মন্দার সময়ে বিনোদনের খিদে বেড়ে যায়। কিন্তু আগের মতো উচ্চমানের কোয়ালিটি কীভাবে দেবে হলিউড এই মন্দার বাজারে? সেই সময়ে দু’খানি কনসেপ্ট তৈরি হয়েছিল, দু’টিকেই এখন আমরা ভিন্নভাবে চিনি। হলিউড ঠিক করল যে মান বজায় রাখার উপায় হল ছবির দৈর্ঘ্য কমিয়ে দেওয়া। যত দৈর্ঘ্য কমবে ছবির, দৃশ্যের সংখ্যা কমবে, কমবে খরচ, শুটিংও কম সময়ে গুটিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু আগে তো লোকে একটা টিকিটে আড়াই থেকে তিনঘণ্টার ছবি দেখত, সে একই দামে সোয়া এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টার ছবি দেখবে কেন? উপায় বেরল– টিকিট একটাই কাটবে দর্শক, কিন্তু ইন্টারভালের আগে দেখবে একটা ছবি, পরে দেখবে আরেকখানি। তাহলে কি স্টুডিওকে দু’খানি ছবি মুক্তি দিতে হবে?
১৩.
ফিল্ম নোয়ার সঙ্গে অনেকে শৈলীগতভাবে অন্য জঁরকে গুলিয়ে ফেলেন। আগের কিস্তিতেই এই নিয়ে বলেছিলাম। এর মধ্যে একটা হল– গ্যাংস্টার জঁর। এই জঁর নিয়ে আমি খুব সংক্ষেপে লিখব। কেন সংক্ষেপে লিখব, সেটাও গুছিয়ে বলার চেষ্টা করব। এই কলামে আমি সিনেমায় জঁর নিয়ে লিখছি। কিন্তু এই কলাম জঁর ফিল্মের ইতিহাসের কোনও টেক্সট বইয়ের মতো পুরিয়া নয়। লিখছি আমার ব্যক্তিগত ভালো লাগার জায়গা থেকে; কোনও নৈর্ব্যক্তিকতার অবস্থান থেকে নয়। আমার গ্যাংস্টার জঁরকে ইদানীং আর ভালো লাগে না; এই ব্যক্তিগত না-পসন্দের কথাই গুছিয়ে লিখব পরে। আবার বলছি, মতামত ব্যক্তিগত।
দেখা যাচ্ছে, সব আলোচনাতেই আমেরিকার ইতিহাস চলে আসছে। অনেকের মনে হতে পারে, জঁর কি তাহলে শুধুই আমেরিকার কুক্ষিগত? না, তা নয়। যেমন সামুরাই জঁর, বা মার্শাল আর্টসের জঁর আমেরিকার কীভাবে হবে? অথবা মিউজিকাল ফর্মটায় ভারতীয় ছবির একদম নিজস্ব একটা ছাপ আছে। কিন্তু আমেরিকার ইতিহাস এই জন্যই আসছে, আমেরিকাতে পপুলার কালচারে জঁর-কল্পনাকে একটা বিশেষ সফিস্টিকেশনের দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। জঁরও যে ইতিহাসের ওপর মন্তব্য করতে পারে, জঁর যে আধুনিক মিথোলজি হতে পারে, তার অনেক দৃষ্টান্ত আমার প্রিয় জঁর ওয়েস্টার্ন নিয়ে বলেছি প্রথমদিকের কিস্তিগুলোয়। তাই আমেরিকার ইতিহাস দিয়ে ফের শুরু করতে হবে।
ঠিক যে সময়ে সবাক ছবির উত্থান হচ্ছে, সেই সময়ের আমেরিকার দু’খানি মেজর ঘটনা হল ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ এবং ‘প্রহিভিশন এরা’। ১৯২৯-এ ওয়াল স্ট্রিটে স্টক মার্কেটে বিশাল ধস নামে। এই ঘটনা ক্যাপিটালিজমের একধরনের সংকটের মুহূর্ত। আন্তর্জাতিক ব্যবসায় মন্দা, ছোট ব্যবসার পতন, দারিদ্র, জীবিকাহীনতা ইত্যাদি অবশ্যম্ভাবী তো ঘটেই, আমেরিকায় এই সময়েই ‘ডাস্ট বাওল’ নামে বিশাল বালিঝড়, খরা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছিল, কৃষিজীবীদের জীবনে নেমে এসেছিল ভিন্ন বিপর্যয়। এই সংকটের সূত্রপাত আমেরিকায়, কিন্তু ধনতন্ত্র ততদিনে সারা পৃথিবীকে একই সূত্রে গেঁথে ফেলেছে, রেয়াত পায়নি অন্য দেশগুলিও।
ইতিমধ্যে ১৯২০ থেকে ’৩৩ অবধি চলেছে ‘প্রহিভিশন এরা’, অর্থাৎ, অ্যালকোহলিক পানীয়র ওপর নিষেধাজ্ঞা। মদ্যপান সামাজিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক বলে কি আর তা উপভোগ করা ঠেকিয়ে রাখা যায়? বুটলেগ পানীয়র ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠল, এবং তা গড়ে তুলল শক্তিশালী মাফিয়া-সাম্রাজ্য। শিকাগোর মতো শহরে আল কাপোনের মতো মাফিয়া-রাজারই শাসনাধীন হল বলা যায়। সরকার এবং বৈধ ক্যাপিটালিজম তো আর চাকরি-বাকরি দিতে পারছে না; পাড়ার পর পাড়া, শহরের পর শহর দোকান-পাট, ছোট ব্যবসার গ্যারান্টি দিচ্ছে ‘অবৈধ’ ক্যাপিটালিজম। অতএব পুলিশ বা কর্তৃপক্ষ সেই সম্রাট ও তার সৈন্যদের গায়ে হাত দিতে পারছে না, কারণ তাহলে সাধারণ মানুষ বলবে– এরা তো তাও আমাদের কাজের সংস্থান দিচ্ছিল, এদেরকে গারদে পুরলে, আমাদের জীবিকার কী হবে? চাকরি-বাকরি তাহলে তোমরা দাও। আল কাপোনের প্রতিপত্তি কতটা ছিল বোঝা যায় এতেই, যে তার অপরাধের জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি, সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছিল না; তাকে শেষমেশ পুলিশ ধরে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য!
……………………………………..
মুনাফা আর শ্রমের শোষণের ভিতে প্রতিষ্ঠিত একটি তন্ত্র আর কীভাবেই বা সবাইকে সমান সুযোগ দেবে? স্বপ্নটা ঠিক ভ্যানিশ হয়ে গেল না, বলা যায় বিকৃত হয়ে গেল। আমেরিকায় তিনের দশকেও কি একজন কপর্দকশূন্য মহারাজ হয়ে যেতে পারে? হ্যাঁ, এখনও পারে, তবে সৎপথে নয়, অসততার পথে। ব্যবসায় সাফল্য আসে কি এরকম মন্দায়? আসে, যদি ব্যবসা হয় অর্গানাইজড ক্রাইমের।
………………………………………
সময়টা আশাব্যঞ্জক ছিল না তো বোঝাই যাচ্ছে। একটি মিথ, বা ধারণা এইবার ঝাড় খেয়ে গেল ভালোভাবে, সেটা হল ‘দ্য গ্রেট আমেরিকান ড্রিম’। যেহেতু মার্কিন দেশটি ঐতিহ্যহীন একটি ভুঁইফোড় সভ্যতা, তার (অর্থাৎ, শ্বেতাঙ্গ মার্কিনিদের) না আছে এই মহাদেশে কোনও বৈধ অতীত, না ঐতিহ্য। আবার এর উল্টো পিঠ হল, সেখানে শতক শতক জুড়ে সামাজিক হায়ারার্কিও ছিল না। অতএব আমেরিকা হয়ে গেছিল সম্ভাবনার এক মহাদেশ, যেখানে কপর্দকশূন্য একজন মানুষও সৎপথে, শ্রমে নিয়োজিত হয়ে রাজারাজড়া হয়ে যেতে পারে। চাষার ছেলেকে চাষাই থাকতে হবে, মুটের ছেলেকে মুটে– এরকম ঐতিহ্যের অভাবকেই তরুণ ধনতন্ত্র এইভাবে সবার সমান সুযোগের ইউটোপিয়ায় পরিণত করতে চেয়েছিল। কিন্তু মুনাফা আর শ্রমের শোষণের ভিতে প্রতিষ্ঠিত একটি তন্ত্র আর কীভাবেই বা সবাইকে সমান সুযোগ দেবে? স্বপ্নটা ঠিক ভ্যানিশ হয়ে গেল না, বলা যায় বিকৃত হয়ে গেল। আমেরিকায় তিনের দশকেও কি একজন কপর্দকশূন্য মহারাজ হয়ে যেতে পারে? হ্যাঁ, এখনও পারে, তবে সৎপথে নয়, অসততার পথে। ব্যবসায় সাফল্য আসে কি এরকম মন্দায়? আসে, যদি ব্যবসা হয় অর্গানাইজড ক্রাইমের।
এই সময়ে আরেকটি নাটকীয় পরিবর্তন ঘটছে মিডিয়ার ইতিহাসে। প্রতিষ্ঠিত মাধ্যমগুলি, রেডিও বা বড় নিউজপেপার যখন চেষ্টা করে যাচ্ছে জাতির স্পিরিটকে উড্ডীন রাখার, সেই সময়েই ভিন্ন একধরনের খবরের কাগজ বেরতে লাগল। খুবই প্রতীকীভাবে এই কাগজগুলি বেরত সন্ধে নামলে; এদেরই বলা হত ‘ইভনিং ট্যাবলয়েড’। সেই খবরের কাগজগুলি ছিল জাতির তমসার উদযাপন। সেক্স-স্ক্যান্ডাল, ক্রাইম, খুন-খারাপি ইত্যাদি সেনসেশনাল গরম খবরের মুচমুচে পরিবেশন ঘটত এইসব হলদে সাংবাদিকতায়। সেখানে জাতির বিবেকের ব্যাগেজ নেই, নেই নৈতিকতার ক্যাথলিক দায়। মাফিয়ারাজ এইসব ট্যাবলয়েডে অবৈধ গ্ল্যামারে রাঙানো হল যেমন, আবার কীভাবে যেন সংকটে পড়া ধনতন্ত্রেরও শ্লেষাত্মক সমালোচনা উচ্চারিত হতে লাগল এই পতনের ধারাবিবরণীতে।
