‘কোহরা’-র পর থেকে শুভেচ্ছাবার্তায় ভরে গিয়েছে তাঁর ফোন। অন্তরে বাঙালি এই অভিনেত্রী কেরিয়ারের সন্ধিক্ষণে সুযোগ পেয়েছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে কাজ করার।
বাংলা হরফে টাইপ করা মেসেজ এল একাবলী খান্নার কাছ থেকে। সত্যি অবাক হয়েছি।
অদ্ভুত কিছু নয়। এটাই তো স্বাভাবিক। আমি কলকাতার মেয়ে, এখানেই বড় হয়েছি। স্কুলেও বাংলা আমার থার্ড ল্যাঙ্গোয়েজ ছিল। আর আমি মনে করি, ভাষাটা অনুশীলনের বিষয়। হয় সেটা মুখের কথায় বা লেখায়। প্র্যাকটিস চলে গেলে ভাষার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কাজেই অভ্যাস জারি রাখার জন্যই এটা করি। আমি অত বাংলা বই পড়িনি, কিন্তু এটা করি। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসিও করে যে, ও তো বেশি বাঙালি। যদিও আমার ছেলেদের সঙ্গে ইংরেজি বা হিন্দিতেই বেশি কথা হয়, তবে আমি বিশ্বাস করি আমার বাংলা পাঞ্জাবির থেকে বেটার। বলতে পারি কিন্তু ভাবতে পারি না পাঞ্জাবিতে, বেটার পারি বাংলায়।
‘কোহরা’ সিরিজ নেটফ্লিক্সে আসার পর সবাই তো আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আপনি কেমন প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন?
কেউ যদি ভাল বলে, অফকোর্স ভালই লাগে (হাসি)। আমার চরিত্রটা কিন্তু খুবই ইন্টারনাল। আমি যেভাবে চরিত্রটা প্রসেস করেছি, যে গাইডেন্স পরিচালকের কাছ থেকে পেয়েছি, যেভাবে চরিত্রটা দাঁড়িয়েছে– লোকে সেটা অনুভব করেছে। ‘ইন্দিরা’-র চরিত্র ইজ আ ক্যারেক্টার টু বি ফেল্ট।
টলিউড থেকে ফোন-টোন পেয়েছেন?
(হাসি) হ্যাঁ, ‘কোহরা’-র জন্য যত ফোন পেয়েছি, তার আগে খুব কমই পেয়েছি। নিশ্চয়ই, বুম্বাদা আগে আমার কাজ দেখে টেক্সট করেছেন। ইট’স অলওয়েজ নাইস টু গেট এনকারেজমেন্ট। আমার একটা ছবি ছিল ‘হোয়াট উইল পিপল সে’, সেটা অস্কারে অফিসিয়াল এন্ট্রি ছিল নরওয়ে থেকে। যেটায় আমি, আদিল হুসেন আরও অনেকে ছিলেন। ওটার সময় সৃজিত (মুখোপাধ্যায়) জানিয়েছিল। আবার ‘বম্বে বেগমস’-এর সময়েও কয়েকজন জানিয়েছিল। দু’-তিনজন আছে, যারা অ্যাপ্রিশিয়েট করেছিল। তবে ‘কোহরা’-র ক্ষেত্রে দেখলাম অনেকেই টেক্সট করেছে বা জানিয়েছে ভাল লাগার কথা। একটা খুব কমন ওপিনিয়ন যে, কেউ ভাবেনি আমি এই ধরনের চরিত্র করতে পারি। টলিউডে বিশেষ করে একটা পারসেপশন আছে যে, একাবলী মানেই সফিস্টিকেশন, পলিশড, ইংলিশ স্পিকিং চরিত্রে পারবে। এমন হয়েছে গোটা ছবিতে চারটে সংলাপ আছে ইংলিশে। ব্যস, একটু ডেকে নে একাবলীকে, করে দেবে। আউট অফ রেসপেক্ট বা বন্ধুত্বের খাতিরে আমি অনেকবার করেও দিয়েছি। সেটা হয়তো আমার কেরিয়ারের জন্য খারাপই হয়েছে, অন্তত বাংলায়।
আগে যা করেছেন, তার থেকে ‘কোহরা’-য় আপনার চরিত্রটা একেবারে আলাদা। একজন বিধবা-পাঞ্জাবি মহিলার চরিত্র, সেটা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। ইনফ্যাক্ট প্রত্যেকটা রোলই চ্যালেঞ্জিং যদি তুমি সততার সঙ্গে করো। একটা প্রসেস থাকে, ইন্টারনালাইজ করতে হয়, ব্যাকস্টোরি থাকে। বোঝার খুব প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে এমন একটা সিরিজের ক্ষেত্রে, যেটা লেখা হয়েছে এত সুন্দরভাবে। ‘ইন্দিরা’-র ক্ষেত্রে অনেকটা হোমওয়ার্ক করা ছিল, কারণ লেখকরা দুরন্ত। আর পরিচালক রণদীপ ঝা আগে ‘ট্রায়াল বাই ফায়ার’ বা ‘হালাল’ করেছেন। শো রানার সুদীপ শর্মা, তিনি আগে ‘পাতাললোক’ করেছেন। ওঁদের কাজ থেকে আমি অনেকটা নারিশমেন্ট পেয়েছি। এবার সেটা ব্যবহার করাই আমার দক্ষতা। আর সেটা আমি করে উঠতে পেরেছি। ইট’স আ হার্টব্রেকিংলি বিউটিফুল ক্যারেক্টার। প্রচুর লেয়ার আর নুয়ান্সেস আছে চরিত্রটায়।
নিজের সঙ্গে ইন্দিরার মিল বা অমিল পেয়েছেন?
হ্যাঁ, অ্যাজ অ্যান অ্যাক্টর আমরা তো নিজের জীবন থেকে নিই। কখনও কোনও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে অভিনয় করি না, বললে মিথ্যে বলা হবে। আমি জীবনে অনেক বছর একাই থেকেছি। একা থাকা অদ্ভুত জিনিস, ইট এমপাওয়ার্স ইউ ইন মেনি ওয়েজ। নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক জোরালো করতে সাহায্য করে। অ্যান্ড ইয়েস, দেয়ার ইজ আ লংগিং। সেই প্রতীক্ষার যে এনার্জি থাকে, সেটা আমি নিজের জীবনে বেশি ফিল করেছি। যেটা আমি চরিত্রের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছি এখানে, হয়তো বা সাবকনশাসলি।
কীরকম ভাবে এসেছিল চরিত্রটা?
‘কাস্টিং-বে’ এজেন্সির মাধ্যমে। ওরাই ‘হোয়াট উইল পিপল সে’-র কাস্টিং করেছিল, ওরাই কল করে রাফ আইডিয়া দিয়েছিল। মিত্রেশ বলে একটি ছেলে এক্সপ্লেন করেছিল যে, চরিত্রটা কীভাবে ধরব অডিশনে। শুনেই আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। ওই শোনাটা কাজে দিয়েছিল, সুরটা ধরে নিয়েছিলাম। যাঁরা বানিয়েছে, সবাই সিজন্ড। এবং ফাইন ফিল্মমেকার। ফলে এঁদের আমাকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বেশি সময় লাগেনি। আর এটা অনুষ্কা শর্মার প্রোডাকশন, খুবই স্ট্রাকচার্ড, ট্রান্সপ্যারেন্ট আর পজিটিভ।
হিন্দিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবিতে কাজ করেছেন। যেমন, ‘কৌন কিতনে পানি মে’ বা ‘ডিয়ার ড্যাড’ বাংলাতে ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’-এর মতো ছবিতে ছিলেন। তবু টলিউডে আরও বেশি সুযোগ পাওয়া কি উচিত ছিল না? কী মনে করেন?
‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ নিয়ে আমি এখনও সঞ্জয় নাগের সঙ্গে হাসাহাসি করি যে, ‘তুমি আমাকে দেড়টা সিন দিয়েছিলে, সেই ঋণ একদিন তোমাকে শোধ করতে হবে।’ ছবিটা আমার ভীষণ স্পেশাল। কারণ, ঋতুদার (ঋতুপর্ণ ঘোষ) সঙ্গে কাজ করার ওটাই একমাত্র সুযোগ ছিল। ঋতুদা আমাকে ‘ডাব’ করা শিখিয়েছিল। আজ যখন মুম্বইয়ে ডাব করি, সবাই বলে – ইউ আর ভেরি ফাস্ট। তখন গর্ব হয়। যদিও ওখানে এখন বেশিরভাগটাই সিঙ্ক সাউন্ডে কাজ হয়। কিন্তু আমি স্বীকার করছি যে, টলিউড আমাকে সেভাবে ইউটিলাইজ করেনি। সেটা আমি গ্রেসফুলি অ্যাকসেপ্ট করেছি। আমার কোনও ক্ষোভ বা অভিমান নেই। বিশ্বাস করি, লাইফ ইজ নট ওভার ইয়েট। আমার প্রথম কাজ শুরু বাংলা ধারাবাহিক ‘এখানে আকাশ নীল’ দিয়ে। টিআরপি খুব পাওয়ারফুল জিনিস এবং নট ইন আ গুড ওয়ে। এটা আমি ওপেনলি বলি। টিআরপি-র চক্করে টেলিভিশনের কনটেন্ট রিগ্রেসিভ দিকে চলে গেল। তারপর ওই ধরনের কনটেন্টে আমার স্যাটিসফ্যাকশন হত না, আর ওরাও আমাকে নিতে পারত না। কাজ ছিল না তারপর। সেই সময়টা নিজের ওপর কাজ করলাম। আমার তখন ডিভোর্স হয়েছিল, সংসারটা কিছুটা গোছালাম, তাছাড়া দু’জন সন্তান, তাদের দায়িত্ব নেওয়া… জীবনটাই তো পাল্টে গেল।
