এই বই মূলত স্মৃতিকথা। ‘নিজভূমে পরবাস’ করার যন্ত্রণাকে বইয়ের শিরোনামে বদলে দিয়েছেন। জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বেলঘরিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে পড়তে আসছে এক কিশোর। পরবাসে নিজভূমি খুঁজে পাওয়াই তার অভীষ্ট। কৃষিজীবী পরিবার থেকে দূরে এক্কেবারে অন্যরকম পরিবেশে গিয়ে পড়ার সেই অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করতে গিয়ে সরস গদ্যেরই আশ্রয় নিয়েছেন অপূর্ব। অর্থাৎ তাঁর টেক্সটের ওপরের স্তরে ভেসে থাকছে রসের আচ্ছাদন। কিন্তু এই সহজতার গভীরে তিনি বুনে রেখেছেন অন্যতর বয়ন।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ‘আ মুভেবল ফিস্ট’ বইয়ে লিখেছিলেন, ‘রাইট দ্য ট্রুয়েস্ট সেনটেন্স ইউ নো।’ ভাবীকালের লেখকদের জন্য এক অমোঘ পরামর্শ হয়ে তা থেকে গিয়েছে। অপূর্ব সৎপতির ‘পরবাসে নিজভূমি’ পড়তে গিয়ে মাথায় ভেসে এল হেমিংওয়ের সেই উচ্চারণ। ঝকঝকে রসস্নিগ্ধ গদ্যে লেখা এই বইয়ের আসল শক্তি বোধহয় লেখকের ‘ট্রুয়েস্ট’ থাকতে চাওয়ার প্রবণতাই।
এই বই মূলত স্মৃতিকথা। ‘নিজভূমে পরবাস’ করার যন্ত্রণাকে বইয়ের শিরোনামে বদলে দিয়েছেন।
জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বেলঘরিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে পড়তে আসছে এক কিশোর। পরবাসে নিজভূমি খুঁজে পাওয়াই তার অভীষ্ট। কৃষিজীবী পরিবার থেকে দূরে এক্কেবারে অন্যরকম পরিবেশে গিয়ে পড়ার সেই অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করতে গিয়ে সরস গদ্যেরই আশ্রয় নিয়েছেন অপূর্ব। অর্থাৎ তাঁর টেক্সটের ওপরের স্তরে ভেসে থাকছে রসের আচ্ছাদন। কিন্তু এই সহজতার গভীরে তিনি বুনে রেখেছেন অন্যতর বয়ন। কাজটা কঠিন। সামান্য গদ্য লেখার অভিজ্ঞতা থাকা মানুষও জানেন, নিজের জীবন নিয়ে লিখতে বসা কতটা চ্যালেঞ্জের। সেই চ্যালেঞ্জের সঙ্গে এখানে লেখক মিশিয়ে নিয়েছেন অন্য এক সংকল্পও। আগাগোড়া একটা মুচকি ভাব বজায় রাখার। বলাই যায়, তা অনায়াসে পেরেছেন তিনি। সম্ভবত, এই গদ্যের যাতায়াতে এই অনায়াস ভঙ্গিমাটি একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত। না হলে ‘মাঝে মাঝে মনে হয় অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদির মতো মশারাও বাতাসের অপরিহার্য উপাদান’ কিংবা ‘‘আমি ব্যাগে ঢুকিয়েছি একটা ‘আপ টু ডেট’ জেনারেল নলেজের বই, যাতে লেখা আছে বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়’’, ‘বেল পাকলে কাকের কিছু নয়, কিন্তু বেল পচলে মানুষের পক্ষে খুবই দুঃখজনক ব্যাপার’-এর মতো বাক্য লেখা যায় না।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
গ্রামের পরিবেশ ছেড়ে একেবারে আলাদা একটা জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়া এক কিশোর। ভাষারীতি, অভ্যাস কিংবা সংস্কৃতির ভিন্নতার ভিতর দিয়ে সে একটু একটু করে বড় হয়। পাঠককে সেই বড় হয়ে ওঠার সঙ্গী করতে পেরেছেন অপূর্ব। সেই ‘জার্নি’র বর্ণনা দেওয়ার সময় ডিটেলিং হয়ে উঠেছে লেখকের অন্যতম হাতিয়ার।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই ধরনের লেখার একটা ‘বিপদ’ থাকে। লেখা ক্রমেই লঘুস্রোতে চলতে শুরু করায় পাঠক লেখকের মূল উদ্দেশ্যকে বুঝতে ভুল করতে পারেন। এক্ষেত্রে তেমন কিছু হয় না। কেননা অপূর্বর গদ্যের মেজাজেই রয়েছে এক অন্যতর সুরও। ‘বৃষ্টি নামলে দক্ষিণ পাড়াকে দেখতে পুরোদস্তুর গ্রামের মতো লাগে।’ ‘… কলকাতার বাসে উঠে বসলাম। ভাঙা বাঁশের ছাতা নিয়ে মা দাঁড়িয়ে রইলেন বাসস্ট্যান্ডে। বৃষ্টির ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে গেল মায়ের ডুরে শাড়ি, আমার গ্রাম।’ এই সব অংশের বিষণ্ণ নীরবতা পাঠকের মনকে ছুঁয়ে দেয় ঝপ করে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: এক ম্যাজিশিয়ানের ধূসর পথযাত্রা
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
গ্রামের পরিবেশ ছেড়ে একেবারে আলাদা একটা জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়া এক কিশোর। ভাষারীতি, অভ্যাস কিংবা সংস্কৃতির ভিন্নতার ভিতর দিয়ে সে একটু একটু করে বড় হয়। পাঠককে সেই বড় হয়ে ওঠার সঙ্গী করতে পেরেছেন অপূর্ব। সেই ‘জার্নি’র বর্ণনা দেওয়ার সময় ডিটেলিং হয়ে উঠেছে লেখকের অন্যতম হাতিয়ার। রবিবার দুপুরে হস্টেলের সবাই মিলে একসঙ্গে পিতলের থালা-বাটি-গ্লাস সহযোগে ভাত-ডাল-শাক-আলুচোখা খাওয়ার মুহূর্ত হোক কিংবা মিশনের বাগানে বেল পাড়ার দৃশ্য– পাঠককে ঘটনাস্থলে নিয়ে যেতে পারেন তিনি। মিশনের ছাত্রাবাস-জীবন জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে।
অপূর্ব রসিকতার ভারে তাঁর লেখাকে লঘু যেমন হতে দেননি, তেমনই গদ্যের নির্ভার চলনের ফাঁকে থেকে যাওয়া জীবনদর্শন কখনও লেখকের গমনের পথকে রুদ্ধ করে না। ‘কোনও কারিকুলাম দিয়ে মূল্যবোধের শিক্ষা হয় না। জীবন্ত দৃষ্টান্ত দেখতে হয়।’ ‘নিকৃষ্ট আম হওয়ার চেয়ে আতা হওয়া ঢের ভালো।’ এই ধরনের উপলব্ধি লেখার গতিপথে আপনমনেই যেন নির্মিত হতে থাকে। তাই তা অনায়াসেই লেখাটির অংশ হয়ে ওঠে। নীতিকথা বলে মনে হয় না।
‘পরবাসে নিজভূমি’ ছোট ছোট অধ্যায়ে বিভক্ত। সব অধ্যায়ের মেজাজ একরকম নয়। যেমন ‘বিজ্ঞান ভার্সেস কলা’ লেখকের জীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট। সেখানে বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে হাবুডুবে খেতে খেতে বিষয় বলে কলা বিভাগে ঢুকে পড়ার গল্প। স্বাভাবিকভাবেই এর থেকে একেবারেই আলাদা ‘গল্পের কারখানা’। সেখানে সেক্রেটারি মহারাজের বলা সরস গল্পের আসর। আবার ‘আলোর পথযাত্রী’ পাঁচ বছর ধরে ‘আত্মমগ্ন’ এক মানুষের কথা। সেই মহারাজের কাহিনির একেবারেই ভিন্নধর্মী ‘বেলঘরিয়ার মশা’ কিংবা ‘বেলঘরিয়ার বেল’। তবে বিষয় অনুযায়ী, আলাদা অধ্যায়ে আলাদা মেজাজ থাকলেও এক সমগ্রতা এই বইকে বেঁধে রাখে। শুরুতে যে সত্যকথনের কথা বলা হয়েছে, সেই সত্যের স্পর্শেই তা সম্ভব হয়েছে।
‘… চিঠি লেখা অনেক সুখকর। মহারাজের কাছে পোস্ট-কার্ড নাও, বুকে বালিশ নিয়ে সুখ-দুঃখের কথা, আশ্রমের প্রকৃতির কথা লিখে যাও যতক্ষণ খুশি।’ এই বই যেন তেমনই এক চিঠি। বুকে বালিশ চাপা দিয়ে চলছে লেখা। উপুড় হৃদয় থেকে উপচে পড়া শব্দে আপনিই বুঝি ভরে উঠছে পাতা। এমন বই যে কোনও পাঠককেই আকৃষ্ট করবে বলে বিশ্বাস।
এই বইয়ের মলাটটির কথা আলাদা করে বলতেই হয়। সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা প্রচ্ছদে ত্রিমাত্রিক আমেজ রয়েছে। রুলটানা কাগজে পেনে আঁকা পাখিদের সিলুয়েটে ছাত্রজীবনের মনকেমন নস্টালজিয়াও ফুটে উঠেছে। যে জীবনকে মনে হয় চাইলেই ধরা যায়। কিন্তু আসলে তা ভ্রম। আবার ঠিক ভ্রমও নয়। ঠিকমতো অনুভব আর স্মৃতিশক্তি থাকলে সেটা সম্ভবও হয়ে যায়। এটাই হয়তো বইয়ের থিম। যা সেঁজুতির প্রচ্ছদ দারুণ ভাবে তুলে ধরে।
পরবাসে নিজভূমি
অপূর্ব সৎপতি
ধানসিড়ি। ২৫০ টাকা।
বসন্তপঞ্চমীর প্রথম পর্ব ছিল বসন্ত চৌধুরীর পোশাকআশাক নিয়ে। দ্বিতীয় পর্বে, তাঁর বাড়ির পোষ্য জীবজন্তু। কখনও পপি নামের আহ্লাদী কুকুর, কখনও-বা রোজি নামের কচ্ছপ। দুম করে অন্দরমহলে ঢুকে পড়া বিদেশি একটি বিড়াল, অথচ যার ততটা বিড়ালপ্রেম নেই– এহেন বসন্ত চৌধুরীরও একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।