সেই সময়ে মন্দা ছুঁয়েছে হলিউডকেও। মন্দার সময়ে বিনোদনের খিদে বেড়ে যায়। কিন্তু আগের মতো উচ্চমানের কোয়ালিটি কীভাবে দেবে হলিউড এই মন্দার বাজারে? সেই সময়ে দু’খানি কনসেপ্ট তৈরি হয়েছিল, দু’টিকেই এখন আমরা ভিন্নভাবে চিনি। হলিউড ঠিক করল যে মান বজায় রাখার উপায় হল ছবির দৈর্ঘ্য কমিয়ে দেওয়া। যত দৈর্ঘ্য কমবে ছবির, দৃশ্যের সংখ্যা কমবে, কমবে খরচ, শুটিংও কম সময়ে গুটিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু আগে তো লোকে একটা টিকিটে আড়াই থেকে তিনঘণ্টার ছবি দেখত, সে একই দামে সোয়া এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টার ছবি দেখবে কেন? উপায় বেরল– টিকিট একটাই কাটবে দর্শক, কিন্তু ইন্টারভালের আগে দেখবে একটা ছবি, পরে দেখবে আরেকখানি। তাহলে কি স্টুডিওকে দু’খানি ছবি মুক্তি দিতে হবে? তাহলে তো সেই খরচ বেড়েই গেল, দ্বিগুণ হয়ে গেল! মনে রাখতে হবে, এটা ধ্রুপদী স্টুডিও যুগ, একটি বড় স্টুডিওর হাতে প্রোডাকশন, ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক, এগজিবিশন চেন তিনটেই আছে। সারা পৃথিবীর প্রতিটা বড় শহরে মেট্রো সিনেমা আছে সেই সময়ে, মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ারের ছবি দেখানোর জন্য। তাহলে কি MGM-কে প্রতি শুক্রবার একটা টিকিটে দুটো ছবি দেখাতে হবে? না, চমকপ্রদ বুদ্ধিটা এখানেই। বিরতির পরের সময়টা ধার দেওয়া হবে সেইসব ছোট স্টুডিওদের, যাদের বড়জোর প্রোডাকশন ইউনিট আছে, বিতরণ ব্যবস্থাও নেই, প্রেক্ষাগৃহের মালিকানাও নেই। এই ব্যবস্থার নামই double-bill, এক টিকিটে দুটো ছবি। এই ছোট স্টুডিওর ছবিই হল B-Grade ছবি।
তো সেই ছোট স্টুডিওগুলোর কি বরাত খুলে গেল? হ্যাঁ, কিন্তু অত সহজে নয়। তাদের না আছে বড় স্টুডিওর ইনফ্রাস্ট্রাকচার, না আছে সেরকম স্টার-অভিনেতা-নির্মাতা-কুশীলবের তালিকা, গ্ল্যামার তাদের অধরা। তারা কীভাবে বিরতির আগের ঝকঝকে ছবির সঙ্গে কমপিট করবে? কম্পিটিশন তো শুধুই বড়দের সঙ্গে নয়, নিজেদের সঙ্গেও। ছবির ফিডব্যাক খারাপ হলে বড় স্টুডিও আগামী কালই বিরতির পরের সময়টা অন্য কাউকে দিয়ে দেবে। তাহলে কীভাবে টিকে থাকা? নতুন কী দেওয়া যায়, যা বড় স্টুডিও দিতে পারবে না। একটা রাস্তা খুলে গেল, বড় সংবাদমাধ্যম কী দিতে পারে না, যা ছোটরা দেয়? ওই যেসব সান্ধ্যকালীন ট্যাবলয়েড, যারা সন্ধেবেলায় সকালবেলার নিউজ পেপারগুলোকে হেভি কম্পিটিশন দিচ্ছে, তাদের খবর থেকে তুলে আনো গল্প! এই গল্প ঝকঝকে হওয়ার দরকার নেই, তমসাচ্ছন্ন হতেই হবে– এই গল্প রাতের আমেরিকার গল্প।
বিরতির পরের এই বি-গ্রেড প্রোডাকশনের গল্পগুলো এমন হট কচুরির মতো বিক্রি হতে লাগল, যে তৈরি হল নতুন কিছু জঁর। ফিল্ম নোয়া তো আছেই, একধরনের হরর ছবিও। এবং সেই মাফিয়াদের গল্প নিয়ে গ্যাংস্টার জঁর। সভ্যতার সূর্যগ্রহণের মুহূর্তটা ছায়ামূর্তিদের গল্প বলারই তো সময়।
এই সময়েই আমার এক প্রিয় চরিত্রর উত্থান। ব্যাটম্যানের, কিন্তু সে ভিন্ন গল্প।