ইউনিভার্সিটি প্রসপেক্ট বা এভিনিউ। স্তালিন আমলের বিশাল মজবুত ইমারত। চকমিলান বাড়ি বলতে যা বোঝায়। অসংখ্য ফ্ল্যাট। অনেকগুলো প্রবেশপথ। শেষেরটা ১৩ নম্বর। তারই ন’তলাতে ননীদার ফ্ল্যাট। আমি যখন চত্বরের মাঝামাঝি পৌঁছেছি, দেখলাম ১৩ নম্বর এন্ট্রান্সের ভেতর থেকে এক ভদ্রলোক আর এক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে আসছেন। ভদ্রমহিলাকে দেখে রুশি মনে হল, কিন্তু ভদ্রলোক রুশি নন। ননীদাকে চিনতে পারলাম।
১৪.
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর কতকটা বামপন্থী আন্দোলনের প্রভাবে হোক, কতকটা রুশ সাহিত্যের প্রতি ঝোঁকের বশেই হোক, রুশভাষা শিক্ষার পাঠ গ্রহণ করতে শুরু করি। ইংরেজি অনুবাদে এবং স্থানীয় কিছু কিছু বাংলা অনুবাদে (তখনও বাংলা অনুবাদে কোনও রুশ ক্ল্যাসিক মস্কো থেকে প্রকাশিত হয়ে এদেশে আসেনি। সবে কিছু কিছু কিশোর ও শিশুসাহিত্যের আমদানি শুরু হয়েছে) রুশ সাহিত্য পড়তে পড়তে কেবলই মনে হত, রুশ ক্ল্যাসিকগুলো মূল ভাষায় পড়তে পারলে ভালো হত। আরও কিছুকাল পরে মনে হল ‘মূল রুশের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে বাংলা অনুবাদ’ নয়, রুশ থেকে সরাসরি বাংলা অনুবাদ করলে বোধহয় আরও ভালো হত।
এখানেই ননী ভৌমিকের সঙ্গে আমার আত্মার এক অদৃশ্য যোগসূত্র রচিত হল। আমার মনে হয়েছিল এই কাজটা আমাকেই করতে হবে। আমার ভাগ্য তাই আমার নিজেরই নির্ধারিত। মাঝখানে অবশ্য কিছু সুযোগ আর যোগাযোগের অপেক্ষা। তখন একমাত্র ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতিতেই রুশ ভাষা শেখানো হত। কৃতিত্বের সঙ্গেই ডিপ্লোমা শেষ করি। ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতি থেকে রুশ ভাষায় উৎকর্ষ সাধনের জন্য মস্কোর মৈত্রী সমিতি মারফত মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রুশ ভাষার শিক্ষকদের এক বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করার একটা স্কলারশিপের ব্যবস্থা ছিল বটে। মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এটাকে ফেলোশিপ বলা হত। শর্ত ছিল পাঠ্যক্রম শেষ করে দেশে ফিরে এসে ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতিতে বিনা পারিশ্রমিকে অন্তত এক বছরের জন্য রুশ ভাষার শিক্ষকতা করতে হবে। কিন্তু আমি তখনও রুশ ভাষার শিক্ষকই নই। আমাকে সমিতির কেউ রুশভাষার শিক্ষকতা করার সুযোগ দেননি। সুতরাং আমাকে নির্বাচন করার কোনও প্রশ্নই আসে না। এইভাবে আরও বছর পাঁচেক কেটে যায়। এই সময় ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতিতে আমার জনৈক শুভার্থী, সমিতির অন্যতম সম্পাদকের (কমিউনিস্ট পার্টির জনৈক খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী সাংসদের ছোটভাই) সহযোগিতায় কলকাতার সোভিয়েত দূতাবাসের সংস্কৃতি বিভাগের (‘গোর্কি সদন’ এরও এক দশ পরে প্রতিষ্ঠিত হয়) তৎকালীন পরিচালকের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সুযোগ ঘটে এবং সেই সুবাদে রুশ ভাষায় আমার দক্ষতার পরিচয় দিয়ে তাঁর সুপারিশক্রমে মস্কো থেকে স্কলারশিপটা আমি পেয়ে যাই। তবে বলাই বাহুল্য ফিরে এসে ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতিতে শিক্ষকতা করার শর্তটাও ছিল।
