ব্রাজিল ফেরার পর এজেন্ট মারফত খবর পেলাম, মালয়েশিয়ার পেনাং ক্লাব একজন বিদেশি ফরোয়ার্ডের সন্ধানে আছে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। চলে গেলাম পেনাং-এ খেলতে। কিন্তু মন পড়েছিল কলকাতায়। মোহনবাগানে কী হচ্ছে– সব খবর পাচ্ছিলাম নিয়মিত। সংবাদমাধ্যমে কী লেখা হচ্ছে, তা পৌঁছে যেত আমার কাছে। সেখান থেকেই জেনেছিলাম, মোহনবাগানে ক্লাব-নির্বাচন আসন্ন। টুটু বোস-অঞ্জন মিত্ররা মোহনবাগান নির্বাচনে লড়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।
১৪.
মোহনবাগান ছাড়তে আমি চাইনি। কিন্তু পরিস্থিতি আমায় বাধ্য করেছিল মোহনবাগান ছাড়তে। এমনকী কলকাতাও। আসলে চেনা পরিবেশ ক্রমশ বদলে যাচ্ছিল চোখের সামনে। সেটার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। খোলামনে মোটেই খেলতে পারছিলাম না। পারফরম্যান্সেও তার প্রভাব পড়ছিল। ফলে একরাশ মন খারাপ নিয়ে কলকাতায় ফিরেছিলাম গোয়া থেকে। ফিরেও দেখলাম পরিস্থিতি বদলাল না। ক্লাবের তরফে আমায় ডাকা হল পেমেন্ট দেওয়ার জন্য। ভিতরে এক কথা। বাইরে সংবাদমাধ্যমের সামনে আরেক কথা। প্রকাশ্যে বলা হল, আমার সব পেমেন্ট নাকি মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে!
একজন পেশাদার ফুটবলার কেন খেলেন? খেলেন অর্থ উপার্জনের জন্য। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। ফুটবল অবশ্যই আমার প্যাশন, তবে সেটাই আমার উপার্জনের একমাত্র রাস্তা। কিন্তু মোহনবাগান আমার জীবনে আলাদা অর্থ বহন করে। মোহনবাগানে খেলার জন্য চুক্তির অর্থ আমার কাছে কোনও ইস্যু নয়। বরং সবুজ-মেরুন জার্সির আবেগ, সমর্থকদের ভালোবাসার গুরুত্ব কয়েক লক্ষ গুণ বেশি ওই অর্থের চেয়ে। ফলে যখন দেখলাম, আমার সঙ্গে পেমেন্টের লেনদেন থেকে সব ব্যাপারে অস্বচ্ছতা তৈরি করা হচ্ছে, সত্যিকে আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে, ঠিক করে নিলাম, মোহনবাগান ছাড়ব। আর সেটা মরশুমের মাঝপথেই!
মরশুমের মাঝপথে দল ছাড়তে চাই, এ-কথা শুনে অনেকে চমকে উঠেছিল। বিশেষ করে আমার শুভানুধ্যায়ী সমর্থকরা। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, মরশুমের মাঝপথে দল ছাড়লে নির্বাসিত হতে পারি। তাঁদের ভাবনা অমূলক ছিল না। কারণ, ক্লাবকর্তারা সমর্থকদের সেইসময়ই বুঝিয়েছিল। কর্তারা বলেছিলেন, আমাকে নাকি পুরো বেতন দেওয়া হচ্ছে, তারপরেও ক্লাব ছাড়ছি। আমি অবশ্য জানতাম, কোনও নির্বাসন হবে না। কারণ, আমার বেতনটাই যে আটকে রাখা হয়েছিল। এ নিয়ে এজেন্টের সঙ্গেও দীর্ঘ আলোচনা করেছিলাম। নিশ্চিত ছিলাম, ক্লাব ফিফায় গেলেও আমার কিছুই করতে পারবে না। আর তখন এটাও মনোস্থির করে ফেলেছিলাম, যাই হয়ে যাক, মোহনবাগান ছাড়বই।
শেষ চেষ্টা করেছিলেন ক্লাবকর্তারা। তখন মোহনবাগান কোচ ছিলেন অলোক মুখার্জি। ক্যাপ্টেন খুব সম্ভবত বাসুদেব মণ্ডল। ক্লাবের তরফে দু’জনেই আমার সঙ্গে আলোচনা করতে নীলাচলে এসেছিল। কিন্তু কারও সঙ্গেই সেদিন নতুন করে আর কিছু আলোচনা করিনি। কারণ, আমি জানতাম, অলোকের কিছু করার নেই, সব কিছুই ওর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলে শুধু শুধু আলোচনার মানেই হয় না। ওরা বাইরে থেকে নতুন বিদেশি ফুটবলার নিয়ে এল। আর আমি কলকাতা ছাড়ার পরিকল্পনা করতে লাগলাম চুপিসারে। কারণ, কলকাতা ছাড়ার খবর কোনওমতে বাইরে চলে গেলে শেষ মুহূর্তে হয়তো সমস্যায় পড়তে হতে পারে। তাই কলকাতা কবে ছাড়ব, সেই সিদ্ধান্ত অনেক ভাবনাচিন্তা করেই নিয়েছিলাম।
