Robbar

যাঁদের নাম কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, উডি তাঁদেরই নাম ধরে ডাকলেন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 13, 2024 8:57 pm
  • Updated:December 13, 2024 8:57 pm  

গণকবরে পর পর লাশ শুয়ে আছে। তাঁদের নাম-পরিচয় জানার কোনও আগ্রহ নেই রাষ্ট্রের। তাঁদের মৃত্যুর খবর ঘরে পৌঁছে দেওয়ার দায় নেই রাষ্ট্রনেতাদের। উন্নত দেশের মাটির নীচে শুধু ভাঙাচোরা হাড়গোড়। যেন এক গোটা সভ্যতা শুয়ে আছে মরে পড়ে। উন্নত দেশ সত্য মাটি চাপা দিয়ে রাখে। চুপ করে থাকতে পারলেন না মার্কিন দেশের লোকসংগীতের প্রবাদমানুষ উডি গাথরি। রাগে-দুঃখে লিখলেন এক প্রতিবাদের কবিতা– ‘ডিপোর্টি’।

প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়

১১.

ডিপোর্টি, উডি গাথরি, মার্টিন হফম্যান, আমেরিকা

১৯৪৮, ২৮ জানুয়ারি। ক্যালিফোর্নিয়ার ফ্রেস্নো কাউন্টির ওপর দিয়ে চলছে একটি উড়োজাহাজ, ডগলাস ডিসি ৩। উড়োজাহাজে রয়েছেন ২৮ জন মেক্সিকান মজুর। যাঁদের কর্মচুক্তি বাতিল করা হয়েছে মার্কিন দেশে। আর রয়েছেন কিছু বেআইনি শরণার্থী। প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের মার্কিন মুলুক থেকে এঁদের মেক্সিকোতে ফেরত পাঠানো হচ্ছে যেনতেন প্রকারে। যেনতেন প্রকারে কেন? কারণ উড়োজাহাজকে যে নির্দিষ্ট সুরক্ষা নিয়মাবলি মেনে চলতে হয়, সেসব কিছুই করা হয়নি। কেন? কারণ বাতিল হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের প্রাণের দাম থাকে না। দেশ থেকে তাড়াতাড়ি বের করে দিতে পারলে শান্তি! উড়োজাহাজটিতে ২৩ জনের বেশি যাত্রী নেওয়া যায় না, কিন্তু বোঝাই করা হয়েছে তিরিশজনেরও বেশি যাত্রী।

মেক্সিকান শ্রমিকরা ফিরে যাচ্ছে, ফিরে কি যাচ্ছে?

সকাল সাড়ে দশটায় উড়োজাহাজটি লস গ্যাটোস ক্যানিয়ানের ওপড় আছড়ে পড়ল, প্রচণ্ড জোড়ে একটা বিস্ফোরণ। রেডিওতে এবং পরদিন নিউ নিয়র্ক টাইমসে জানানো হল এই দুর্ঘটনার কথা। বলা হল কিছু নির্বাসিত (ডিপোর্টি) মারা গেছেন। পাইলট এবং তাঁর দলের ছাড়া কারও নাম প্রকাশ করা হল না। ওই নামহীন বহিঃস্কৃতদের ফ্রেস্নো কাউন্টির হলি ক্রস কবরখানায় গণকবর দেওয়া হল। মৃতদের আত্মীয়স্বজন, কাছের মানুষ কেউ তাঁদের শেষকৃত্য পালন করার সুযোগ পেল না। বহু পরিবার জানলই না দূরদেশে কাজ করতে যাওয়া তাঁর প্রিয় মানুষটি কোথায় হারিয়ে গেল মাঝপথে!