১৯৬৬ সাল। আমি থাকি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। সেখান থেকে কাছেই ননী ভৌমিকের বাড়ি। বাসে মাত্র গোটা কয়েক স্টপ। এই তো সুযোগ! আলাপ করাই যেতে পারে। বাঙালির সংখ্যা তখন মস্কোয় খুবই কম, হাতে গোনা যায়। যাঁরা আছেন, তাঁদের অধিকাংশই কর্মসূত্রে আছেন। বিদেশিদের কাজের জায়গাও সীমিত; হয় কোনও প্রকাশনালয়ে, নয়তো মস্কো রেডিও। ব্যতিক্রম একজন: তিনি ডাক্তার শান্তি রায়, স্থানীয় একটি হাসপাতালের ডাক্তার। আর বহুকাল হল এদেশে আছেন। প্রকাশনালয়ে আছেন ননী ভৌমিক আর বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়, মস্কো রেডিও-তে গোপেন চক্রবর্তী। এছাড়া আছে জনাকয়েক উচ্চশিক্ষার্থী, যাঁদের সঙ্গে ইতিমধ্যে আমার আলাপ-পরিচয়ও হয়েছে।
কিন্তু আমার আকর্ষণ ননী ভৌমিক। শুনেছি ওঁর বাড়িতে সকলের অবারিত দ্বার। তাই ঠিকানা জোগাড় করে একদিন বিকেলে একাই বেরিয়ে পড়লাম। তখন গ্রীষ্মকাল, বাড়ি খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধে হল না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বাঙালির সংখ্যা তখন মস্কোয় খুবই কম, হাতে গোনা যায়। যাঁরা আছেন, তাঁদের অধিকাংশই কর্মসূত্রে আছেন। বিদেশিদের কাজের জায়গাও সীমিত; হয় কোনও প্রকাশনালয়ে, নয়তো মস্কো রেডিও। ব্যতিক্রম একজন: তিনি ডাক্তার শান্তি রায়, স্থানীয় একটি হাসপাতালের ডাক্তার। আর বহুকাল হল এদেশে আছেন। প্রকাশনালয়ে আছেন ননী ভৌমিক আর বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়, মস্কো রেডিও-তে গোপেন চক্রবর্তী।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ইউনিভার্সিটি প্রসপেক্ট বা এভিনিউ। স্তালিন আমলের বিশাল মজবুত ইমারত। চকমিলান বাড়ি বলতে যা বোঝায়। অসংখ্য ফ্ল্যাট। অনেকগুলো প্রবেশপথ। শেষেরটা ১৩ নম্বর। তারই ন’তলাতে ননীদার ফ্ল্যাট। আমি যখন চত্বরের মাঝামাঝি পৌঁছেছি, দেখলাম ১৩ নম্বর এন্ট্রান্সের ভেতর থেকে এক ভদ্রলোক আর এক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে আসছেন। ভদ্রমহিলাকে দেখে রুশি মনে হল, কিন্তু ভদ্রলোক রুশি নন। ননীদাকে চিনতে পারলাম। গ্রীষ্মকাল, আস্ত্রাখান টুপি ও ভারী ওভারকোটের দৌরাত্ম্য তখন আর নেই, তাই বহুদিন আগে দেখা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা সেই একহারা বাঙালি লেখক মানুষটিকে ঠিক এই বেশে দেখতে অনভ্যস্ত হলেও চিনতে তেমন অসুবিধে হল না। মুখ অবশ্য আগের তুলনায় ভরাট। মস্কোয় তাঁকে বিদেশি বলে শনাক্ত করা যেতে পারে, কিন্তু ঠিক ভারতীয় বলে নয়।
ভদ্রমহিলা দস্তুরমতো সুন্দরী, তন্বী। মাথার চুল চুড়ো করে বেঁধে রাখা। বুঝলাম ননী ভৌমিকের স্ত্রী। ভদ্রমহিলা যে সুন্দরী তা অবশ্য আগেই শুনেছিলাম। কিন্তু ননী ভৌমিকের সঙ্গে তাঁর বয়সের ব্যবধান যে এতটা হতে পারে, সে ধারণা ছিল না। পরে জানতে পেরেছি ব্যবধান অন্তত বছর পনেরোর। শুনেছি গত পাঁচ বছর হল তাঁদের বিয়ে হয়েছে। কথায় কথায় এও জেনেছি জিপসি রক্তের মিশেল আছে তাঁর ধমনীতে। কথাটা সত্যি বলেই মনে হয়েছে– আদলে তো বটেই, পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সূত্রে তাঁর আচার-আচরণেও একাধিকবার পেয়েছি সেই পরিচয়।
দু’জনেই বুঝে নিলেন আমি তাঁদের কাছেই আসছি। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিলাম। বললাম সাক্ষাৎপ্রার্থী। মৃদু হেসে ননী ভৌমিক বললেন, ‘কিন্তু আজ যে বেরিয়ে যাচ্ছি, একটা নেমন্তন্ন আছে। ফোন করে আসবে তো।’ সত্যিই ভুল হয়ে গেছে। আসলে কলকাতায় তখনও আমাদের অধিকাংশ চেনা-পরিচিতের বাড়িতে কোনও ফোন নেই, তাই ফোন করার অভ্যাস নেই। অনভ্যাসবশত ফোন নম্বরটাও তাই নেওয়া হয়নি। এবারে চেয়ে নিলাম। রাস্তায় মিনিট পাঁচেক যতদূর আলাপ করা যায় তাই হল। আলাপ করিয়ে দিলেন ভদ্রমহিলার সঙ্গে– স্ত্রী সভে্ত্লানা– স্ভেতা, সঙ্গে সঙ্গে বাংলা করে বললেন ‘শ্বেতা’। ওই কয়েক মিনিটের মধ্যেই সভে্ত্লানা এত কথা বললেন যেন বহুদিনের পরিচিত। প্রথম আলাপেই ‘তুমি’ এবং এরই মধ্যে বার তিনেক অন্তত বললেন, ‘আরেকদিন এসো, আসবে কিন্তু। কবে আসবে বলো?’ ‘এর পরে তাহলে ফোন করে দিন ঠিক করে নেব’– বলে সেদিন বিদায় নিলাম।
দিন কয়েক বাদে কী একটা উৎসব উপলক্ষে মনে নেই, আমরা কয়েকজন ওঁদের নেমন্তন্ন করেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে। বেশি কথা বলেন না ননীদা। মাঝেমধ্যে দু’-একটা মন্তব্য করেন। সিগারেট দু’আঙুলের ফাঁকে রেখে হাতের মুঠো পাকিয়ে কল্কের মতো ধরে হুস হুস করে টানেন। অনর্গল সিগারেট টানেন। সভে্ত্লানারও ঘন ঘন সিগারেট ধরান, কিন্তু অনর্গল কথার তোড়ে অনেক সময়ই টানতে ভুলে যান। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলেন। ‘প্রগতি’ প্রকাশনেই কাজ করেন বাংলা বিভাগে, বুঝলাম সেই সূত্রে পরিচয় ননীদার সঙ্গে।
ননীদা আর সভে্ত্লানা দু’জনে মিলে প্রচুর রোজগার করতেন। সে রোজগারে সোভিয়েত ইউনিয়নে রাজার হালে থাকার কথা। কিন্তু তার সিংহভাগটাই ‘জলে’ চলে যাওয়ার ফলে বাড়ির পরিবেশে তার কোনও ছাপ দেখা যেত না। ঘরে সেই ছাপ ধরা ওয়ালপেপার, বাইরের ঘরের লেখার টেবিল-চেয়ার বা কাজের জায়গা, টিভি-সেট, কিছু বইয়ের তাক আর সোফা কাম বেড ছাড়া আর কোনও আসবাব ছিল না। দেশ থেকে আনা এক জোড়া বাঁকুড়ার ঘোড়া এক সময় ফ্লোরে শোভাবর্ধন করতে দেখেছি, কিন্তু সভে্ত্লানার বেপরোয়া নাচের আসরের দৌরাত্ম্যে অনেককাল হল সেগুলির পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে। রুশিদের বাড়িঘর সারাচর যেমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়, তারও কোনও পরিচয় সেখানে পাইনি। ভেতরে কামরায় খাট বা তক্তাপোশের কোনও বালাই নেই– স্রেফ একটা ভারি জাজিম পাতা। রান্নাঘরের হাঁড়িকুড়ি সব তেলচিটে, বাসনপত্র ভাঙাচোরা, ফাটা, রংচটা।
ছেলের প্রতি স্বাভাবিক টান ছিল। স্কুল শেষ করার জন্য দিমাকে যখন সাময়িকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হল (দু’বছরের জন্য, সুস্থ সবল ছেলেদের জন্য সোভিয়েত দেশে সেটা ছিল বাধ্যতামূলক) তখন ১৯৭৯ সাল, আফগান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সে যুদ্ধে সোভিয়েত দেশের অনেক তরতাজা যুবককে প্রাণ বলি দিতে হয়েছিল। সভে্ত্লানার সব সময় আশঙ্কা হত এই বুঝি তাঁর ছেলেকে আফগানিস্তান পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাই দেখেছি প্রায়ই ওপরওয়ালা সামরিক কর্তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য তাদের কাছে দামি দামি ভেট পাঠাতে। ছেলে অক্ষত অবস্থাতেই ফিরে এসেছিল। এসে প্রিন্টিং টেকনোলজি না কীসের একটা ট্রেনিং নিয়ে চাকরি-বাকরিও শুরু করেছিল। কিন্তু…
(চলবে)
…পড়ুন রুশকথার অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি