আইপিএল যে আজও চলে মহেন্দ্র সিং ধোনির আবেগ-মোহরে! না বললেও জানি, তাঁর জন্যেই বদলে যায় টুর্নামেন্ট আইন, আসে ‘ইমপ্যাক্ট’ প্লেয়ারের কানুন, তাঁর জন্যই ইয়ান বিশপকে প্রবল আবেগে কেভিন পিটারসেন সুরেলা ইংরেজিতে বলে দেন, ‘লুক অ্যাট দ্য ক্রাউড, বিশ। দে ওয়ান্ট ধো-ও-নি!’ স্বাভাবিক। সোনার রাজহাঁসকে কেউ যেতে দেয় না। তাঁকে সার-জল দিয়ে জীবিত রাখাই দস্তুর। বিপক্ষ টিম বা বিপক্ষ প্লেয়ার, তাদেরও মহেন্দ্র সিং নামের উত্তমপুরুষের ‘চরণতল’ ছাড়া গতি নেই বিশেষ।
এক রমণী বসেছিল। রোববার রাতে। বিশাখাপত্তনমে। কাঙাল-নয়নে, ভালবাসার দালানে। ঠোঁটে যার প্রেমের বর্ণমালা, হাসির মুক্তোহার। চেয়ে-চেয়ে সমস্ত দেখছিল সে, অবাক অস্থিরতায়। দেখছিল কেমন ডানা মেলছে শট-শতদল, যৌবনের উচ্ছৃঙ্খলতা দেখাচ্ছে বল, এক বিয়াল্লিশের স্পর্ধায়, তাঁর উইলোর আক্রোশে।
আইপিএল গ্যালারির অপূর্ব আনন্দমেলায় বসে রমণীটি দেখছিল সব, দেখে চেতনা হারাচ্ছিল বুঝি। তার প্রাণ, তার মন, তার হাসি, তার স্ফূরণ, সব যেন মিলেমিশে যাচ্ছিল এক স্বপ্নের চরাচরে। এক হৃদয়-ধ্বনিতে। মহেন্দ্র সিং ধোনিতে!
পরিপূর্ণ খেলা কিংবা ধোনিকেন্দ্রিক তার অংশবিশেষ (হাইলাইটস) খুললে ভদ্রমহিলাকে এখনও দেখা যাবে। সম্প্রচারকারীর ক্যামেরা ধরেছিল সে মুখ বিশেষ করে। নাম জানি না। ধাম জানি না। কিন্তু চিনি তার হর্ষ-স্বর, যা আদতে জাতির স্বর। ঝাড়া দশ মাস কুণ্ডলী পাকিয়ে যা ঘুমিয়ে থাকে। জাগে দু’মাস। জেগে আহুতি দেয় মহেন্দ্র ধোনির মহা-মায়ায়। এদের কাছে মার্চ-এপ্রিল-মে মাস বলে কিছু নেই পড়ে আর। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-অর্ধেক মার্চ শেষে, এদের ক্যালেন্ডারে পরের আড়াইখানা মাস স্রেফ ধোনি, ধোনি, ধোনি…!
নাহ্, এমএস ধোনি গত রাতে ১৬ বলে অপরাজিত ৩৭ করে গিয়েছেন বলে এ বল্গাহীন উপলব্ধি নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ‘গতিদানব’ আনরিখ নখিয়ার ভয়ের ‘বাঘনখ’ তিনি নির্মম উপড়ে ফেলেছেন বলেও নয়। এ উপলব্ধির হেতু অন্য। এ উপলব্ধির নেপথ্যে এক আশ্চর্য দৃশ্যপট, যা আইপিএল এ যাবৎ দেখেনি।
প্রিয় টিমের জয়-পরাজয় আইপিএলে গৌণ হয়ে গিয়েছে নাকি কখনও? দেখেছেন আইপিএলে কখনও দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে মাঠের দুই টিমকে অকৃত্রিম ব্যক্তিপুজোয় ভেসে যেতে?
