একদিন শুটিংয়ে বেশ হইহই। তার কারণ আমাদের সেদিনের অতিথি, সিইও বুদ্ধদেব গুহ। রতিকান্ত বসুর বন্ধু, দাপুটে এই আইপিএস বেশ কড়া ধাঁচের লোক ছিলেন। গোটা অফিস তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকত। ফলে ইন্টারভিউ করা খুব সহজ কাজ ছিল না। উনি নিজেই তারার কর্মপদ্ধতি, প্ল্যান এই সব নিয়ে বলে যাচ্ছিলেন। এপিসোডের শেষদিকে একটা কাণ্ড ঘটাল চন্দ্রিল। ফস করে বলে কী, এই যে ‘তারা’ চ্যানেল, যাকে নিয়ে বাংলা সংস্কৃতি জগতে এত হইচই, শুনছি সে তারা না কি উঠে যাবে? গুলি খাওয়া ভাল্লুকের মতো আহত নয়ন নিয়ে বুদ্ধদেব গুহ চেয়ে রইলেন খানিকক্ষণ।
১৫.
তারাবাজির ছায়াপথে দিন কাটছিল দিব্যি। শুটিং, এডিটিং, পার্ক স্ট্রিট, রাতজাগা পাগলামি– মনে হচ্ছিল, এই তো যৌবন, কলকাতা শাসন করছি আমরা ক’জন। চাপা আতঙ্ক ছড়াল অফিসের দু’-একজন। ঠিক মনে নেই কবে থেকে, কিন্তু কথাটা চাউর হয়ে গেল দ্রুত গতিতে– তারা না কি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। উঠে যাবে চ্যানেল? এ আবার হয় না কি! এত উদ্যোগ, এত আয়োজন, এমন আড়ম্বরের সভা ভেঙে যাবে শেষমেশ? গোটা অফিস জুড়ে ফিসফাস শুরু হল। অফিসের বড়কর্তাদের মিটিংয়ের বহর গেল বেড়ে। এমনকী, ঋতুদা যে ঋতুদা, সে-ও অফিসে আসতে লাগল ঘনঘন। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভীত হাম্বা দেয়। জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে। ‘যুগান্তর’ অফিসে এক দুপুরে গিয়ে দেখি লকআউটের নোটিশ ঝুলছে। কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো আতঙ্ক আর কিছুতে নেই। ‘যুগান্তর’-এর পর এবার ‘তারা’? আলো ঝলমলে সন্ধেগুলোয় কাচের গুঁড়ো লেগে গেল কেমন। ঋতুদাকে ফোন করলাম। কী ব্যাপার বলো তো? কীসব শুনছি বাজারে? ঋতুদা আশ্বাস দিল, ‘মন দিয়ে কাজ কর। এসব বাইরের লোকেদের বানানো কথা।’ বেশ, তবে তাই। ঋতুদার কথাকে অগ্রাহ্য করব কী করে?
পড়ুন ঋইউনিয়ন-এর আগের পর্ব: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
একদিকে চলছে ‘তারাদের কথা’, ‘অচেনা উত্তম’-এর শুটিং, অন্যদিকে চন্দ্রিল শুরু করল ‘আইকন বাইকন’। ভক্স পপ কেন্দ্রিক এই অনুষ্ঠানটা মাইলস্টোন। ফর্মের দিক থেকে, কনটেন্টের দিক থেকেও রেবেল এক প্রোগ্রাম। ভক্স পপ-এর সঙ্গে চন্দ্রিল কায়দা করে কিছু স্কিট ঢুকিয়ে দিত। রবীন্দ্রনাথ এপিসোডটা শুরুই হয়েছিল, ‘‘রবীন্দ্রনাথ এক পা’য়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে’’ বলে। যে ছেলেটি অ্যাঙ্কার ছিল, তার গলাটি ছিল সরু ও মিহি, চন্দ্রিলের লেখা স্ক্রিপ্ট চিৎকার করে বলত সে। বাংলা টেলিভিশনে এইরকম অ্যাঙ্কারিং-ও তার আগে হয়নি কখনও। ‘তারা’ আসলে যে ধরনের নন ফিকশনের ধারা চালু করতে চাইছিল, ‘আইকন বাইকন’-এর ধরনটা ছিল একেবারে সেই ধারা ধারা বিশুদ্ধ ধারার। এমন বেয়াড়া প্রোগ্রামের টাইটেল সং করার দায়িত্ব পড়ল আমার ঘাড়ে। আমি একটা গান বেঁধেছিলাম অ্যাফ্রো স্টাইলে। চন্দ্রিলকে বললাম, যদি সত্যি একজন আফ্রিকানকে দিয়ে গাওয়াই। আইডিয়াতে সবাই খুব উত্তেজিত, কিন্তু তেমন গায়ক মিলবে কোথায়? একটা অ্যাফ্রো, হেঁড়ে, ভারী গলা খুঁজছিলাম হন্যে হয়ে। চন্দ্রবিন্দু-র সেই সময়ের সদস্য চন্দন একটা দারুণ তথ্য জানাল। কলকাতায় যত বিদেশি