আইডিয়াটা এই অবজারভেশন থেকে উদ্ভব হল। সবাই রুটি নেবেই। ‘লাইফবয়’ সবসময় বিজ্ঞাপনে স্বাস্থ্য ভালো রাখার কথা বলে। এবং এটা মোটামুটি সব ‘লাইফবয়’ ক্রেতাই জানেন। ঠিক এই সময় ভারত সরকারের ‘ডায়রিয়া কন্ট্রোল বোর্ড’ দেশজুড়ে, বিশেষ করে গ্রামেগঞ্জে, ডায়রিয়াজনিত শিশু মৃত্যু,(বছরে প্রায় দেড় লাখ) রোখার জন্য খাবার আগে হাত ধোয়ার ওপর প্রচার শুরু করে। সেসময় টিভির সব চ্যানেলে এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞাপন দেখানো হত। সুতরাং, খাবার আগে হাত ধোয়ার ব্যাপারটা মানুষের মনে থিতু হচ্ছিল। এই সমস্ত পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিচার করে বিজ্ঞাপন উদ্ভাবক একটি জবরদস্ত আইডিয়া ভেবে ফেললেন। লাখ লাখ মানুষ খাওয়ার জন্যে রুটি নেবেই। আর ওই রুটিতে যদি লাইফবয়-এর বিজ্ঞাপনী বক্তব্য লিখে দেওয়া যায়? যেমন ভাবা তেমন কাজ। একশো লঙ্গর ঠিক করা হল, যেখান থেকে এই ক’দিনে ৫০ লক্ষ রুটি বিতরণ করা হবে।
এবার রুটির ওপর বক্তব্য কীভাবে যাবে? এটাও একটা ইউনিক অবজারভেশন। দেখা গেছে যে, রুটি সেঁকার সময়, যেখানে আঁচটা লাগে, সেখানটা পুড়ে যায়। এই ক্লুটা নিয়ে তৈরি হল হিটার, যার কয়েলটা লাইফবয়ের বক্তব্য ফলো করে তৈরি হল। এবার হিটারটা গরম অবস্থায় যখন রুটির ওপর চাপ দিচ্ছে, তখনই কয়েলে লেখা বক্তব্যটা রুটির ওপর ফুটে উঠছে। এইভাবে বক্তব্য লেখা কয়েল দিয়ে হাজার হিটার তৈরি হল, আর হাজার খানেক ভলান্টিয়ার দিয়ে রুটিতে ছাপ মারার কাজ চলল। রুটি নিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষ যে-ই খেতে বসছে, দেখেছে রুটির ওপর হিন্দিতে লেখা ‘খাবার আগে লাইফবয় দিয়ে হাত ধুয়েছেন তো?’
দেখুন, কী বুদ্ধি করে বিজ্ঞাপনী বক্তব্য ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, যাতে স্বাস্থ্যরক্ষার ওপরও জোর দেওয়া হচ্ছে। সত্য-মিথ্যের অনেক ওপরে এক নির্মল স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রোডাক্টের সঙ্গে মিশিয়ে কী বুদ্ধিদীপ্ত পরিবেশনা! ভাবা যায়? এই হল ক্রিয়েটিভিটি বা ব্র্যান্ডিংয়ের জাদু। ফ্রান্সের Cannes Advertising Festival, যেখানে পৃথিবী জোড়া বিজ্ঞাপনের সেরার সেরা বাছা হয়, সেখান থেকে সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞদের চমক লাগিয়ে আমাদের রুটি আর লাইফবয় সেরার সেরা পুরস্কার নিয়ে ইতিহাস তৈরি করল। সার্থক হল ব্র্যান্ড বাজানো।
ব্র্যান্ড বাজাও-এর অন্যান্য পর্ব
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ২১: বিজ্ঞাপনের সুভাষিত ছড়া
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ২০: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আশ্চর্যজনক ‘সুপারব্র্যান্ড’ বলতে দ্বিধাবোধ করব না
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৯: ফ্লুরিজকে টেক্কা দিয়েছিল যারা
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৮: কথাবার্তা নেই, স্রেফ গন্ধই খাবারের বিজ্ঞাপন
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৭: বাড়িতে আগুন লাগলে আপনি কি চকোলেট খাবেন?
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৬: বিজ্ঞাপনের গোলকধাঁধায় চিকিৎসাও পণ্য!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৫: বাঘ-ছাগলকে একঘাটে জল খাওয়াতে পারে যে চা
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৪: বিষ বিক্রি করে মিলিয়ান ডলারের মালিক!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৩: বুকের দুধের বাজার গরম, ৩০০ মিলিলিটার ৪৫০০ টাকা!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১২: গেরুয়া লুঙ্গির কাছে গোহারান হেরেছে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১১: ধর্মতলার সেই ভিক্ষুক যে বিজ্ঞাপনের কড়া স্ট্রাটেজিস্ট
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১০: ‘টাটকা’ সবজি ‘জ্যান্ত’ বললে বিক্রি বাড়ে, এটাও বিজ্ঞাপন
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৯: সে যাত্রায় বন্দুকের নল থেকে রক্ষা করেছিলেন সুনীল গাভাসকর
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৮: যে কোম্পানির নামে আস্ত একটা নগরী!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৭: এক সামান্য নাপিতের উদ্যোগ ও চেষ্টা
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৬: মহাকাশচারীদের জন্য বানানো টুথপেস্টে এখন শিশু ও পোষ্যদের দাঁত মাজানো হয়
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৫: একখানা লিপস্টিক প্রায় দেড় কোটি টাকা!
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৪: ইস চাম্পি মে বড়ে বড়ে গুণ
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ৩: ‘ওরে ব্লোরীন লাগা’
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ২: বাংলাভাষায় প্রথম সার্থক বুদ্ধিদীপ্ত বিজ্ঞাপন, রবীন্দ্রনাথও দিয়েছিলেন শংসাপত্র
ব্র্যান্ড বাজাও। পর্ব ১: ৫০০০ বছর আগেই ছিল ব্র্যান্ডিংয়ের ধারণা!