ফলে সোমার এপিসোড যত এগিয়ে আসতে লাগল, ভয়ে আমার বুক ঢিপঢিপ করছিল। আমি জানি নাছোড় পাঁচ অ্যাঙ্কার কথার জালে চেপে ধরবেই তাঁকে। সোমার ছবি দেখেছি আনন্দলোক-এর পাতায়। উজ্জ্বল, প্রাণোচ্ছল এক হাসিমুখ। উত্তমকুমারের পিঠে উঠে হাসছে নবীন কিশোরী। ফোনে যে সোমার সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁর কণ্ঠস্বরে ভয়, একটা আকুতিও আছে– আমায় ছেড়ে দিন। শুধু ঋতুদার কথায় এসেছেন তিনি। কিন্তু ঋতুদা কাকে রক্ষা করবে আজ? প্রোগ্রামকে না পারিবারিক বন্ধুকে?
১৪.
সুপ্রিয়া, সাবিত্রী, সুমিত্রা, মাধবী– তাবড় তাবড় সব উত্তম নায়িকা এসেছিলেন ‘অচেনা উত্তম’-এ আলোকপাত করতে। অথচ সবচেয়ে কম পরিচিত এক নায়িকাকে ঘিরে আমাদের উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে! কারণ মূলত একটাই। মৃত্যুর আগের রাতে যে-বন্ধুর বাড়িতে পানীয়-ভোজনের আসর বসেছিল, সেই পার্টিতে সুপ্রিয়া নয়, উত্তমের সঙ্গী ছিলেন সোমা। কী ঘটেছিল সেদিন– সেই হাঁড়ির খবর যদি কারও থাকে, তবে তিনিই।
আমাদের অনুষ্ঠান খুব অন্তর্তদন্তমূলক ছিল না। কিন্তু উত্তম ফ্যান ক্লাবের সকলেই যেহেতু ‘হুঁশিয়ার’ অ্যাঙ্কার, ফলে কৌতূহলের মাত্রা ছিল অস্বাভাবিক। হয়তো সেটা অনুষ্ঠানের নামের কারণেই। যে উত্তমকে আমরা চিনি না, তাঁর খোঁজ বড় হয়ে উঠেছিল সবার মনে। স্মরণের বাইরে এ ধরনের ইনভেস্টিগেটিভ প্রশ্নমালা কখনও কখনও অতিথিদের কাছে বিরক্তি বয়ে এনেছে। সাবুদি বেশ অফেন্ডেড হয়েছিলেন যখন তাঁর কাছে বারবার জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁর ও উত্তমের সম্পর্কের ব্যাপারে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি না বলি, তোমরা কিছু করতে পারবে?’ সুপ্রিয়া দেবী যখন উত্তমকে নিয়ে কথা বলেন, মনে হয় আরতি করছেন। তিনি সাক্ষাৎকারের এক জায়গায় বলেছিলেন, শুটিংয়ে বেরনোর সময় উত্তমকে পায়ে হাত ছুঁয়ে প্রণাম করে যেতেন। মধুছন্দা কার্লেকারের ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ হয়নি! তিনি বারবার বলতে লাগলেন, ‘এ আবার কী, প্রণাম করতেন কেন?’ সুপ্রিয়া দেবী জবাব দিলেন, ‘মানুষটা আমার কাছে যে আসনে আসীন ছিলেন, প্রণাম করতে ভাল লাগত আমার।’ মৌ তখন বলে, ‘আমি কিন্তু জীবনে কখনও কাউকে প্রণাম করিনি।’ প্রণাম করার যৌক্তিকতা নিয়ে একটা চাপা টেনশন তৈরি হয়েছিল ওই এপিসোডে।
কনসোল-এ বসে বুঝতে পারছিলাম, আসলে উত্তমকুমার প্রণাম পেতে ভালবাসতেন। যে ফুলে যে দেবতা তুষ্ট। বাকি সবার আহ্লাদী অ্যানেকডোটের উচ্ছ্বাসী নির্যাস ছিল এই– মহানায়ক উত্তমকুমার একজন আদ্যন্ত ফিউডাল প্রভু ছিলেন। আর অভিয়াসলি, ফিউডালমে কুছ কালা হ্যায়। প্রসিদ্ধ সাংবাদিক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে শোনা, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে উত্তম গলা চড়িয়ে সুপ্রিয়াকে বলছেন, কী শাড়ি ও ব্লাউজ তিনি পরে আসবেন রাতের পার্টিতে। একটা জমিদারি ভাব ছিল ভীষণরকম। আল্ট্রা মেল শক্তিশেল টাইপ। যিনি সারাজীবন ঠাকুরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, বাস্তবে তিনি ঘোরপাপী গাঁটকাটা হতেই পারেন, ঠিক যেমন আমজাদ খান পর্দার বাইরে ‘গব্বর সিং’ নন। ফলে বাঙালির প্রিয়তম হাসির মালিককে কখনও কখনও প্যাট্রিয়ার্কি প্যাকাটির খোঁচা দিচ্ছিল বইকি। স্ক্যান্ডাল তাঁর জীবনের অনুষঙ্গ ছিল। বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম, সংসার ত্যাগ, পছন্দের মানুষের সঙ্গে অন্যত্র লিভ-ইন, ব্যাপারগুলো সাতের দশকে সহজলভ্য ছিল না। কিন্তু উত্তমের জীবন আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত বাঙালির নয়। গ্ল্যামারের সিঁড়িতে কিছু লুকনো গর্ত থাকে, এবং সবটুকুই উত্তম নয়। নায়ক ছবির অরিন্দমের মতো। লা দলচে ভিটা’র মার্সেল্লোর মতো। এই অন্ধকারগুলো বড় প্রকট হয়ে যাচ্ছিল কাটাছেঁড়ায়।
ফলে সোমার এপিসোড যত এগিয়ে আসতে লাগল, ভয়ে আমার বুক ঢিপঢিপ করছিল। আমি জানি নাছোড় পাঁচ অ্যাঙ্কার কথার জালে চেপে ধরবেই তাঁকে। সোমার ছবি দেখেছি আনন্দলোক-এর পাতায়। উজ্জ্বল, প্রাণোচ্ছল এক হাসিমুখ। উত্তমকুমারের পিঠে উঠে হাসছে নবীন কিশোরী। ফোনে যে সোমার সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁর কণ্ঠস্বরে ভয়, একটা আকুতিও আছে– আমায় ছেড়ে দিন। শুধু ঋতুদার কথায় এসেছেন তিনি। কিন্তু ঋতুদা কাকে রক্ষা করবে আজ? প্রোগ্রামকে না পারিবারিক বন্ধুকে?
পড়ুন ঋইউনিয়ন-এর আগের পর্ব: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
শুরুর দিকটায় কিছু এলোমেলো কথা। সোমার বড় হওয়া, বাবার সঙ্গে সম্পর্ক, প্রথম অভিনয় জগতে পা রাখা, মায়ের শাসন ইত্যাদি। আসল কথাটা পাড়লেন বিকাশদা। ‘বাবির মৃত্যুর আসল গল্পটা বলুন।’ জীবনের নানা ঝড়ঝাপটা সকলকে অতিশয় স্মার্ট করে তোলে না, কেউ কেউ মুখচোরা নার্ভাসও হয়। সোমা সেই গোত্রের। ক্লোজ আপ ক্যামেরা একটানা ধরে রেখেছে তাঁকে, ঠোঁটজোড়া কাঁপছে তাঁর।
–তারপর আপনি আর আপনার বাবি শুটিংয়ের পর গেলেন দেবেশ ঘোষের বাড়ি। তারপর বলুন…।
–হ্যাঁ, মানে বাবির শরীরটা একটু খারাপ বলেছিল। কিন্তু দেবেশ আঙ্কল জোর করায়…
–কী মদ খেয়েছিলেন, কোন ব্র্যান্ডটা?
–বাবি তো স্কচই ভালোবাসতেন বরাবর।
–ব্র্যান্ডটা বলে ফেলুন…
–সিভাস মানে…
–সিভাস রিগাল, তাই তো?
–আচ্ছা মা যাননি সেদিন?
–না মায়ের সেদিন শরীরটা…
–কোথায় ছিলেন তিনি?
সোমার অসহায় ঠোঁট নড়ে উঠল আরও একবার, কথা বেরল না।
–বেশ, আমিই বলে দিচ্ছি, উনি সেদিন ভর্তি ছিলেন নার্সিং হোমে, কী তাই তো?
–না… মানে…
–বলছি তো, সেদিন বাড়িতে ছিলেন শুধু দু’জন– আপনি এবং আপনার বাবি, এবার বলুন, সেদিন কী মেনু ছিল?
সোমা হাতড়াতে থাকে ফ্ল্যাশব্যাক, ‘‘যের’ম সাধারণ বাড়িতে হয়, পোলাও, মাংস।’’
–আর আপনার বাবির ফেভারিট চিংড়ি মাছ, ছিল না?
–হ্যাঁ, ছিল তো সেদিন।
–কতগুলো চিংড়ি মাছ খেয়েছিলেন সেদিন?
সোমা ফাম্বল করে।
–বলুন, ঠিক কতগুলো চিংড়ি, তারপর কত রাত্রে বাড়ি ফেরেন আপনারা, ঠিক কখন বুঝলেন ওঁর শরীরটা খারাপ করছে।
সোমা একটু একটু করে নিজের সুড়ঙ্গে সেঁধিয়ে যেতে যেতে একবার চোখ তুলে তাকালেন।
–আমার সবটা মনে নেই, প্লিজ, আমার সবটা মনে নেই।
ফিরে যাওয়ার সময়, সোমার চোখের দিকে আর তাকানোর সাহস হয়নি। ব্যক্তিগত দুঃখ কোনও কোনও মানুষের একমাত্র অলংকার। আবরণে আভরণ সাজে।