ক্রিকেট আজন্ম ধরে দলগত খেলা। অফুরান প্রতিভায় বলীয়ান চরিত্ররা খেলাটার আকর্ষণ বাড়িয়েছেন, নান্দনিক করেছেন আরও। কিন্তু কখনও ক্রিকেটের আকাশ ছাড়িয়ে নতুন ‘আকাশগঙ্গা’ সৃষ্টি করতে পারেননি। প্রতিপক্ষের কেউ ভালো খেললে, অবশ্যই প্রশংসার ভালো ভাষা বেরিয়েছে তার উদ্দেশ্যে। কিন্তু নিঃস্বার্থ ভালোবাসার আবির ওড়েনি। কী করা যাবে, বিপক্ষ যে দিনশেষে বিপক্ষ। শত্রু শিবির। খেলার মাঠে যার ঘাঁটি ওড়ানোই দস্তুর। কিন্তু গতকাল যাহা দেখিলাম? সমুদ্রতট সন্নিকটের বিশাখাপত্তনমে? কী ব্যাখ্যা হয় তার? আদৌ হয় কি?
খেলা শেষে দেখলাম, বিজিত মহেন্দ্র সিং ধোনিকে ঘিরে ধরলেন সবাই। চেন্নাই-দিল্লি নির্বিশেষে, পক্ষ-বিপক্ষের কাঁটাতার এক পদাঘাতে সরিয়ে। অকাতর আকুতিতে। অধুনা সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমা যুগে বিভিন্ন টিমের ‘হ্যান্ডল’ থেকে এখন বিপক্ষ টিম নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা চলে অবাধে। কিন্তু গত রাতে খেলা শেষের পর দিল্লি ক্যাপিটালস দেখলাম, মহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে টিমের অধিনায়ক ঋষভ পন্থের একটা মন ভালো করা ছবি দিয়েছে। যে ছবির অনুষঙ্গ পন্থের এক পুরনো মন্তব্য– ‘মাহি ভাই তো প্যয়ার হ্যায়!’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
লম্বা চুলের মাহি-দেবতা মাঠে নামলে আজও থমকে যায় ভারতবর্ষ। মানুষ ভুলে যায় জীবিকা, ভুলে যায় খিদে। সে তখন ভাত নয়, দু’মুঠো ধোনি চায়! ধর্ম ভুলে, বর্ণ ভুলে, সমস্ত ভারতবাসীর কণ্ঠে-কণ্ঠে তখন বাজে অদৃশ্য জাতীয় সঙ্গীত। বিভাজনের সমস্ত সংজ্ঞাকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে, সমগ্র দেশ সে সময় ঝাঁপ দেয় এক সমবেত কামনার অগ্নিকুণ্ডে। যে কামনা নিষ্কাম হয়েও তীব্র। বায়বীয় হয়েও বড় জ্যান্ত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এ তবু বোঝা যায়, ধরা যায়। আইপিএল যে আজও চলে মহেন্দ্র সিং ধোনির আবেগ-মোহরে! না বললেও জানি, তাঁর জন্যেই বদলে যায় টুর্নামেন্ট আইন, আসে ‘ইমপ্যাক্ট’ প্লেয়ারের কানুন, তাঁর জন্যই ইয়ান বিশপকে প্রবল আবেগে কেভিন পিটারসেন সুরেলা ইংরেজিতে বলে দেন, ‘লুক অ্যাট দ্য ক্রাউড, বিশ। দে ওয়ান্ট ধো-ও-নি!’ স্বাভাবিক। সোনার রাজহাঁসকে কেউ যেতে দেয় না। তাঁকে সার-জল দিয়ে জীবিত রাখাই দস্তুর। বিপক্ষ টিম বা বিপক্ষ প্লেয়ার, তাদেরও মহেন্দ্র সিং নামের উত্তমপুরুষের ‘চরণতল’ ছাড়া গতি নেই বিশেষ। মূর্খেও জানে, ধোনি থাকলে, আইপিএল স্বমহিমায় থাকবে। ধোনি চলে গেলে, আইপিএল আলুনি হয়ে যাবে।
কিন্তু বাকিটা? রবিবাসরীয় বিশাখাপত্তনমের বাকি অংশ?