1948 Los Gatos DC-3 crash.... "Deportee" fame... - RareNewspapers.com

বহিঃস্কৃতদের নাম থাকে না। নিজস্ব স্বীকৃত কবরে থাকে না। দেশ থাকে না। বাতিল শ্রমিকের জীবনটুকুও থাকে না।

গণকবরে পর পর লাশ শুয়ে আছে। তাঁদের নাম-পরিচয় জানার কোনও আগ্রহ নেই রাষ্ট্রের। তাঁদের মৃত্যুর খবর ঘরে পৌঁছে দেওয়ার দায় নেই রাষ্ট্রনেতাদের। উন্নত দেশের মাটির নীচে শুধু ভাঙাচোরা হাড়গোড়। যেন এক গোটা সভ্যতা শুয়ে আছে মরে পড়ে। উন্নত দেশ সত্য মাটি চাপা দিয়ে রাখে।

Woody Guthrie in New York, 1943
১৯৪৩। নিউ ইয়র্কে উডি গাথরি

চুপ করে থাকতে পারলেন না মার্কিন দেশের লোকসংগীতের প্রবাদমানুষ উডি গাথরি। রাগে-দুঃখে লিখলেন এক প্রতিবাদের কবিতা– ‘ডিপোর্টি’। তার প্রায় দশ বছর পর মার্কিন হফম্যান নামের এক কলেজ ছাত্র কবিতাটিতে সুর করলেন। সেই গান গাইলেন পিট সিগার, আর্লো গাথরি, জোয়ান বায়েজ, জুডি কলিন্স, ব্রুস স্প্রিংসস্টিন-এর মতো স্বনামধন্য শিল্পীরা। উডি গাথরি অবশ্য তাঁর কবিতা থেকে কালজয়ী গানের রূপান্তর দেখে যেতে পারেননি।

Woody Guthrie in New York: Photos of an American Treasure, 1943
উডি গাথরি

তবে উডি গাথরি যে আশ্চর্য এক শিল্পী, তা শুধু নামহীন, বাতিল শ্রমিকদের নিয়ে গান লেখা দিয়ে প্রতিপন্ন করা যাবে না। এই গানটি তিনি শুরু করেন খেতের পর খেতে শস্য নষ্ট হওয়ার এক দৃশ্য দিয়ে। তিনি বলেন, খেতে ফল পচে পড়ে রয়েছে। সব ফল নষ্ট হয়ে গেছে। ফসল এবার ক্ষুধা প্রশমন করতে পারবে না। তার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে এক উড়োজাহাজ। তাতে বোঝাই বাতিল শ্রমিক। কেন এমন এক দৃশ্য দিয়ে তিনি এই গানটি শুরু করেন? কারণ সেসময় মার্কিন দেশ কৃষকদের ফসল নষ্ট করার নিদান দিয়েছিল। বাজারে খাদ্যের জোগান কম থাকলে খাদ্যের দামবৃদ্ধি করা ।যাবে– এই উদ্দেশ্যে ফসল নষ্টের নির্দেশ। সেসময় মার্কিন দেশের সুফসলী  জমিতে বিষাক্ত কীটনাশক দেওয়া হয়েছিল। উডি মার্কিন দেশকে বর্ণনা করেন নষ্ট শস্যের দেশ হিসেবে।

The crops are all in, and the peaches are rotten
The oranges are packed in the creosote dumps
They’re flying us back to the Mexico border
To pay all our money to wade back again

Goodbye to my Juan, goodbye Rosalita
Adios mi amigos, Jesus and Maria
You won’t have a name when you ride the big airplane
All they will call you will be Deportee

Now my father’s own father, he waded that river
They took all the money her made in his life
Six-hundred miles to the Mexico border
They chased us like rustlers, like outlaws, like thieves

Goodbye to my Juan, goodbye Rosalita
Adios mis amigos, Jesus and Maria
You won’t have a name when you ride the big airplane
No all they will call you will be Deportee

The sky-plane caught fire, over Los Gatos Canyon
A big ball of fire, it shook all the ground
Who are these friends, who are falling like dry leaves
The radio said they were just deportees

Goodbye to my Juan, goodbye Rosalita
Adios mis amigos, Jesus and Maria
You won’t have a name when you ride the big airplane
No all they will call you will be Deportee

But we died in your hills, we died in your valleys
We died in your orchards, we died on your plains
We died on your deserts, we died in your treetops
Both sides of the river we died just the same

Goodbye to my Juan, goodbye Rosalita
Adios mis amigos, Jesus and Maria
You won’t have a name when you ride the big airplane
No all they will call you will be Deportee.

আহা দরদী উডি। ভালোবেসে নাম দিলেন মৃত শ্রমিকদের। বিদায় জানালেন তাঁদের নাম ধরে ডেকে ডেকে। হুয়ান, রোজালিটা, জেসাস, মারিয়া। নিজের ভাষায় বিদায় জানালেন, মেক্সিকান ভাষায় বিদায় জানালেন। শেষ মুহূর্তে তিনি সম্পর্ক পাতালেন মৃতদের সঙ্গে। পরিবার-প্রিয়জনের থেকে দূরে মৃত্যুবরণের ক্ষত তিনি সারিয়ে তুলতে চাইলেন। উডি তাঁদের পাশে এলেন, আলতো স্বরে ডাকলেন।

উডি শুধু গান লিখে প্রতিবাদ করেননি। ফসলহীন খেতের বর্ণনা দিয়েই শুধু প্রতিবাদ করেননি। রাষ্ট্র যাঁদের নাম দিতে চাননি, তাঁদের নাম দিলেন উডি। সেই নামে ডাকলেন। হোক না সে নাম কল্পনাপ্রসূত। হোক না সে নাম উডির দেওয়া।

উডি গাথরির স্বাক্ষর তাঁর সোজা-সাপটা সরল ভাষা। আপাতদৃষ্টিতে একটু গদ্য ঘেষা মনে হলেও হঠাৎ কোন ফাঁকে যে কবিতা মিশে যায়, তা টের পাওয়া যায় না। এই কবিতায় মৃতদের বর্ণনা করা হয়েছে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা শুকনো পাতা বলে।

Deportees Killed in 1948 Plane Crash Recognized After 70 Years | UAPress

 

 

ঘটনার প্রায় ৬৫ বছর পর, বারাক ওবামার আমলে ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩-তে হলি ক্রস করবখানায় ডিপোর্টি মেমোরিয়াল প্রস্তরফলক বসানো হয়।

আমি বিশ্বাস করতে চাই, উডি গাথরির গানের জন্যই এ সম্ভব হয়েছে। ৬৫ বছর পর।

…পড়ুন গানস অ্যান্ড রোজেস-এর অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ১০। মৃত শিশুদের বয়স বাড়ে না, সভ্যতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে যুদ্ধের চিহ্ন হয়ে

পর্ব ৯। একটা আশাবাদ ও একটা অনলস কৌম চেতনা

পর্ব ৮। একটা গান থেমে যায়, চিৎকার ভেসে ওঠে

পর্ব ৭। সচ্ছলতার বিনিময়ে দমবন্ধ করা এক স্বপ্নহীন, স্বাধীনতাহীন জীবন

পর্ব ৬। তিনটি মানুষ ও একটি কারাগার

পর্ব ৫। কাব্যিক অভিপ্রায় ছাপিয়ে যে গান রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষায় মিশে যায়
পর্ব ৪। যে সৈনিক কবর খোঁড়ে বেঁচে থাকার তাগিদে
পর্ব ৩। যে প্রশ্ন শহরের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ায়, উত্তর পাওয়া যায় না
পর্ব ২। আহা ফুল, কবরের ফুল, মাটিকে অমন ভালোবেসে পাশাপাশি ঘুমিয়ে থেকো না
পর্ব ১। বব ডিলানের এই গান ভবিষ্যৎবাণীর মতো নিদান দেয়– যুদ্ধ আসন্ন