কোনও সরকারি দালানের মাথায় আজ, ৭ নভেম্বর কোনও লাল পতাকা উড়ছে না, এমনকী এই সামরিক দালানটার মাথায়ও নয়। এবারেও তারিখটি সরকারি ছুটির দিন– তবে সরকার ঘোষিত উৎসবের দিন নয়। আজ উৎসবের শোভাযাত্রায় যোগ দেওয়ার তাড়া কারও নেই। জনতার ভিড় খাবারের দোকানের সামনে– দুধ আর রুটির জন্য মাইলখানেক লম্বা লাইন– আক্ষরিক অর্থে। উৎসবের আনন্দের স্থান নিয়েছে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
৫.
১৯৯১ সালের ৭ নভেম্বরের মস্কো।
সকাল সাতটা।
গতকাল বরফ পড়েছিল।
গতকালের সাদা বরফ আজ গলে গিয়ে এখানে-ওখানে কালো কালো ছোপ ধরিয়ে দিয়েছে। আমার বাড়ির জানলা থেকে চোখে পড়ে ধূসর রঙের সেই সামরিক দালানটি। কেল্লার ধাঁচে তৈরি পাঁচতলা দালান, বাইরে কোনও ফলক নেই, নেই কোনও রাস্তার নাম, লেখা নেই কোনও ঠিকানা। ভ্রুকুটি করে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের মুখ আজও গোমড়া, কিন্তু সেই গোমড়া মুখকে পরোয়া না করে দেশের মানুষ যে উৎসবের সাজে মেতে উঠবে আজ আর তার তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই। এই দালানটিতে গত আগস্ট মাসে ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের কায়দায় ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য কমিউনিস্টদের মন্ত্রণাসভা বসেছিল। কমিউনিস্টদের সংগঠিত ১৯ আগস্টের সেই অভ্যুত্থান তিনদিনের মাথায় ২১ আগস্ট অবদমিত হল। বিদেশি শক্তির অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে। দেশের রাষ্ট্রনেতাদের সহায়তায় সেটা অনায়াসেই সম্ভব হল। দেখা গেল দেশ আর ৭৪ বছর আগেকার জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ রাষ্ট্রনায়ক ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো মন্তব্য করলেন: ‘আমরা এক নতুন যুগে এসে উড়ে পড়ছি।’ সেই নতুন যুগটা যে কীসের, তা আর সেদিন তিনি ভেঙে বললেন না, যদিও তিনি নিজেই সেই নবযুগ স্রষ্টা। কিন্তু আগের বছর তিনি অন্য কথা বলেছিলেন।
ঘটে গেল ইতিহাসের মোড়বদল। তখন থেকে এদেশের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে অক্টোবর বিপ্লব ‘অক্টোবর অভ্যুত্থান’ নামে উল্লেখ করা হচ্ছে। গণতন্ত্রীদের বিজয়ের দিনটি আখ্যা পেয়েছে ‘আগস্ট বিপ্লব’। সেই থেকে কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অক্টোবর বিপ্লব বার্ষিকীর আগের দিন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী ক্রেমলিনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেশের জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের বিভিন্ন সম্মানজনক পদকে ভূষিত করলেন। সেখানে তিনি তাঁর ভাষণে বললেন: ‘যে সমস্ত মূল্যবোধের সমর্থনে মানুষ অক্টোবর বিপ্লবের পতাকাতলে সমবেত হয়েছিল, পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে আমরা সেই পথে প্রত্যাবর্তন করছি।’
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কোনও সরকারি দালানের মাথায় আজ, ৭ নভেম্বর কোনও লাল পতাকা উড়ছে না, এমনকী এই সামরিক দালানটার মাথায়ও নয়। এবারেও তারিখটি সরকারি ছুটির দিন– তবে সরকার ঘোষিত উৎসবের দিন নয়। আজ উৎসবের শোভাযাত্রায় যোগ দেওয়ার তাড়া কারও নেই। জনতার ভিড় খাবারের দোকানের সামনে– দুধ আর রুটির জন্য মাইলখানেক লম্বা লাইন– আক্ষরিক অর্থে। উৎসবের আনন্দের স্থান নিয়েছে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
অক্টোবর বিপ্লব বার্ষিকীর আগের দিন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী ক্রেমলিনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেশের জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের বিভিন্ন সম্মানজনক পদকে ভূষিত করলেন। সেখানে তিনি তাঁর ভাষণে বললেন: ‘যে সমস্ত মূল্যবোধের সমর্থনে মানুষ অক্টোবর বিপ্লবের পতাকাতলে সমবেত হয়েছিল, পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে আমরা সেই পথে প্রত্যাবর্তন করছি।’