………………………………………………
মরশুমের মাঝপথে দল ছাড়তে চাই, এ-কথা শুনে অনেকে চমকে উঠেছিল। বিশেষ করে আমার শুভানুধ্যায়ী সমর্থকরা। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, মরশুমের মাঝপথে দল ছাড়লে নির্বাসিত হতে পারি। তাঁদের ভাবনা অমূলক ছিল না। কারণ, ক্লাবকর্তারা সমর্থকদের সেইসময়ই বুঝিয়েছিল। কর্তারা বলেছিলেন, আমাকে নাকি পুরো বেতন দেওয়া হচ্ছে, তারপরেও ক্লাব ছাড়ছি। আমি অবশ্য জানতাম, কোনও নির্বাসন হবে না। কারণ, আমার বেতনটাই যে আটকে রাখা হয়েছিল।
………………………………………………
দিনটা এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে। ক্লাবকর্তা বলরাম চৌধুরির ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল ক্যালকাটা ক্লাবে। সেই রাতে সবাই বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যস্ত। আর আমি মধ্যরাতে কলকাতা ছাড়ি, একদম নিঃশব্দে। শেষ মুহূর্তে পা ভাঙা নিয়ে দেখা করার জন্য ডগলাস এসেছিল আমার ফ্ল্যাটে। পুরো ব্যাপারটা ঘটেছিল ভীষণ গোপনীয়তার সঙ্গে। আসলে চাইছিলাম না ব্রাজিল উড়ে যাওয়ার আগে বিন্দুমাত্র সমস্যায় পড়ি। তাই মাঝরাতে সবার চোখ এড়িয়ে কলকাতা ছেড়েছিলাম।
কলকাতা ছাড়লেও অন্য কোথায় খেলব, সে-ব্যাপারে মনোস্থির করতে পারিনি তৎক্ষণাৎ। কোনও ক্লাবের সঙ্গেও আমার কথা হয়নি সে-সময়। মনেপ্রাণে চাইছিলাম, আগে এই সমস্যা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে। ব্রাজিল ফেরার পর এজেন্ট মারফত খবর পেলাম, মালয়েশিয়ার পেনাং ক্লাব একজন বিদেশি ফরোয়ার্ডের সন্ধানে আছে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। চলে গেলাম পেনাং-এ খেলতে। এখনও যদি কেউ মালয়েশিয়ায় পেনাং ক্লাবে আমার নাম করেন, জানতে পারবেন আমাকে ওরা কতটা ভালোবাসে। প্র্যাকটিসে আমার পারফরম্যান্স দেখে পেনাং ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাদের পরম্পরা বদলে ফেলল। ক্লাবের প্রথা ভেঙে প্রথম বছরেই কোনও বিদেশি ফুটবলারকে দলের অধিনায়ক করে দিয়েছিল। সেই ক্যাপ্টেন আর্মব্যান্ড উঠেছিল আমার হাত।
খেলা ছেড়েছি অনেক বছর হল। এখনও ওরা আমাকে ‘ক্যাপিটান’ বলে ডাকে। তবে যাই হোক, মালয়েশিয়ায় খেলছিলাম বটে, কিন্তু মন পড়েছিল কলকাতায়। মোহনবাগানে কী হচ্ছে– সব খবর পাচ্ছিলাম নিয়মিত। সংবাদমাধ্যমে কী লেখা হচ্ছে, তা পৌঁছে যেত আমার কাছে। সেখান থেকেই জেনেছিলাম, মোহনবাগানে ক্লাব-নির্বাচন আসন্ন। টুটু বোস-অঞ্জন মিত্ররা মোহনবাগান নির্বাচনে লড়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। দেখলাম, সবুজ-মেরুন জনতা ধরেই নিয়েছে টুটু বোসরা ক্লাবে ক্ষমতায় এলে, আমি আবার মোহনবাগানে ফিরে আসব।
নতুন করে আবার ভাবতে শুরু করলাম। বুঝতেই পারছিলাম, মোহনবাগান জনতা আমার ফেরার প্রহর দিন গুনছে। যা খবর পাচ্ছিলাম, তাতে নিশ্চিত ছিলাম, টুম্পাই-দেবাশিসরা ক্লাবে ক্ষমতায় আসবে। এবং এটাও জানতে পেরেছিলাম, নির্বাচনে আমিও একটা ইস্যু হতে যাচ্ছি। মানে, টুটু বোসরা ক্ষমতায় এলেই আমি মোহনবাগানে ফিরব।
ঠিক এই সময় মাহিন্দ্রা ইউনাইটেডে নেওয়ার জন্য হেনরি মেঞ্জেস নিয়মিত আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল। প্রতিদিনই চাপ দিচ্ছিল সই করতে। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা স্থির সিদ্ধান্ত নিতে আমিও বদ্ধপরিকর ছিলাম। তলিয়ে ভাবলাম পুরো পরিস্থিতি নিয়ে। টুটুদা-অঞ্জনরা ক্ষমতায় এল আর আমি ক্লাবে ফিরে এলাম– এরকমটা হলে সমর্থকরা ভাবতেই পারে, আমার ক্লাব ছাড়ার পিছনে বোধহয় এদের হাত ছিল। অথচ আমি ক্লাব ছেড়েছিলাম, সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায়। ফলে নির্বাচন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এলে সম্পূর্ণ অন্যরকম বার্তা যেত সমর্থকদের কাছে। এদিকে, হেনরির কথায় তখন যদি মাহিন্দ্রায় সই করে দিতাম, তাহলে টুটুদাদের নির্বাচনে সমস্যা হতে পারত। কারণ, মোহনবাগান সমর্থকরা ধরেই নিয়েছিল, ক্ষমতায় এসেই আমাকে ফিরিয়ে আনবেন টুটুদা। সব পরিস্থিতি চিন্তা করে হেনরিকে জানিয়ে দিই, মাহিন্দ্রাতেই খেলব আমি। তবে সইয়ের দিনক্ষণের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমিই নেব। ওরা রাজিও হয়ে গিয়েছিল।
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….
অবশেষে এল সেই মোহনবাগান নির্বাচনের দিন। যেদিন নির্বাচন, তার আগের দিন মুম্বই এসে মাহিন্দ্রার চুক্তিপত্রে সই করে মধ্যরাতেই ফিরে গেলাম ব্রাজিল। আর পরের দিন মোহনবাগান নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এলেন টুটু বোস-অঞ্জন মিত্ররা।
অনুলিখন: দুলাল দে
…তোতাকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৩। একরাশ মনখারাপ নিয়ে কলকাতা ছেড়েছিলাম
পর্ব ১২। ‘মোহনবাগান দিবস’ একজন ভারতীয় ফুটবলারের কাছে যতটা আবেগের, আমার কাছেও তাই
পর্ব ১১। ডার্বির আগের দিন ইস্টবেঙ্গল টিম হোটেলে আড্ডায় বসে গেলাম বাইচুংয়ের সঙ্গে
পর্ব ১০। ইংরেজি শেখাতে বাড়িতে আসতেন এক মোহনবাগান সমর্থক
পর্ব ৯। বারপুজোয় সমর্থকদের ভালোবাসার হাত থেকে বাঁচতে দৌড় লাগিয়েছিলাম টেন্টের দিকে
পর্ব ৮। মাঠে তো বটেই, ইয়াকুবু বাথরুমে গেলেও ফলো করবে স্যালিউ
পর্ব ৭। আর একটুর জন্য হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল জাতীয় লিগ জয়
পর্ব ৬। জাতীয় লিগের প্রথম ম্যাচেই বেঞ্চে বসে রইলাম
পর্ব ৫। আশিয়ানের আগে সুভাষ ভৌমিক প্রায়ই ফোন করত আমাকে, বোঝাত ইস্টবেঙ্গলে সই করার জন্য
পর্ব ৪। আর একটু হলেই সই করে ফেলছিলাম ইস্টবেঙ্গলে!
পর্ব ৩। মোহনবাগানের ট্রায়ালে সুব্রত আমায় রাখত দ্বিতীয় দলে
পর্ব ২। কলকাতায় গিয়েই খেলব ভেবেছিলাম, মোহনবাগানে ট্রায়াল দিতে হবে ভাবিনি
পর্ব ১। ম্যাচের আগে নাইটপার্টি করায় আমাকে আর ডগলাসকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ক্লাব