সুমনের সঙ্গে প্রথম বন্ধুত্ব হল সুদূর জার্মানির কোলন বিমানবন্দরে আমার ‘ওয়ান অ্যান্ড ওনলি’ জগন্নাথের সূত্রে। আমাকে ‘রিসিভ’ করতে সুমন এসেছিল নতুন দেশে জগন্নাথের পথপ্রদর্শক হয়ে। জলের মতো জার্মান বলে, যে কোনও বাংলা গান ওর ঠোঁটস্থ, রবীন্দ্রনাথের গান ওর গলায় নেশা ধরানো, রসবোধ সীমাহীন। কোথায় একটা ওয়েভলেন্থের মিল ছিল ওর সঙ্গে। সন্ধেগুলো বা ছুটির দুপুরগুলো উড়ে যেত জমাট আড্ডায়, গানে, হাসাহাসিতে। কত কী আলোচনা হত! ৭৫-এর কবীর সুমন আমার সেই গানের বন্ধু, যে ‘দুঃখ সুখের এপারে ওপারে দোলায় আমার মন’, আর ‘অকারণ অশ্রু সলিলে ভরে যায় দু’ নয়ন’!
কী-ই কাণ্ড, কবীর সুমন না কি ৭৫! এই একটি বিষয় নিয়ে আমার প্রচুর ধন্দ আছে মনে। ওঁর নানা কথায়, বিশেষ ভাবে গানে তো কতবারই মনে হয়েছে– ইনি আমাদের সময় থেকে অনেক অনেক এগিয়ে আছেন। কখনও ভেবেছি, ঠিক সময়ে ঠিক কথাটা বলা বা তাঁর প্রতিবাদী উচ্চারণ, যে কোনও তরুণকে লজ্জা দেয়, আর ক্রমশ মনে হয়েছে, রাগ-মেশা অভিমান তথা আত্মাভিমান প্রকাশে উনি শিশুকেও হার মানান।
কাজেই কোন খোপে রাখি ওঁকে? বললেই হল, কবীর সুমন ৭৫!
আমরা প্রায় অর্ধেক জীবন পরস্পরকে চিনি। একটা সময় আকাশবাণী ভবনে আমার আসা-যাওয়া ছিল নিয়মিত, তখন সেখানে ওকে দেখেছি বহুবার, কিন্তু আলাপ ছিল না আমাদের। ওর সঙ্গে প্রথম বন্ধুত্ব হল সুদূর জার্মানির কোলন বিমানবন্দরে আমার ‘ওয়ান অ্যান্ড ওনলি’ জগন্নাথের সূত্রে। আমাকে ‘রিসিভ’ করতে সুমন এসেছিল নতুন দেশে জগন্নাথের পথ প্রদর্শক হয়ে। কোলন শহরে আমার স্বল্প ক’দিনের অবস্থান সুমন, ওর পরিজন এবং বন্ধু গোষ্ঠীর আতিথ্যে মধুর হয়ে আছে। সপ্তাহে তিনদিন তো আমাদের দেখা হতই, কারও-না-কারও বাড়িতে অথবা দয়েচভেল ক্যান্টিনে। সুমন তখন ওই বিশ্ব-বিশ্রুত বেতার কেন্দ্রের বাংলা বিভাগে কর্মরত, আর জগন্নাথ মাস তিন-চারের ট্রেনিংয়ে গেছে। সারা সপ্তাহ, মানে পাঁচদিন ওরা অফিস করত। আর আমি সন্ধে অবধি একটি সারাদিনের জন্য টিকিট ব্যাগে, কখনও হেঁটে, কখনও বাসে পাড়া বেড়িয়ে কালাতিপাত করতুম। ভাষা জানি না, পথঘাট-সংস্কৃতি সব অচেনা। সুমন দু’টি জিনিস পই পই করে বলে দিয়েছিল, পাসপোর্ট ব্যাগছাড়া না করতে, আর এক টাকা মূল্যেরও কিছু সওদা করলে মেমো না হারাতে। খুব সাধারণ, সোজাসাপ্টা মানবিক এক বন্ধুর মুখ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সেই আকাশবাণী-র গল্পে বরুণ হালদার, মিউজিক্যাল ব্যান্ড বক্স, বুলবুলদি থেকে ইন্দিরাদি, কবিতাদি (কবিতা সিংহ), মায় অলোকদার বাঁশি (অলোকনাথ দে), আলির সানাই (আমাদের বন্ধু আহমেদ আলি হুসেন), অনুরোধের আসর, রম্যগীতি, শুক্রবার রাত আটটার নাটক, রেডিওর ভূত সব– সব থাকত। ঘরের মাটি, দেশের সুঘ্রাণ স্পর্শ করার এ এক অনন্ত আবেগ! ওখানেই, কোলন শহরে, সুমনের বাড়িতে ’৮৮-র ২৪ মার্চ সম্ভবত আমি প্রথম ‘তোমাকে চাই’ আর ‘আমাদের জন্য’– এই দু’টি গান শুনি। আমার প্রথম প্রবাস বিরহে মধুরই শুধু হয়ে ওঠে না, আমার সুমন সংগীতে ডোবাও শুরু হয় তখনই।