এক বছর আগে রেড স্কোয়ারে অক্টোবর বিপ্লব দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সভায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম আর শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচ্যোভ্ তাঁর ভাষণের উপসংহারে স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন: ‘আমরা দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছি এক নতুন জগতের দিকে– কমিউনিজমের জগতে। সে পথ থেকে আমরা কখনও বিচ্যুত হব না।’ এর চেয়ে বড় মিথ্যাচার আর কী হতে পারে। এটা তো আর তাঁর মনের কথা নয়।
অন্যদিক থেকে কোনওরকম রাখঢাক না রেখে বিপ্লবের রক্তপতাকাকে নামানোর জন্য উঠে পড়ে লেগে গেলেন রুশ ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন।
এ-বছর বেছে বেছে ঠিক বিপ্লব বার্ষিকীর আগের দিন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দেশের অভ্যন্তরে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি ও রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ বন্ধ করার এবং পার্টির সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ জারি করলেন। ভয়ংকর প্রতিহিংসা। অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ততদিনে নাম ফলকে পরিণত হয়েছে, ফলে তার কমিউনিস্ট পার্টিরও অস্তিত্ব কেবল ওই নামেই ছিল। আরও একটি উপহার– উৎসবের প্রাক্কালে মস্কোর মেয়রের ঘোষণা– ১ ডিসেম্বর থেকে রুটি, মাংস, মাখন ও দুধের রেশনিং চালু হচ্ছে।
সাংক্ত্ পেতের্বুর্গের মেয়র লেনিনগ্রাদ শহরের সাংক্ত্ পেতের্বুর্গের নামবদল উপলক্ষে ৭ নভেম্বর তারিখটাই বেছে নিয়েছিলেন সাংক্ত্ পেতের্বুর্গের পুনরুজ্জীবন উৎসব উদযাপনের দিন হিসেবে। ৫ নভেম্বর রাশিয়ার রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী গ্র্যান্ড ডিউক ভ্লাদিমির কিরিল্লভিচ্ পারি থেকে এই প্রথম রাশিয়ায় তিনদিনের জন্য পদার্পণ করলেন। পেতের্বুর্গের মেয়র তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। গ্র্যান্ড ডিউক ৭ তারিখের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
রেড স্কোয়ারে সেদিন বলাই বাহুল্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান বা সমারোহের কোনও আয়োজন করা হয়নি। তবে সেখানে সেদিন স্বতঃস্ফূর্ত জনসমাবেশ ঘটেছিল। রেড স্কোয়ার পরিণত হয়েছিল উত্তাল জনসমুদ্রে। বেলা বারোটার সময় অক্টোবর স্কোয়ার থেকে শোভাযাত্রাকারীরা সেখানে এসে শামিল হয়।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বহু জায়গায় এই দিনটি উপলক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত উৎসব উদযাপিত হয়। তবে ৭ নভেম্বর সম্পর্কে সাধারণভাবে লোকের মনোভাব বিমিশ্র। যারা অক্টোবর বিপ্লবের ভূমিকা সম্পর্কে সন্দিহান, তাদের অনেকেই ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে দিনটি উদযাপনের পক্ষপাতী। অধিকাংশ লোকই অবশ্য অন্নবস্ত্রের সমস্যায় এত জর্জরিত যে এ নিয়ে মাথা ঘামানোর অবকাশ তাদের নেই।
সোভিয়েত শাসনের সাত দশকের বেশিকাল ধরে– এমনকী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী যখন মস্কোর দ্বারপ্রান্তে (১৯৪১), তখনও দেশ রেড স্কোয়ারে মহাসমারোহে উদযাপন করেছিল তার বিপ্লবের বার্ষিকী। রেড স্কোয়ারে কুচকাওয়াজ সেরে সেনাবাহিনী সেখান থেকেই সোজা ফ্রন্টে চলে গিয়েছিল। এমনই গুরুত্ব ছিল এই দিনটির।
কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিপ্লব সম্পর্কে জনসাধারণের মনোভাব যেন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল।
…পড়ুন রুশকথার অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি
বীরভূমের লেখক-গবেষকেরা মনে করেন, বীরভূমের লাভপুরের কাছে দেবী ফুল্লরাতেই সেই পীঠের অধিষ্ঠান আবার বর্ধমানের গবেষকেরা দাবি করেন, ঈশানী নদীর বাঁকে বর্ধমানের দক্ষিণডিহিতেই দেবীর ওষ্ঠপাত ঘটেছিল। তবে ভক্তদের কাছে দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র এবং অলৌকিক শক্তি দুই জায়গাতেই বর্তমান।