সদ্য পাটনা হাই কোর্ট একটি রায় দিয়েছে। মহামান্য বিচারপতি বিবেক চৌধুরির মতে, পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়ার সময় বিচ্ছিন্ন দম্পতি অশালীন ভাষায় কথা বলেন। তার অনেক নিদর্শন রয়েছে। তাই ঝগড়ার সময় ‘ভূত’, ‘পিশাচ’ ইত্যাদি বলা মোটেও নিষ্ঠুরতা বা মানসিক নির্যাতন নয়। তাই স্বামী-শ্বশুরের বিরুদ্ধে আনা মামলা খারিজ করে দিয়েছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই কবে লিখে গিয়েছেন, ‘আমরা চলি সমুখপানে, কে আমাদের বাঁধবে। রইল যারা পিছুর টানে কাঁদবে তারা কাঁদবে।’
কিন্তু কখনও কখনও কি মনে হয় না যে, আমরা বোধহয় ক্রমশ আরও বেশি পিছনের দিকে ‘এগিয়ে যাচ্ছি’? এই একুশ শতকে নানাবিধ উন্নয়ন ও অগ্রগতির মধ্যেও!
আমাদের শৈশবে ‘বিলিতি শিক্ষা’র ব্যাপক চল ছিল না। তার আগে তো নয়ই। তাই আমরা শৈশবে-কৈশোরে ‘বডি শেমিং’ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম না। পাড়ায় প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের নাম ধরে কাকা-জ্যাঠা-দাদু বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। যদিও মনে পড়ে, সে সময় ‘সন্তোষ’ নামের একটি রেডিও-র ব্র্যান্ড জনপ্রিয় ছিল। সেই নামের এক বৃদ্ধকে দেখলেই পাড়ার দাদারা ‘রেডিও’ বলে টুক করে সরে পড়ত। বিনিময়ে জুটত বাছা বাছা ‘কাঁচা কাঁচা খিস্তি’। শুনে অনেকের কান লাল হয়ে যেত। কিন্তু তাতে আমোদ পেতেন ওই দাদারা।
কিন্তু সবচেয়ে গোল বাঁধত বন্ধু, সমবয়সিদের ক্ষেত্রে। তখনও ডাকনামের এত বাহার ছিল না। আর প্রতি পাড়ায় কেমন করে যেন তিন-চারটে বাবু, বাপি, বাপ্পা, রাজু থাকতই! তাহলে তাদের চিহ্নিত করার কিছু উপায় তো থাকতে হবে। তেমন নামকরণেও তুখোড় ছিল অনেকেই। যেমন, বন্ধুদের মধ্যে কেলে বাপি (কৃষ্ণাঙ্গ), গন্ধ বাপি-র (ঘামের উৎকট গন্ধ) নাম মনে পড়ছে। ‘বেঁটে বাবু’ বা ‘মোটা রাজু’র মতো নাম শোনা যেত হামেশাই। সামনাসামনি কুমড়োপটাশ দেখা সম্ভব ছিল না। কিন্তু সুকুমার রায়ের বইয়ে ছবি দেখে থপথপিয়ে চলা রাজুকে ওই নামে ডাকার সিলমোহর দেওয়া বা আর এক বন্ধু বিভাসকে ‘গোবরগণেশ’ বলায় হয়তো দুষ্টুবুদ্ধি থাকতে পারে। কিন্তু বডি শেমিং– কখনও মাথায় আসেনি।
খোদ অমিতাভ বচ্চনকে বহুবার ‘লম্বু’ বলে বিদ্রুপ করা হয়েছে। তাহলে পাড়ার দীর্ঘকায় বন্ধুদের সে নামে ডাকলে অপরাধ কোথায়, মাথায় আসেনি। আবার ‘স্বাস্থ্যবান’ বন্ধু যখন সমগোত্রীয় প্রেমিকা জুটিয়ে ফেলে, তখন তাদের ‘মোটা-মুটি’ বলেই সম্বোধন করা যেত। অধুনা দম্পতি সেই বন্ধুযুগলকে জনান্তিকে একইভাবে পরিচয় দিলেও তাতে তারা মোটেও রাগ করে না। কিন্তু সেটাও তো আদতে ‘বডি শেমিং’!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমাদের শৈশবে ‘বিলিতি শিক্ষা’র ব্যাপক চল ছিল না। তার আগে তো নয়ই। তাই আমরা শৈশবে-কৈশোরে ‘বডি শেমিং’ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম না। পাড়ায় প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের নাম ধরে কাকা-জ্যাঠা-দাদু বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। যদিও মনে পড়ে, সে সময় ‘সন্তোষ’ নামের একটি রেডিও-র ব্র্যান্ড জনপ্রিয় ছিল। সেই নামের এক বৃদ্ধকে দেখলেই পাড়ার দাদারা ‘রেডিও’ বলে টুক করে সরে পড়ত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এত যে গৌরচন্দ্রিকা, তার কারণটা কী? কারণ, সদ্য