সিঙ্গল মাদার হিসেবে আপনি যে দুই সন্তানকে বড় করেছেন, সেই জায়গাটা সকলে সম্ভ্রমের চোখে দ্যাখে।
অনেক ভালবাসা পেয়েছি ইন্ডাস্ট্রি থেকে। সেটা কাজে রিফ্লেক্ট না করলেও অনেক স্নেহ পেয়েছি। এমনকী, আমার ছেলেরাও আদর পেয়েছে এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে। এই তো কিছুদিন আগে সৃজিতের একটা হিন্দি কাজ করলাম শান্তিনিকেতনে, সেখানেও জিজ্ঞেস করছে– দিদি, ছানারা কেমন আছে? এদিকে একজন এখন ছ’ফুট তিন ইঞ্চি, অন্যজনও বড় হয়ে গেছে (হাসি)।
আদতে আপনি পাঞ্জাবি-গোয়ান পরিবার থেকে এসেছেন। বাংলা পড়তে-লিখতে পারেন। সেখানে সুযোগ কম পেয়েছেন বলে রাগ হয় না?
আমি টিপিক্যাল বেঙ্গলি মাদার (হাসি)। একটা বয়সের পরে খুব হ্যাপিনেস বা স্যাডনেস হয় না। ম্যাচিওরিটি সেটাই দেয়। তাই বলব আমি খুশি। ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ। মাঝে মাঝে কাজ পাই, এখানে তো পাই-ই না। সেটা নিয়ে অসন্তুষ্ট হওয়া বা দুঃখ পাওয়ার মানে হয় না। আমি আজ অবধি কাউকে কাজের জন্য ফোন করে বলতে পারিনি। সৃজিতকে ২০০৯ সাল থেকে চিনি, ‘চ্যাপলিন’ বলে একটা ছবিতে আমরা অভিনয়ও করেছিলাম। কিন্তু আজ অবধি কখনও ওকে বলিনি। এই যে কাজটা করলাম, সেটার সূত্র আমি আগে বিবিসি-র সঙ্গে আগে কাজ করেছিলাম, যারা সৃজিতের এই শো-টা করছে। ওরাই আমার কথা সাজেস্ট করে। সৃজিতও বলে যে ভাল, হ্যাঁ আমাকে নেওয়া যায়। বম্বেতে কিন্তু টাইপকাস্টিং হয়নি। সেখানে কিন্তু এলিট চরিত্র থেকে গ্রামের মহিলা, পুলিশ অফিসার, দক্ষিণী মহিলা, পাকিস্তানি চরিত্রও করেছি। আমি তো ইন্টারস্টেট-ইন্টারফেথ, আমার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র তো ডিএন-এ-তে আছে। সেটা মুম্বই ব্যবহার করেছে। এখন অরিন্দম ভট্টাচার্যর ‘দুর্গাপুর জাংশন’-এ কাজ করছি।
এই সময় দাঁড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়াকে কতটা গুরুত্ব দেন?
ওটা এনজয় করতে চাই। কিন্তু আমার জীবনের লক্ষ্য ফলোয়ারকে প্লিজ করা নয়। সবাই বলে, রিল্স না করলে কী হবে! অনুরাগীদের আনন্দ দেওয়ার জন্য যেটা আমি না, সেটা হতে পারব না (হাসি)।
যখন আমরা, তথা সকল ব্যতিক্রমী লিঙ্গ-যৌনমানস ঠিক করব কোন ধরনের স্বাধীন সিদ্ধান্ত আমরা নেব, কিংবা জড়বৎ বাঁচা থেকে নিজেদের বের করে নিয়ে এসে, অপরের সিদ্ধান্তকে নিজের বলে প্রচার করা বন্ধ করব, তখন-ই আমাদের এই জড়বৎ অস্তিত্ব, অপরের শর্তে তৈরি করা জগৎ থেকে মুক্ত পাব।