শেষ ওভারে ৪১ দরকার ছিল চেন্নাইয়ের। নিদেনপক্ষে একখানা ‘নো বল’ এবং ছয় বলে ছয় ছক্কার অলৌকিক ছাড়া যে রান তোলা সম্ভব ছিল না। ধোনি পারেনওনি তুলতে। নখিয়াকে বেধড়ক মেরেও যা ওঠেনি। দু’টো ছয় আছড়ে পড়ল জনঅরণ্যে। একটা আবার এক হাতে! দু’টো চার ছিটকে বেরোল ‘ট্রেসার বুলেট’-এর মতো। কিন্তু তার পরেও, পারেননিও ধোনি টিমকে জেতাতে। মুশকিল হল, ভারতবর্ষের তাতে বয়ে গেল। বয়ে যায়। বয়ে যাবেও। লেখার শুরুতে যে রমণীর কথা লিখলাম, তিনি কোনও হার-জিতের হিসেবি অবয়বের প্রতিভূ নাকি?
বিস্ফারিত ভাবে দেখছিলাম, চলতি আইপিএলে চেন্নাইয়ের প্রথম পরাজয় আসন্ন জেনেও কী অনির্বচনীয় মাতন ধরেছে বিশখাপত্তনম গ্যালারিতে! পরিচিত জনা দুই সিএসকে ‘সুপারফ্যান’ এমন উদ্দাম-নৃত্য করছিলেন, যা তাঁরা চেন্নাই প্রথম দু’ম্যাচ জেতার পর করেছিলেন কি না, সন্দেহ। সন্দেহ কেন লিখছি, নিশ্চিত করেননি! কারণ, সে দুই খেলায় ধোনি ব্যাট করতে নামেননি। নতুন জ্যোতিষ্ক রাচিন রবীন্দ্র-র আবির্ভাব, শিবম দুবের ‘দস্যিপনা’, প্রতিপক্ষকে পিষে দোর্দণ্ডপ্রতাপ টিমের অক্লেশ জয়– সমস্ত ছিল, সমস্ত হয়েছে। কিন্তু প্রাণের ‘থালা’-কে (নাকি স্বয়ং প্রাণ) ড্রেসিংরুমে ব্যাট হাতে ‘মকশো’ করা ছাড়া আর কিছু করতে দেখা যায়নি। নামার সুযোগই আসেনি। রোববার যে সুযোগ এসেছিল। রোববার তাই দেশ জয়-পরাজয়ের উর্ধ্বে চলে গিয়েছিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: নিজেকে না বদলালে হার্দিকের পক্ষে দেশনায়ক হওয়া কতটা সম্ভব বলা মুশকিল
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
করার নেই কিছু। লম্বা চুলের মাহি-দেবতা মাঠে নামলে আজও থমকে যায় ভারতবর্ষ। মানুষ ভুলে যায় জীবিকা, ভুলে যায় খিদে। সে তখন ভাত নয়, দু’মুঠো ধোনি চায়! ধর্ম ভুলে, বর্ণ ভুলে, সমস্ত ভারতবাসীর কণ্ঠে-কণ্ঠে তখন বাজে অদৃশ্য জাতীয় সঙ্গীত। বিভাজনের সমস্ত সংজ্ঞাকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে, সমগ্র দেশ সে সময় ঝাঁপ দেয় এক সমবেত কামনার অগ্নিকুণ্ডে। যে কামনা নিষ্কাম হয়েও তীব্র। বায়বীয় হয়েও বড় জ্যান্ত। মানুষ যে আজও নিয়মকে হারাতে চায়। অনিয়মের হাত ধরে নিয়মকে চাবুক মারতে চায়। জননেতার আশ্রয়ে। যে গণনেতা দেখিয়ে দেবে সাফল্যের জনপথ। যা ধরে এগোলে বিয়াল্লিশকে বাইশ মনে হবে, আটষট্টিকে আটত্রিশ। সায়াহ্নেও আসবে নতুন সূর্যোদয়।
মহেন্দ্র সিং ধোনি এই আইপিএল শেষে খেলা ছেড়ে দেবেন কি না, জানা নেই। না ছাড়লে ক্রিকেটীয় উৎকর্ষতা কতটা বাড়বে, ছাড়লে কমবে কতটা, তা-ও জানি না। কিন্তু একটা কথা জানি। মহেন্দ্র সিং ধোনি ছেড়ে দিলে যা ঘটবে। হবে। হবেই।
স্বপ্নের দেশে স্বপ্নের পাখিগুলো আর বেঁচে থাকবে না। একটাও না!