ফুটবলার খেলতে আসে, তারা সবাই সল্টলেকের ভাড়াবাড়িতে থাকে। ও খোঁজ নিয়ে জেনেছে, চিবুজার-এর স্ত্রী হলেন আফ্রিকান ইবোমিউজিকের দক্ষ এক গায়িকা। বলিস কি! গান শোনা যায় ওঁর? চন্দন মাথা নাড়ল। কোন ব্লক ভুলে গিয়েছি, কিন্তু একটা বাড়ির একতলার ফ্ল্যাটে থাকতেন চিবুজার। চন্দন নাকি ওকে চেনে। কথামতো নির্দিষ্ট সময়ে হাজির হয়ে দেখি, চিবুজারের বউ বসে বসে কুটনো কুটছে, প্রেসার কুকার চাপানো স্টোভে। বাংলার ফুটবলের উন্নতিকল্পে চিবুজারের বউয়ের এমন আত্মত্যাগ দেখে মরমে মরে গেলাম। রান্না চাপিয়ে তিনি আমার সঙ্গে বসলেন গানের সিটিং-এ। ‘আইকন মানে আজগুবি লোক, বাইকন মানে হাসাহাসি হোক’– এই বিদঘুটে গান তোলানো হল। কিন্তু তিনি গানটি ধরতেই আমার মাথায় বাজ। এ তো মিঠে আরতি মুখুজ্যের মতো কণ্ঠ! কোথায় ভেবেছিলাম মিরিয়াম মাকেবা পাব, তা নয়, অ্যাফ্রোকোমল গান্ধর্বী! ভাষা বোঝাবুঝির সমস্যা থাকলেও, আমার মুখের ভাষা উনি পড়তে পেরেছিলেন সহজেই, হাবেভাবে বোঝালেন, উনি হলেন ইবো টেনর।
কী হবে এবার? উপলের বাড়ি ফিরে কপালে হাত দিয়ে বসলাম। অবস্থা বুঝে উপলই ব্যবস্থা নিল। একটা সস্তার মিউজিক কার্ড আছে আমার কাছে, ওখানে একটা টুল আছে, দেখবি? কেমন? উপল ডিসপ্লে দিল। আমি একটা লাইন বললাম, সেটাকে ব্যারিটোন দিয়ে শোনাল সফটওয়্যার। গলাটা এমন করে দিচ্ছে, ছেলে না মেয়ে ভাল বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু মজা রয়েছে ষোলোয়ানা। ফাইনালি গানটা উপলই গায়। যদিও বলে না দিলে বোঝা অসাধ্যই ছিল সেটা। চন্দ্রিল গানের সঙ্গে যে ভিডিওটা বানিয়েছিল, সেখানে অনেক ছেলে-মেয়ে একই মুখোশ পরে হেঁটেছিল।
পড়ুন ঋইউনিয়ন-এর অন্য পর্ব: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
এসব প্রোগ্রাম যখন জোরকদমে চলছে, তখন ‘তারা করছেটা কী’-ও কিন্তু চলছে পাশাপাশি। তবে তার ঝাঁজ একটু স্তিমিত। প্রায় এপিসোডেই এখন গেস্ট আসেন। আমরা ইচ্ছেমতো, পরোয়াহীন বকবক করতে পারি না আর। ঋতুদাকে এই নিয়ে বলেছি বেশ কয়েকবার, ঋতুদা এড়িয়ে গিয়েছে। একদিন শুটিংয়ে বেশ হইহই। তার কারণ আমাদের সেদিনের অতিথি, সিইও বুদ্ধদেব গুহ। রতিকান্ত বসুর বন্ধু, দাপুটে এই আইপিএস বেশ কড়া ধাঁচের লোক ছিলেন। গোটা অফিস তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকত। ফলে ইন্টারভিউ করা খুব সহজ কাজ ছিল না। উনি নিজেই তারার কর্মপদ্ধতি, প্ল্যান এই সব নিয়ে বলে যাচ্ছিলেন। এপিসোডের শেষদিকে একটা কাণ্ড ঘটাল চন্দ্রিল। ফস করে বলে কী, এই যে ‘তারা’ চ্যানেল, যাকে নিয়ে বাংলা সংস্কৃতি জগতে এত হইচই, শুনছি সে তারা না কি উঠে যাবে? গুলি খাওয়া ভাল্লুকের মতো আহত নয়ন নিয়ে বুদ্ধদেব গুহ চেয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর মুখে একটু হাসি টেনে বললেন, হ্যাঁ, উঠে গেলে আকাশে চলে যাবে। তারা তো, আকাশেই তো মানায় তাকে। তারা থেকে যায়, হারিয়ে যায় না।
(চলবে)
জেমস প্রিন্সেপ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর এক মানুষ। স্থাপত্যবিদ্যা, আবহাওয়াবিদ্যা, চিত্রাঙ্কন, ধাতুবিদ্যা, মুদ্রাতত্ত্বের পাশাপাশি ভাষা ও হরফবিদ্যাতেও তাঁর বিপুল জ্ঞান ছিল। কলকাতার প্রিন্সেপ ঘাট তাঁর নামানুসারেই। আজ জেমস প্রিন্সেপের ২২৫তম জন্মদিন।