শহরের নাগরিক সমাজে উচ্চ-মধ্যবিত্ত মহিলাদের আনাগোনা সম্ভব ছিল না সেই সময়। বাড়ির অন্দরেই তাঁরা বসিয়ে নিতেন তাঁদের আলাপ-আলোচনার বৈঠক, গান-গল্পের আসর। গোটা শহরের নিরিখে ভাবলে এই ছোট ছোট পরিসরের গল্পগুলি আমাদের সামনে নগর-জীবনের ইতিহাসের এক অন্য আঙ্গিক তুলে ধরে। যেখানে বড় বড় ঘটনা নয়, নিত্যদিনের অভ্যেসের মধ্যে দিয়ে আমরা অতীতের নাগরিক দিনযাপনের হদিশ পাই।
১৬.
অনেকের কাছেই আধুনিক শহর বাড়ির চৌহদ্দির মধ্য থেকেই ধরা দেয়। বার্ধক্য বা শারীরিক কারণে চট করে বাইরে বেরনোর উপায় নেই হয়তো। কিংবা শহরের হই-হট্টগোল, ধুলো-ময়লা, গরম-বৃষ্টি, জল-কাদা পছন্দ নয় বলে বেরতে পছন্দ করেন না অনেকে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে ব্যাপারটা নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপর নির্ভর করে না। সমাজ, পরিবার, ধর্মীয় নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে দেয় ‘বাইরে’ বেরনো। উনিশ শতকের কলকাতা নিয়ে বিভিন্ন স্মৃতিচারণে আমরা দেখতে পাই– কীভাবে বাড়ির অন্দরমহলই জগৎ ছিল মহিলাদের। বড় বাড়ির ক্ষেত্রে বাচ্চারাও বাড়ির মধ্যেই থাকত, ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা ছিল না তাদের। ‘ঘর’ ও ‘বাহির’-এর চিরকালীন দ্বন্দ্বের নিরিখে নগর ইতিহাস বুঝতে চাইলে আমরা নতুন এক দৃষ্টিকোণ থেকে শহরকে আবিষ্কার করি। চলমান, অতি ব্যস্ত জীবনকে বদ্ধ পরিসরে থিতু, ঈষৎ স্থাণু অবস্থায়, খানিক দূর থেকে লক্ষ্য করা, তার মধ্য দিয়ে আপাত-দৃশ্যমান নাগরিক আবহাওয়া ছাড়িয়ে অন্য এক জগতের কল্পনা করা– এইসবের মধ্যে দিয়ে শহর ও শহরে বাস করার অভিজ্ঞতার এক অন্য ধরনের ছবি ফুটে ওঠে। পাকা বাড়ির বারান্দা, জানালা, ছাদ– এই পরিসরগুলি শহরবাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। বাড়ির বাইরের রোয়াক যেমন এক পুরুষালি নাগরিক অভিজ্ঞতা কলকাতায় নিয়ে এসেছিল, বাড়ির ছাদ তেমনই ছিল মহিলা মহলের আপন জগৎ।
………………………………………………………………………………………………….
রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে আমরা উনিশ শতকের কলকাতার আটপৌরে জীবনের চমৎকার সব ছবি পাই। জোড়াসাঁকোর বিশাল বাড়ির চার দেয়ালের মধ্য থেকে দেখা সেই কলকাতা, নগর আর গ্রাম জীবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা এক মুহূর্ত। বাড়ির অন্দরের নকশা ফুটে ওঠে বিশদে তাঁর জীবন কথায়। ঘরবন্দি শৈশবে মুক্তির স্থান ছিল বাড়ির ছাদ।
………………………………………………………………………………………………….
রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে আমরা উনিশ শতকের কলকাতার আটপৌরে জীবনের চমৎকার সব ছবি পাই। জোড়াসাঁকোর বিশাল বাড়ির চার দেয়ালের মধ্য থেকে দেখা সেই কলকাতা, নগর আর গ্রাম জীবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা এক মুহূর্ত। বাড়ির অন্দরের নকশা ফুটে ওঠে বিশদে তাঁর জীবন কথায়। ঘরবন্দি শৈশবে মুক্তির স্থান ছিল বাড়ির ছাদ। ‘ছেলেবেলা’য় বলছেন, ‘তখনকার কালের সঙ্গে এখনকার কালের তফাত ঘটেছে এ কথা স্পষ্ট বুঝতে পারি, যখন দেখতে পাই আজকাল বাড়ির ছাদে না আছে মানুষের আনাগোনা, না আছে ভূতপ্রেতের।’ আর ‘জীবন-স্মৃতি’র গোড়ায় লিখছেন,
“আমাদের বাড়ির ভিতরের ছাদের প্রাচীর আমার মাথা ছাড়াইয়া উঠিত। …এক-একদিন মধ্যহ্নে সেই ছাদে আসিয়া উপস্থিত হইতাম। তখন বাড়িতে সকলের আহার শেষ হইয়া গিয়াছে; গৃহকর্ম্মে ছেদ পড়িয়াছে; অন্তঃপুর বিশ্রামে নিমগ্ন; স্নানসিক্ত শাড়িগুলি ছাতের কার্ণিসের উপর হইতে ঝুলিতেছে; উঠানের কোণে যে উচ্ছিষ্ট ভাত পড়িয়াছে তাহারই উপর কাকের দলের সভা বসিয়া গেছে। সেই নির্জ্জন অবকাশে প্রাচীরের রন্ধের ভিতর হইতে এই খাঁচার পাখীর সঙ্গে ঐ বনের পাখীর চঞ্চুতে চঞ্চুতে পরিচয় চলিত! দাঁড়াইয়া চাহিয়া থাকিতাম– চোখে পড়িত আমাদের বাড়ির ভিতরের বাগান-প্রান্তের নারিকেল-শ্রেণী; তাহারই ফাঁক দিয়া দেখা যাইত সিঙ্গিরবাগান-পল্লীর একটা পুকুর, এবং সেই পুকুরের ধারে, যে তারা গয়লানী আমাদের দুধ দিত তাহারই, গোয়ালঘর; আরো দূরে দেখা যাইত তরুচূড়ার সঙ্গে মিশিয়া কলিকাতা সহরের নানা আকারের ও নানা আয়তনের উচ্চনীচ ছাদের শ্রেণী মধ্যাহ্নরৌদ্রে প্রখর শুভ্রতা বিচ্ছুরিত করিয়া পূর্ববদিগন্তের পাণ্ডুবর্ণ নীলিমার মধ্যে উধাও হইয়া চলিয়া গিয়াছে। সেই সকল অতি দূর বাড়ির ছাদে এক একটা চিলে কোঠা উঁচু হইয়া থাকিত; মনে হইত তাহারা যেন নিশ্চল তর্জ্জনী তুলিয়া ঢোখ টিপিয়া আপনার ভিতরকার রহস্য আমার কাছে সঙ্কেতে বলিবার চেস্টা করিতেছে। …মাথার উপরে আকাশব্যাপী খরদীপ্তি, তাহারই দূরতম প্রান্ত হইতে চিলের সূক্ষ্ম তীক্ষ্ণ ডাক আমার কানে আসিয়া পৌঁছিত এবং সিঙ্গিরবাগানের পাশের গলিতে দিবাসুপ্ত নিস্তব্ধ বাড়িগুলার সম্মুখ দিয়া পসারী সুর করিয়া “চাই, চুড়ী চাই, খেলোনা চাই” হাঁকিয়া যাইত– তাহাতে আমার সমস্ত মনটা উদাস করিয়া দিত।”
এক শান্ত নাগরিক দুপুরের ছবি– অলস ছাদে শাড়ি শুকোচ্ছে, ছড়ানো-ছেটানো ভাতের উপর কাক, বাড়ির বাইরে গাছ, পুকুর, আর দূরে অন্য বাড়ির ছাদ, মাথা, চিলেকোঠা। শহর পুরোপুরি বাড়িময় হয়ে ওঠেনি, ছেঁড়া ছেঁড়া প্রাকৃতিক সম্পদ রাস্তা-বাড়ির মাঝে উঁকি দেয়। উনিশ শতকের শেষভাগ আর বিশ শতকের শুরুর দশকগুলিতে কলকাতার এই ছবি অনেক লেখাতেই পাওয়া যায়। একইসঙ্গে, শুধু রাস্তাঘাটে চলেফিরে বেড়ানো নয়, বাড়ির ভেতর থেকে শহরের জীবন নজর করার বেশ কিছু নজিরও পাওয়া যায়। এই টুকরো টুকরো ছবি, যেখানে শহরটা ছাদের উপর থেকে বা দোতলা-তেতলার বারান্দা থেকে দেখা হয়েছে, রাস্তার যানযটের থেকে অনেকটা সরে গিয়ে, আমাদের সামনে কলকাতার নাগরিক ইতিহাসের এক অন্য রূপ নিয়ে আসে।
গত শতকের বিশ-তিরিশের দশকের কলকাতা নিয়ে নীরদ চৌধুরীর লেখায় ছাদ-বারান্দা থেকে শহর-পাড়া-পাশের বাড়ির দৈনন্দিন জীবনের আভাস পাওয়া যায়:
“আমি তিনতলার ঘরে দিনের বেলা থাকিতাম। সামনে হ্যারিসন রোডের অপর পারে একটা খুব বড় দোতলা বাড়ি ছিল।… আমি আমাদের বাড়ির তিনতলার বারান্দায় দাঁড়াইয়া রাস্তায় কি হইতেছে দেখিবার সময়ে সেই বাড়ির সম্মুখের দিকে দোতলার একটা ঘরে দুইটি তরুণীকে পড়িতে দেখিতাম। বয়স ষোল-সতেরো মনে হইত। তাহারা সকালে ছাতে শাড়ি শুকাইতে দিতে উঠিত, বিকালে তুলিয়া লইতে আসিত। কখনও বা দোতলার বারান্দায় দাঁড়াইয়া বড় বড় চোখ দিয়া রাস্তার দৃশ্য দেখিত।” অন্যদিকে, ‘অপুর সংসার’-এ চিলেকোঠার জানালার ছেঁড়া পর্দা দিয়ে পাশের বাড়ির উৎসুক চোখ অপুকে খানিক বিরক্তই করত বোধহয়! আবার ‘চারুলতা’য় দূরবিন দিয়ে খড়খড়ি ফাঁক করে শহরের নাগাল পায় ঘর-বন্দি চারু।
ছাদেই ছিল মহিলাদের খানিক মুক্তি, সেখানেই ছিল তাঁদের বৈঠকখানা। রোদ্দুরে বড়ি, আমসত্ত্ব, জামা শুকোনো থেকে শুরু করে বিকেলের পর গল্প-গুজব, হাসি তামাশা। রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর ছাদে তাঁর মায়ের বৈকালিক আসরের কথা পাই আমরা। তাঁর নিজের যৌবনেও ছাদ ছিল বিশেষ আনন্দের স্থান। নাগরিক জীবনের মাঝে উন্মুক্ত আকাশ বিশেষ আকর্ষণের জায়গা ছিল তাঁর আজীবন। আবারও রবীন্দ্রনাথের বর্ণনা ধার করতে হয়। এবার জ্যোতিদাদা আর নতুন বউয়ের আসরের কথা। নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া কাদম্বরীর আপন জগৎ:
“দিনের শেষে ছাদের উপর পড়ত মাদুর আর তাকিয়া। একটা রুপোর রেকাবিতে বেলফুলের গোড়েমালা ভিজে রুমালে, পিরিচে এক-প্লাস বরফ-দেওয়া জল, আর বাটাতে ছাচিপান।…বউঠাকরুন গা ধুয়ে, চুল বেঁধে, তৈরি হয়ে বসতেন। গায়ে একখানা পাতলা চাদর উড়িয়ে আসতেন জ্যোতিদাদা; বেহালাতে লাগাতেন ছড়ি, আমি ধরতুম চড়া সুরের গান। গলায় যেটুকু সুর দিয়েছিলেন বিধাতা তখনো তা ফিরিয়ে নেন নি। সূর্য-ডোবা আকাশে ছাদে ছাদে ছড়িয়ে যেত আমার গান। হু হু ক’রে দক্ষিণে বাতাস উঠত দূর সমুদ্র থেকে, তারায় তারায় যেত আকাশ ভ’রে …ছাদটাকে বউঠাকরুন একেবারে বাগান বানিয়ে তুলেছিলেন। পিলের উপরে সারি সারি লম্বা পাম গাছ; আশেপাশে চামেলি, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, করবী, দোলনচাঁপা। ছাদ-জখমের কথা মনেই আনেন নি…”
শহরের নাগরিক সমাজে উচ্চ-মধ্যবিত্ত মহিলাদের আনাগোনা সম্ভব ছিল না সেই সময়। বাড়ির অন্দরেই তাঁরা বসিয়ে নিতেন তাঁদের আলাপ-আলোচনার বৈঠক, গান-গল্পের আসর। গোটা শহরের নিরিখে ভাবলে এই ছোট ছোট পরিসরের গল্পগুলি আমাদের সামনে নগর-জীবনের ইতিহাসের এক অন্য আঙ্গিক তুলে ধরে। যেখানে বড় বড় ঘটনা নয়, নিত্যদিনের অভ্যেসের মধ্যে দিয়ে আমরা অতীতের নাগরিক দিনযাপনের হদিশ পাই।
ঋণস্বীকার: স্বাতী চট্টোপাধ্যায়, স্মল স্পেসেস: রিকাস্টিং দি আর্কিটেকচার অফ এম্পায়ার (২০২৩)
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৫: গৃহভৃত্যর বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, দু’দশকে বদলে যায় পরিস্থিতি
পর্ব ১৪: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সিনেমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য সেই সময়ের আয়না
পর্ব ১৩: দাঙ্গা ও দেশভাগ বদলে দিয়েছে কলকাতার পাড়া-বেপাড়ার ধারণা
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট