দিন যত গড়িয়েছে, ঘোঁতন নিজেও মনে মনে মেনে নিয়েছে সে অপয়া। না-হলে কেন সে মা-কে দেখেনি কোনওদিন? কেন তার বিজ্ঞানী বাবা তাকে ফেলে দিয়ে চলে যাবে গন্ডারিয়া মামার হাতে? কেন তাকে তাড়িয়ে দেবে স্কুল থেকে ‘স্পেশাল’ বলে? স্পেশাল চাইল্ড আর অপয়ার তকমাটা অবশ্য ঘোঁতন গ্রহণ করেছিল চ্যালেঞ্জ হিসেবে। সে চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সে আকাশের তারার সাথে গল্প করত সুদিনের আশায়। প্রশ্ন করত– সে কি পারবে না বিরাট হতে?
১০.
অপয়া নিয়ে এত কিছু শোনা যায়, কিন্তু ‘অপয়ার ছেলে’ বলে লাঞ্ছনা জোটে না সব অপয়ার ভাগ্যে। ঘোঁতনের জুটেছিল। ঘোঁতন কে? ঘোঁতন সেইসব মানুষের মধ্যে গুটিয়ে থাকা কালশিটে যারা জীবনের কোনও কোনও সময়ে পেয়েছে ‘অপয়া’ তকমা– সফল মানুষদের ঠাট্টা-মস্করায়। সবসময় মুখের ওপরেই যে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে অপমান এমন নয়। পিঠ পিছে, ফিসফিসে আলোচনায় বা চোখের চাহনিতেও চাবুকের মতো বুকে এসে পড়েছে এক না-বলা কথা, সপাটে– ‘তুমি অপয়া’। ঘোঁতন যদিও এসব শুনে শুনে অভ্যস্থ হয়েছে ছেলেবেলা থেকেই। পাড়ার গলিতে বড় বাড়ির, বড় স্কুলে পড়া ছেলেগুলো যখন বলে উঠেছে বীভৎস উল্লাসে– ‘অপয়ার ছেলে, কাঁচকলা পেলে’। ঘোঁতন তখন না শোনার ভান করেও হেঁটে হেঁটে পার হয়ে গেছে সে রাস্তা। পা তার ভারী হয়ে এসেছে প্রতিবার। ঠোঁট কেঁপেছে তিরতির করে। আর ঢোঁক গিলতে গিয়ে ব্যথা-ব্যথা করে উঠেছে গলার কাছটায়। আসলে ‘অপয়া’ তকমাটা ছিল ঘোঁতনকে ভেতরে ভেতরে ভেঙে দেওয়ার একটা ছ্যাৎলা-পড়া প্রচেষ্টা। ওর বিরাট হওয়ার স্বপ্নকে ফালা-ফালা করে দেওয়ার আপ্রাণ প্রয়াস।
কেন এমন হয়? কেন কাউকে না কাউকে বাগান থেকে তাজা ফুল তোলার মতো করে বেছে নেয় সমাজ? আর তার ললাটে, পিঠে, বুকের পাটায় কেন ক্ষুরধার নিষ্ঠুরতায় লিখে দেয় ‘তুমি অপয়া’? ভারতবর্ষের সর্বংসহা অধ্যাত্মবাদ বলবে এ হল তার পরীক্ষা। অকারণ অপমান আসলে পরমেশ্বরের সেই কষ্টিপাথর যেখানে ঘষে ঘষে দেখে নেওয়া হয় কে কতটা ‘স্পেশাল’। সহ্য ক্ষমতায় কে কতবার কতগুলো ডিস্টিংশনে পাশ করবে বিরাট হওয়ার পরীক্ষায়। ঘোঁতনের মাকে সবাই ‘অপয়া’ বলেছিল কারণ ঘোঁতন আর পাঁচটা সাধারণ শিশু হয়ে জন্মায়নি। মার্জিনাল আই কিউ বলে তাকে আলাদা খোপে এঁটে দেওয়ার চেষ্টা করেছে আমাদের সফল সমাজ। আর সেই খোপ ভেঙে যত বার মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছে ঘোঁতন, চোখে আঙুল দাদারা অপমানের ফেরিওয়ালার মতো হাঁক পেড়েছে– ‘অপয়ার ছেলে কাঁচকলা পেলে’!
দিন যত গড়িয়েছে, ঘোঁতন নিজেও মনে মনে মেনে নিয়েছে সে অপয়া। না-হলে কেন সে মা-কে দেখেনি কোনওদিন? কেন তার বিজ্ঞানী বাবা তাকে ফেলে দিয়ে চলে যাবে গন্ডারিয়া মামার হাতে? কেন তাকে তাড়িয়ে দেবে স্কুল থেকে ‘স্পেশাল’ বলে? স্পেশাল চাইল্ড আর অপয়ার তকমাটা অবশ্য ঘোঁতন গ্রহণ করেছিল চ্যালেঞ্জ হিসেবে। সে চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সে আকাশের তারার সাথে গল্প করত সুদিনের আশায়। প্রশ্ন করত– সে কি পারবে না বিরাট হতে? আর ঠিক তখনই তারা খসার মতো গোঁ গোঁ শব্দ তুলে উড়ে যেত এরোপ্লেন, তাকে আশ্বাস দিতে। আর সূর্য মাখা হাসি ফুটে উঠত তার মুখে অপয়ার অপবাদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। তার স্বপ্নে ঠিক তখনই নেমে আসত পরিপিসি। কান্না ঘোরে জড়িয়ে ধরে যে ঘোঁতনকে পড়াত রাজপুত্তুর হওয়ার পাঠ। সাত স্বাদের অলীক জেলি তার হাতে তুলে দিত হাতিয়ার রূপে। পয়া-অপয়ার সমস্ত গন্ডি ভেঙে দিল যেদিন সূর্যের সাত রঙের মন্ত্র, সেদিন ঘোঁতন প্রথম অনুধাবন করল সত্য–
স্বপ্ন যেভাবে লেখে আঁকে
ভালোবেসে ডেকেছে সে তাকে
গোধূলি পেরোলে শেষ বাঁকে
চুপি চুলি বলেছে কে থাকে।
যতদিন বেরঙিন
ছিল মন বোঝেনি
আলো দাগ, কি সোহাগ
শেখাল বেঁচে থাক
সূর্যের সাত রং সাত রং সাত রং
আজ তার সামনে ‘অপয়া’-র সংজ্ঞা কেবল অবাস্তব একটা শব্দ মাত্র।
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ৯। চোখের নাচন– কখনও কমেডি, কখনও ট্র্যাজেডি!
পর্ব ৮। জুতো উল্টো অবস্থায় আবিষ্কার হলে অনেক বাড়িতেই রক্ষে নেই!
পর্ব ৭। জগৎ-সংসার অন্ধ করা ভালোবাসার ম্যাজিক অপয়া কেন হবে!
পর্ব ৬। প্রেম সেই ম্যাজিক, যেখানে পিছুডাক অপয়া নয়
পর্ব ৫। ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো
পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা
পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
পর্ব ১। পান্নার মতো চোখ, কান্নার মতো নরম, একা