পাটনা হাই কোর্ট একটি রায় দিয়েছে। মহামান্য বিচারপতি বিবেক চৌধুরির মতে, পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়ার সময় বিচ্ছিন্ন দম্পতি অশালীন ভাষায় কথা বলেন। তার অনেক নিদর্শন রয়েছে। তাই ঝগড়ার সময় ‘ভূত’, ‘পিশাচ’ ইত্যাদি বলা মোটেও নিষ্ঠুরতা বা মানসিক নির্যাতন নয়। তাই স্বামী-শ্বশুরের বিরুদ্ধে আনা মামলা খারিজ করে দিয়েছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ‘বডি শেমিং’ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তাই কেষ্টাকে তিনি ‘ভূতের মতন চেহারা যেমন’ বলে বর্ণনা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে যখন শ্বশুরবাড়ির লোকজন ঘরের বউকে ‘ভূত-পিশাচ’ বলে মন্তব্য করেন, তখন তাঁদের মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। এবং যে বিচারপতি তাতে কার্যত ‘ক্লিনচিট’ দিলেন, তিনি কি ‘বডি শেমিং’ নিয়ে অবগত নন? ঝগড়ার সময় গালিগালাজ, অশালীন শব্দ ব্যবহারের আড়ালে, বিদ্রুপ-রসিকতার মধ্যেও বহু শিক্ষিত মানুষই যে ‘বডি শেমিং’ করেন, সেই সূক্ষ্ম সীমারেখা কি মহামান্য বিচারপতি অস্বীকার করতে পারেন? এরপর যখন কাউকে ‘ডাইনি’ বলে পুড়িয়ে মারা হবে তখনও কি আমরা এই ধরনের যুক্তির আড়াল খুঁজব?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: কেন ‘যৌন’ শব্দের সঙ্গে ‘ক্ষমতা’ বা ‘শক্তি’ জুড়ে পুরুষের যৌনতা বোঝানোর দরকার পড়ে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
চেহারা নিয়ে সব মানুষই স্পর্শকাতর। মনে পড়ে নির্মলা মিশ্রর সেই গান, ‘বল তো আরশি তুমি মুখটি দেখে…রূপসী কে তোমার চোখে?’ আয়নার সামনে দাঁড়ালে দুনিয়ার সবচেয়ে কুরূপও নিজেকে সুদর্শন দেখে। কিন্তু অনেকেই বোঝে না, চেহারার খুঁত নিয়ে বিদ্রুপ, কটাক্ষ যে কোনও মানুষের আত্মবিশ্বাস ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে। আর ‘বডি শেমিং’-এর শিকার শুধু মহিলা নন, পুরুষরাও। আন্তর্জাতিক ল্যানসেট পত্রিকার সমীক্ষা অনুযায়ী, যে সমস্ত কারণে এ দেশে মানুষ আত্মহত্যা করেন, তার নেপথ্যে ‘বডি শেমিং’-এর অবদান খুব একটা কম নয়। ঠাট্টার ছলে চেহারা নিয়ে হুল ফোটানো এক ধরনের মানসিক বিকৃতি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘হ্যাশট্যাগ স্টপ বডি শেমিং’ জাতীয় প্রচার চললেও সামাজিক চিত্রে খুব একটা বদল আসেনি। গায়ের রঙের জন্য কিছুদিন আগেও প্রিায়ঙ্কা চোপড়াকে ‘ব্ল্যাক ক্যাট’ বলা হত। বাদ যাননি বিপাশা বসুও। কৌতুক শিল্পী ভারতী সিং-কে ‘বিন ব্যাগ’ বলে বিদ্রুপ করা হত।
কিন্তু সময় বদলাচ্ছে। চেহারা ও সৌন্দর্যের যে মাপকাঠি আমাদের সমাজে করা হয়েছে, তা থেকে বের হতে হবে। এবং তা শুরু করতে হবে পরিবার থেকেই। কারণ, গায়ের রং-চেহারা নিয়ে মূল হীনমন্যতা তৈরি করে দেন বাড়ির মানুষ। তাঁদের বুঝতে হবে, বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়েও একজনের গুণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। স্কুলেও ভ্যালু এডুকেশনের অংশ হোক ‘বডি শেমিং’। যে যেমন, সেভাবেই কীভাবে ভাল থাকা যায়, তার উপায় খুঁজে বের করাটাই আসল। বডি শেমিং হতেই পারে, কিন্তু সেটা উপেক্ষা করে এগিয়ে চলাটাই আসল। কিছু শিক্ষিত মানুষ ‘বডি শেমিং’-কে হয়তো পরোক্ষভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন দিয়ে ফেলেন। কিন্তু তা কখনও চিরস্থায়ী হতে পারে না।