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সুমন তখন দেশে ফেরার জন্য দৃঢ় সংকল্প। এখানে আসবে, গান বাঁধবে, গান গাইবে এই শহরেই, যে-শহর জানে ‘ওর প্রথম সব কিছু’। জলের মতো জার্মান বলে, যে কোনও বাংলা গান ওর ঠোঁটস্থ, রবীন্দ্রনাথের গান ওর গলায় নেশা ধরানো, রসবোধ সীমাহীন। কোথায় একটা ওয়েভলেন্থের মিল ছিল ওর সঙ্গে। সন্ধেগুলো বা ছুটির দুপুরগুলো উড়ে যেত জমাট আড্ডায়, গানে, হাসাহাসিতে। কত কী আলোচনা হত! সব গল্পেই কোথাও-না-কোথাও বাংলা গান আর আকাশবাণী আসতই ঘুরে ফিরে। সেই আকাশবাণী-র গল্পে বরুণ হালদার, মিউজিক্যাল ব্যান্ড বক্স, বুলবুলদি থেকে ইন্দিরাদি, কবিতাদি (কবিতা সিংহ), মায় অলোকদার বাঁশি (অলোকনাথ দে), আলির সানাই (আমাদের বন্ধু আহমেদ আলি হুসেন), অনুরোধের আসর, রম্যগীতি, শুক্রবার রাত আটটার নাটক, রেডিওর ভূত সব– সব থাকত। ঘরের মাটি, দেশের সুঘ্রাণ স্পর্শ করার এ এক অনন্ত আবেগ! ওখানেই, কোলন শহরে, সুমনের বাড়িতে ’৮৮-র ২৪ মার্চ সম্ভবত আমি প্রথম ‘তোমাকে চাই’ আর ‘আমাদের জন্য’– এই দু’টি গান শুনি। আমার প্রথম প্রবাস বিরহে মধুরই শুধু হয়ে ওঠে না, আমার সুমন সংগীতে ডোবাও শুরু হয় তখনই।
আমার মতো এই অবগাহন পরে আরও অনেকের হয়েছে, বিশেষ করে, আমাদের পরের বা তারও পরের প্রজন্মের। আর এই সূত্রটি আমার ক্ষেত্রে আমার মরণকে শক্তপোক্ত করে তুলেছে আরও। সুমন আমাদের থেকে অল্প ছোট হলেও আমরা সমসাময়িক তো বটেই, কিন্তু আসলে ও আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। ওঁর কনসার্ট, এক অভাবনীয় ব্যাপার! একজন গায়ক মঞ্চ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ান। মঞ্চের প্রতিটি কোণের ব্যবহার করে, কখনও পিয়ানো, কখনো গিটার কখনও মাউথ অর্গানে সমান সাবলীল! তাঁর ক্ষোভ, কষ্ট, প্রেম, পরকীয়া, সমাজচেতনা, ক্রোধ– সব উগরে দেন মঞ্চে। যন্ত্রীদের ‘সহশিল্পীরা এসো’ বলে গান বাঁধেন! অতীতের, ইতিহাসের উজ্জ্বল উদ্ধার ঘটান গানে গানে। হিমাংশু দত্ত, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, হেমন্তদা, শ্যামল, তরুণ, উৎপলা, নির্মলা, অখিলবন্ধু কে নেই তাঁর স্মৃতির সরণিতে! ‘আসছে শতাব্দীতে আসব ফিরে তোমার খবর নিতে’ এই উচ্চারণ যেন মূর্ত হয়ে ওঠে সুমনের হাত ধরে। সুমনকে অনেকে দুর্মুখ দাম্ভিক ভাবেন! কিন্তু একটা নতুন প্রজন্মকে শিকড় চেনানোর দায়বদ্ধতা ছাড়া একে কী বলব?
সুমন শ্রোতাদের নিয়ে একযোগে গান করেন শুধু নয়, গান শেখানও। ‘আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে’ এই গানটি তো সুমনই আমাদের গাইতে শেখালেন! কলামন্দির প্রেক্ষাগৃহ যখন ওঁর লেখা গান অনর্গল গেয়ে চলে তখন মনে হয় এই ‘নশ্বর জীবনে’ কী বা চাওয়ার বাকি থাকে একজন শিল্পীর?
আর সুমনের গান! যদি ভাবনার প্রকাশই ভাবি, কী সব ভেবেছেন, কী সব লিখেছেন! রবীন্দ্রনাথে আমরা প্রেম-পূজা একাকার হতে দেখি। কিন্তু প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসায় সমাজ, রাজনীতি, দিনবদলের স্বপ্ন মিলে যাওয়ার দুর্লভ নজির সুমনের গানের মতো তীব্র খুব বেশি আছে কি?
সুমনের গানের আরশিতে সময়কে দেখি,
যেখানে রুটি, যেখানে ভাত
সেখানে দিন, সেখানে রাত
সেখানে থেকে যাই
সেখানে দেশ আমার দেশ
যাবো কোথায় ভাই?
অথবা,
মরচে ধরুক অস্ত্রে
গ আকার ন গান
জি ইউ এন-টা চাই না গাইব
শস্যের জয়গান।
বরাদ্দ যাক কমে
প্রতিরক্ষার খাতে
সারা দুনিয়ার যত ছেলেমেয়ে
থাকে দুধে আর ভাতে।
রাজনীতি, দেশকাল, দেশের মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার হতাশাতেও কতবার আমাদের পরম নির্ভরতা হয়ে উঠেছে সুমনের গানের মঞ্চ।
সত্যিই সে ‘নাগরিক কবিয়াল’ করে ‘গানের ধর্মপালন’। গানই তাঁর হাতিয়ার, তার শক্তির উৎস। তাই স্বধর্মে স্বস্থ থেকেই সুমনের রাজনীতি। সেই রাজনীতি বাঙালিয়ানাকে নির্মূল করে দেওয়ার চক্রান্তের বিরোধিতায়। এই যে এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষার তকমা লাগিয়ে সব একাকার করার, বহুত্ব ভুলিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র অবিরাম, হিন্দির গাজোয়ারি এসব রুখে দেওয়ার জন্য তাঁর কণ্ঠ গেয়ে ওঠে–
‘বাংলার ধনুকের ছিলায় ছিলায় যত টান
তীরের ফলায় দেখো, বিষ নয়, লালনের গান ,
সে গানে বিদ্ধ বুক,রক্তে অশ্রু ছলোছলো
এ যদি আমার দেশ না হয় তো কার দেশ বলো?’
এই একই রাজনীতির অঙ্গ হিসেবে তাঁর ‘মা ভাষায়’ খেয়াল রচনা এবং তার প্রচার প্রসার। একজন ৭৫-এর যুবক এই কাজে তাই একই সঙ্গে নিরলস ও অপ্রতিরোধ্য। আমরা সুমনের গানের লাইন অনায়াসে উদ্ধৃত করি, তাঁর ব্যবহৃত শব্দ আমাদের জীবনে ঢুকে পড়েছে। আমার বাচিক চর্চা কেন্দ্রের নামও ‘কথানদী’। সুমনের গানের ‘বুকের ভেতর জমে থাকা কথার পাহাড়’ থেকে তুলে নেওয়া। নীরবতার পাহাড় ফাটিয়ে নদীর সহজ সরল প্রকাশের রূপকের মধ্যে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির আদর্শকেও খুঁজে পাই।
৭৫-এর কবীর সুমন আমার সেই গানের বন্ধু, যে ‘দুঃখ সুখের এপারে ওপারে দোলায় আমার মন’, আর ‘অকারণ অশ্রু সলিলে ভরে যায় দু’ নয়ন’! বন্ধুত্ব যেমন হয়, আমার সুমনের ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সঙ’ হওয়ার দরকার পড়ে না। কিন্তু ওর বন্ধুত্বকে মূল্য দিই। তাই ওর যে কথা আমার মানার নয়, তাতে গলা মেলাই না। কখনও টের পাই, সুমনের গান ছাপিয়ে ওর কোনও উত্তেজনার প্রকাশ বা প্রগলভতা নিয়েই চর্চা চলছে। হয়তো সুমনও এর জন্য কিছুটা দায়ী।
কিন্তু সুমনের কথা ভাবলে ওর সঙ্গে বন্ধুতাই আমার পথরোধ করে।
আমি প্রায়ই ভাবি লকডাউনের দিনকালে প্রতিটি সকাল প্রায় একটি করে প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদে যখন ধূসর, সুমন তখন হয় নতুন নতুন ছবি আঁকা, নইলে কবিতা পাঠ আর সর্বোপরি একটি করে বাংলা খেয়াল নতুন নতুন রাগে সৃষ্টি করে আমাদের মতো সময় ফুরিয়ে আসা মানুষজনকে বাঁচার রাস্তা বাতলিয়েছে। আজও কোনও কিছুর পরোয়া না করে তাই করে চলেছে।
আর এটাই তোর কাজ। সোশাল মিডিয়ার পাতায় কোন অর্বাচীনের প্ররোচনায় তোর আলোড়িত হওয়া দেখে উদ্বেগ হয়। এই সময়গুলো তোর মাকে মিস করি, তাঁর মতো করে তোকে বকতে, শাসন করতে ইচ্ছে করে।
আমবাগানে গজল-সম্রাজ্ঞীকে গোর দেওয়া হয়ে যাওয়ার পর, রাত জেগে শাহিদ লেখেন ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে একটি কবিতা, যে কবিতাটা পরে উৎসর্গ করেছিলেন সেলিমকে। এর বেশ কয়েক বছর পর শাহিদের একটা কবিতার বই বের হয় ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে।