অভিনেতা-জীবনের এই যে নানাবিধ রঙের সমাহার, এটাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা। রং কিন্তু তোমাকে ধরবে। লোকে যখন রং নিয়ে আমাদের তাড়া করে, তখন আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে, তার থেকে নিজেকে আড়াল করা, পালিয়ে যাওয়া, মুখ ঢেকে নেওয়া। এই আড়ালটা কিন্তু সব অভিনেতাদেরই থাকে, যখন তারা নতুন অভিনয় শুরু করে। পরেও হয় অবশ্য, যখন নতুন কোনও চরিত্র পায় তারা। যে রঙে আমাকে দেখে লোকে অভ্যস্ত, যে রং আমার চেনা, যে রং আমি সহজে তুলে ফেলি, সেই রঙের বাইরে যেতে কাঁপন ধরে।
৫.
অভিনেতাদের একটা রোস্ট্রাম বা পাটাতন লাগে, যা তার মনোভূমি, যেখানে সে উঠে দাঁড়ায়– এ কথা তো আগেও বলেছি। আবেগ, অনুভূতি, অবস্থান জোড়া লেগে লেগে এই মনোভূমি তৈরি হয়, চরিত্র অনুযায়ী নট সেখানে উঠে দাঁড়ায়। রিহার্সাল যখন করি আমরা, তখন একটু একটু করে ওই রোস্ট্রাম তৈরি করি, নিজের মনটাও তৈরি করতে থাকি। একটা কাঠ, একটা পেরেক, একটা পায়া জোগাড়ের মতোই। একদিন সেটার ওপর উঠে দাঁড়াই, যখন বুঝি সেটা আর নড়বড় করছে না, তখন বুঝি আমার চরিত্রটি সম্পন্ন হল।
তারপরেই আসে রঙের খেলা। একজন নটের জীবনে রঙের গুরুত্ব প্রবল। অনেকেই তো একথা বলেন, আমিও অনেকবার শুনেছি– এত কথার কী আছে, রং মেখে দাঁড়ালেই তো হল। তার মানে রং মাখলেই আলাদা হয়ে যাওয়া যায়, যেমন বহুরূপীরা করেন। কিন্তু নটেরা জানে, শুধু রং মাখলেই হয় না। রং আমাদের তৈরি করতে হয়। মনোভূমিতে যে রং আছে, সেই রং দিয়ে সাজি আমরা। মহড়ার সময় নটেরা রংবাজি করতে করতে যায়। এ আসলে বাজির মতোই। কিছুক্ষণের জন্য আসে, তারপর মিলিয়ে যায় সেই আলো, ঝলকানি। আমরাও রং তৈরি করি, সেই রং মিলিয়ে যায়, আবার রংটাকে ফিরিয়ে আনি। বাড়ির উঠোনে যখন অভিনয় করতাম, একটা লাল রং ভরা বেলুন বুকের ভাঁজে রাখতাম। কখনও ইংরেজের সঙ্গে লড়তাম, কখনও ডাকাতের সঙ্গে। আহত হওয়ার সময় বুকের ওই বেলুনটা ফাটিয়ে দিতাম। জামাটা লাল রঙে ভেসে যেত। এই যে রঙে ভেসে যেতাম আমি, এই লাল রং-টা কিন্তু আমার অন্তরকেও ছুঁয়ে গেল। আমার ভেতর ভেসে গেল একটা রঙে, আর শরীর ভাসল অন্য রঙে। এই দুটো মিলে তৈরি হল একটা অভিনয়।
প্রতিদিন নিজেকে রং মাখানো, অন্যকে রং মাখানো, তারপর সেটাকে ধুঁয়েমুছে ফেলা, আবার পরদিন সেই রঙের কাছে যাওয়া, রঙিন হওয়া, উদ্বেল হওয়া, সেটা চলতেই থাকে। চলতে থাকবেও।
আমরা যখন আনন্দিত হই, উচ্ছ্বসিত হই, তখন আমাদের ভেতরে একটা রং তৈরি হয়, সেটা কিন্তু আমাদের শরীরেও বোঝা যায়। তখন কিন্তু আর বেলুনের দরকার হয় না। লোকে বলে, তোমাকে আজ দারুণ রঙিন দেখাচ্ছে– এই যে উচ্ছ্বাস, তার প্রকৃত রং কী? দুঃখের রং কী?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এই উৎসবের মধ্য দিয়ে যিনি যান, তিনি এই চর্চাটিকে জারি রাখেন। আমার যদি একটা পাটাতনও জোটে, যদি সব আয়োজনও থাকে, তাহলেও এই রঙের কারখানা আমার মনের ভেতরেই আছে। একটি কথাকে আশ্রয় করে, যে কথাটি সহঅভিনেতা আমার দিকে ছুড়ে দিল, তাকেই আমি গ্রহণ করলাম, গায়ে মাখলাম। এই রঙের ভাণ্ডার কিন্তু অফুরান।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অভিনেতা-জীবনের এই যে নানাবিধ রঙের সমাহার, এটাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা। রং কিন্তু তোমাকে ধরবে। লোকে যখন রং নিয়ে আমাদের তাড়া করে, তখন আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে, তার থেকে নিজেকে আড়াল করা, পালিয়ে যাওয়া, মুখ ঢেকে নেওয়া। এই আড়ালটা কিন্তু সব অভিনেতাদেরই থাকে, যখন তারা নতুন অভিনয় শুরু করে। পরেও হয় অবশ্য, যখন নতুন কোনও চরিত্র পায় তারা। যে রঙে আমাকে দেখে লোকে অভ্যস্ত, যে রং আমার চেনা, যে রং আমি সহজে তুলে ফেলি, সেই রঙের বাইরে যেতে কাঁপন ধরে। যখনই অচেনা রং আসতে থাকে, তখনই সে পালানোর পথ খোঁজে, মুখটা ঢেকে নিতে চায়। কিন্তু সেই অভিনেতাই আবার বুঝে যায়, যেটাকে আমরা বাঁচানো বলছি, সেটাই আসলে মরা। ওই চরিত্রের রঙের কাছে যেতেই হবে। আমার ব্যক্তিগত রং সেই সাহস জোগায়। আত্মসমর্পণ করার। নতুন চরিত্রটির অন্তরে প্রবেশ করার। আমি ভয় পেতে পেতেও চরিত্রকে গ্রহণ করব, যেমনটা প্রেমে হয়। ভয়ে ভয়ে, একরাশ চিন্তায় একজন অভিনেতা রং মাখতে বসে। তারপর সে নতুন জীবন পায়।
অন্য রঙে আহ্বান আমার কাছে দারুণ ব্যাপার। এ এক নেশা। প্রতিদিনই আমাকে রং নিয়ে খেলায় মাততে হবে জেনে, আমি যেন আরও প্রাণ পেতে থাকি। কখনও কখনও সব রং মুছে ফেলে ধূসর হব, একাকী হব, এতটাই অন্ধকারের রং গায়ে মাখব, যাতে আমাকে দেখাই না যায়। কখনও দৃশ্যমান হব, কখনও অদৃশ্যে মিশে থাকব। এই তো উৎসব।
এই উৎসবের মধ্য দিয়ে যিনি যান, তিনি এই চর্চাটিকে জারি রাখেন। আমার যদি একটা পাটাতনও জোটে, যদি সব আয়োজনও থাকে, তাহলেও এই রঙের কারখানা আমার মনের ভেতরেই আছে। একটি কথাকে আশ্রয় করে, যে কথাটি সহঅভিনেতা আমার দিকে ছুড়ে দিল, তাকেই আমি গ্রহণ করলাম, গায়ে মাখলাম। এই রঙের ভাণ্ডার কিন্তু অফুরান। আমি রোদের রং গায়ে মেখেছি, আমি আনন্দের রং মেখেছি, আমি উল্লাসের রং গায়ে মেখেছি, আমি বিশ্বাসঘাতকতার রং মেখেছি, আমি বেইমানির রং মেখেছি, প্রেমিকে রং মেখেছি, আমি আকাশের রং গায়ে মেখেছি। তার পরেও দেখি কত রং মাখিনি এখনও।
আমিও তো দু’হাতে রং আড়াল করেছি। আর বুঝতে পেরেছি, সেই চরিত্রটি আমার থেকে দূরে চলে গেল। ওকে আবাহন করলাম না। উন্মুক্ত হলাম না ওই চরিত্রের কাছে।
অভিনয় একটি সমর্পণের খেলা।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?
এ দেশে প্রসূতিসদন থেকে নবজাত শিশু ও প্রসূতিকে ছেড়ে দেওয়ার পরও স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বেশ কয়েক মাস ধরে নিয়মিত একজন চিকিৎসক বাড়িতে এসে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যান। এটা ছিল এখানকার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ।