তিনি না গান্ধী, না সুভাষচন্দ্র। পাঠ্যবই তাঁর কথা জানাবে না। তবে, তাই বলে তো সেই পরাধীন ভারতে জাহাজের ডাক্তার হয়েও ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে দু’-টিন কুইনাইন চুরির ঘটনাটির গুরুত্ব খাটো হয়ে যায় না। আর সেই সূত্রে যখন আইরিশ ক্যাপ্টেন আর বাঙালি ডাক্তার এক অনুভবে শামিল হন, কেননা দু’জনেই ঔপনিবেশিক শক্তির শিকার, আমরা বুঝতে পারি, দেশের ধারণা ঠিক কতখানি প্রসারিত।
‘যত কাল মানুষের কীর্তি ঘোষিত হয় তত কালই সে স্বর্গভোগ করে।’ বলেছিলেন বিদুর, ধৃতরাষ্ট্রকে সুপরামর্শ দিয়ে; উদ্যোগপর্বে তখন পাণ্ডবদের রাজ্য ফেরত দেওয়া নিয়ে বিস্তর বাকবিতণ্ডা। রাজ্য-ফেরত কিংবা স্বর্গভোগ নয়, এখানে আমাদের আগ্রহ শুধু এই ভাবনায় যে, মানুষের কীর্তির জোর ততখানি হওয়া উচিত যাতে দীর্ঘকাল তা ঘোষিত হতে পারে। বিস্মৃতির এই পৃথিবীতে ঠিক ততদিনই একজন মানুষ অমর। সুতরাং খ্যাতি-অখ্যাতির ভিতর যে সাময়িকতার তবক, তাই-ই বরং তাৎক্ষণিক। আজ যে খ্যাত, আগামীতে অচিরেই তিনি অখ্যাত হয়ে উঠতে পারেন। একমাত্র কালই মানুষকে উত্তীর্ণ করে। অতএব যে বাঙালির জীবনচরিত রচনা হয়, এবং তা বই হিসাবে প্রকাশিতও হয়, তার শিরোনামে ‘অখ্যাত’ শব্দটির প্রয়োগটিকেও আমরা আপাতত বিচারাধীন রাখলাম।
এ-ও ঠিক মানুষই ইতিহাস রচনা করে বটে, তবে ইতিহাস সব মানুষকে ঠাঁই দেয় না। বেছে বেছে সেখানে কীর্তিমান মানুষের জীবনালেখ্যই তুলে ধরা হয়। তবে তা-ই কি একমাত্র ইতিহাস! রাজা-রাজড়ার ইতিহাস ব্যতিরেকে, মানুষের বৃহত্তর ও সামগ্রিক ইতিহাস তো অগণিত অকীর্তিত মানুষের জীবন ছেনে ছেনেই রচনা সম্ভব। বাঙালির সে-ইতিহাস না জানলে বাংলার ইতিহাসও সম্পূর্ণ হয় না। দেশের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, ‘তখনকার দুর্দিনেও এই কাটাকাটি খুনাখুনিই যে ভারতবর্ষের প্রধানতম ব্যাপার, তাহা নহে। ঝড়ের দিনে যে ঝড়ই সর্বপ্রধান ঘটনা, তাহা তাহার গর্জন সত্ত্বেও স্বীকার করা যায় না। সেদিনও সেই ধূলিসমাচ্ছন্ন আকাশের মধ্যে পল্লীর গৃহে গৃহে যে জন্ম মৃত্যু সুখ দুঃখের প্রবাহ চলিতে থাকে, তাহা ঢাকা পড়িলেও মানুষের পক্ষে তাহাই প্রধান।’ ঠিক এই কারণেই ‘অখ্যাত’ হলেও একজন বাঙালির জীবন-পাঠ আমাদের কাছে জরুরি হয়ে ওঠে, কেননা তা একজন মানুষের গুণাবলির আখ্যানেই সীমায়িত থাকে না; ঘটমান জীবনকে কেন্দ্র করে সময় ও মানুষের সম্পর্ককেই প্রাঞ্জল করে। ডঃ শিশিরচন্দ্র সেনকে চেনা তাই এই সময়েও গভীর তাৎপর্যবাহী।
আজ যাঁরা দেশ-দেশ করে হোয়াটসঅ্যাপীয় দেশপ্রেমিক বয়ানে উদ্বেল, তাঁদের দেশগঠনের ভাবনা ও পরিকল্পনায় বিস্তর অন্ধকার। আবার, যাঁরা দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের প্রতি পদক্ষেপকে সমালোচনায় বিদ্ধ করছেন, তাঁদের দেশভাবনার ভিতরও যে স্পষ্ট আলো আছে– এমনটা বলা যায় না। অর্থাৎ দেশ আমাদের কাছে এমন এক ধারণা হয়ে পৌঁছেছে, যা সম্পর্কে আমরা প্রত্যেকে অন্যকে হয় বোঝাচ্ছি, নয় ধোঁকা দিচ্ছি। বিস্তর সন্দীপ, নিখিলেশ প্রায় নেই। ঠিক এরকম ধোঁয়াটে দিনকালেই শিশিরচন্দ্রর কথা পড়তে হয়। তিনি না গান্ধী, না সুভাষচন্দ্র। পাঠ্যবই তাঁর কথা জানাবে না। তবে, তাই বলে তো সেই পরাধীন ভারতে জাহাজের ডাক্তার হয়েও ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে দু’-টিন কুইনাইন চুরির ঘটনাটির গুরুত্ব খাটো হয়ে যায় না। আর সেই সূত্রে যখন আইরিশ ক্যাপ্টেন আর বাঙালি ডাক্তার এক অনুভবে শামিল হন, কেননা দু’জনেই ঔপনিবেশিক শক্তির শিকার, আমরা বুঝতে পারি, দেশের ধারণা ঠিক কতখানি প্রসারিত। ভাল বেতনের চাকরি করতেন শিশিরচন্দ্র। সঞ্চয় জমেছিল বিস্তর। তবে ইংরেজের অন্যায় অপবাদ সহ্য না করে চাকরি ছাড়তে দু’-বার ভাবেননি। সঞ্চয়ের অর্থে আয়েশ করেও জীবনও কাটাননি। দেশের জন্য, মানুষের জন্য ভালো কিছু করার এক দুর্মর আকাঙ্ক্ষা তাঁকে হাতছানি দিত।
শিশিরচন্দ্রের স্বদেশচেতনা আমাদের আজকের স্বার্থ-সুরক্ষিত দেশভাবনাকে যেন একেবারে আয়নার সামনে এনে দাঁড় করায়। স্যর ড্যানিয়েল হ্যামিল্টনের সমবায় ভাবনার সঙ্গে পরিচয় হল তাঁর, আরও নিবিড় করে চিনলেন রবীন্দ্রনাথকেও। অতএব ঝাঁপ দিলেন সমবায় প্রচেষ্টায়। ফলাফল? সমস্ত সঞ্চয় শেষ, সমবায় গড়ে তুলতে গিয়ে ব্যর্থতা এবং পুনরায় চাকরিতে যোগদান। ঠিক এই পর্বে এসে এই বাঙালির জীবন আমাদের গভীর অভিনিবেশ দাবি করে। শুধু সাফল্যের মাস্টারক্লাসের সাজানো কথার ভিতর জীবনের বোধ বোধহয় থাকে না। থাকে এই প্রয়াসের ভিতর। যেখানে ব্যর্থতা আছে, হয়তো দেশের আপন মানুষের হাতেই প্রবঞ্চনার নিয়তি আছে, তবে সবার উপরে আছে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য আর-একজন সফল মানুষের সদর্থক ভাবনা। যিনি বিশ্বাস করতেন দ্বিতীয় শ্রেণির সাহেব হওয়া থেকে প্রথম শ্রেণির ভারতীয় হওয়া শ্রেয়। শুধু শিশিরচন্দ্র নন, আমরা উপলব্ধি করতে পারি, একটা সময়পর্বের ভিতরই ছিল এই আকাঙ্ক্ষার বীজ। শিশিরচন্দ্রের জীবন-ইতিহাস আমাদের সেই স্বদেশভাবনার দিকেই ঠেলে দেয়, যেখানে দেশ কেবল তর্কের বিষয় নয়। সাফল্য-ব্যর্থতায় জীবন দিয়ে তা গড়ে তোলার জিনিস, অনুভব-উপলব্ধি, সর্বোপরি ভালোবাসার জিনিস।
আর তাই গোড়ার বিচারাধীন ‘অখ্যাত’ শব্দটিকে আমরা এই পর্বে এসে মুলতবি করলাম। সময় পেরিয়েও যে বাঙালির জীবন আগামী সময়কে শিক্ষিত করে তুলতে পারে, তাঁর কীর্তি ঘোষিত হওয়াই উচিত। ব্যক্তিসম্পর্ক ব্যতিরেকেও, জীবনচরিত লেখক সমীর সেনগুপ্ত সেই ঘোষণার কাজটি করে সকল বাঙালির ধন্যবাদার্হ হয়ে রইলেন। আমরা শিশিরচন্দ্র এবং তাঁর মতো মানুষের কথা যেন আরও বেশি বেশি করে পড়ি। কেননা মানুষের ইতিহাসের রক্ষাকবচ ছাড়া মানুষের মুক্তির আর কোনও দ্বিতীয় পথ নেই।
একজন অখ্যাত বাঙালির জীবনচরিত
সমীর সেনগুপ্ত
প্রকাশক: পরবাস
প্রচ্ছদ: হিরণ মিত্র
২০০্