রুলি একাধিকবার যাদবজির বেকারির সব পাঁউরুটি ‘এগুলি বাসি, আর বিক্রি হবে না’ বলে খেয়ে ফেলেছিল। ওর হাত থেকে কেউ কোনও দিন কিছু ছিনিয়ে নিতে পারেনি– তবে সেভাবে কেউ চেষ্টা করেছিল বলেও শোনা যায় না।
২৩.
নবাদা একা হেঁটে বেড়াত। বর্ষায় নদী-নালা উপচে উঠলে ব্রিজের খুঁটিতে হেলান দিয়ে নীল পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি ওকে হামেশাই। অথবা হেমন্তের মাঠঘাট পেড়িয়ে একেবারে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াত শুকনা, খাপরাইল পেরিয়ে পাংখাবাড়ির দিকে। সে জায়গাগুলোর নির্জনতা হেঁটে বেড়ানোর মতোই, সে বিষয়ে সংশয় নেই। তবে ছেলেবেলায় যারা ওরকম করত, তাদের ওয়ার্ড্রোব ঘাঁটলে দু’-এক পিস গুরুপাঞ্জাবি, আর গালে রাজেশ খান্নার গান গাইবার অপরাধে জেঠামশাই টাইপের কারও-র চড় থাপ্পরের দাগও থাকত। নবাদার সেসব ল্যাঠা ছিল না। ওর দিকে নেপালি, মদেশিয়া, বাহে, বাঙালি সব বিবাহযোগ্যারাই আড়চোখে চেয়ে ‘মেশডো করিয়া’ মুচকি হেসেছে, সে খবর আমরা পেয়েছি– জুগিয়েছিল ভটচাজ কাকু, বরিশালের বামুনটি ওই অ্যাকসেন্টই সারাজীবন চালিয়ে গেল। নবাদা কাউকে পাত্তা দেয়নি– সংবাদও চাপা ছিল না। ফলে কিছুকালের মধ্যে ওর নামের আগে-পিছে ‘উদাস বাউল’, ‘আপনভোলা’, ‘জীবন জয়ের অনামা সৈনিক’ ইত্যাদি বিশেষণ চেপে বসল। শেষেরটা হালদারবাবুর আন্তন মাকারেঙ্কো পড়ে উজ্জীবিত বোধ করার এফেক্টে, এবং তাসের আড্ডায় ‘এরাই একদিন বিপ্লব করবে’ বলে মানিকদার সঙ্গে অনর্থক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। মানিকদা বেশ কিছুদিন যাবৎ অবিবাহিত বোনটিকে নবাদার গলায় ঝোলাবার প্ল্যান আঁটছিল। গল্পটা সবিস্তারে বলা দরকার।
এয়ারম্যানদের বিলেটের পিছনে বড় মাঠের লাগোয়া কাঁটা ঝোপওলা পরিত্যক্ত জমিতে একখানা পিচ সমান করার রোলার খুব সম্ভবত ইংরেজদের আমল থেকেই প্রায় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়েছিল। প্রায় বছরে একবার এই উইং বনাম সেই স্কোয়াড্রনে (বাংলা উচ্চারণটাই লিখলাম) প্রীতি ম্যাচ হলে সেটিকে টেনেটুনে মাঠে এনে ভয়ানক গোলমাল চলত হপ্তাখানেক। অফিসাররা হাফ প্যান্ট পরে দৌড়াদৌড়ি সেরে হাঁফিয়ে উঠে বিলেটের নির্দিষ্ট কোনও ঘরে, বা একেবারেই মুক্ত পরিবেশে বড় কাঁঠাল গাছের ছায়ায় টেবিল-চেয়ার পেতে বিয়ার পান করতে করতে একদিনের মধ্যে সাদা জামা প্যান্টের বন্দোবস্তের বিষয়ে গভীর আলোচনায় ডুব দিত। গোটা পরিবেশটাই ইংরেজ প্রভুদের ফেলে যাওয়া সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা মোতাবেক সেজে উঠত বলে কেউ কখনও ট্যাঁ-ফোঁ করার সুযোগ পায়নি। অফিসাররা সাধারণ এয়ারম্যানদের সঙ্গে চাকরবাকরদের মতো ব্যবহার করত, তাদের বউরাও কোলের খোকাদের দোল দেওয়ানো অবধি সবটাই বাপের জমিদারি ভেবে করিয়ে নিত। সে যাক। খেলা চুকলে এয়ারম্যানরা দল বেঁধে রোলারটাকে ফের একবার ওই পরিত্যক্ত জমিতে ঠেলে তুলে দিয়ে যেত।
শোনা যায়, মানিকদার বোন শিশুকালে ওই রোলারটা নিয়ে খেলা করত। আমরা কখনও দেখিনি, তবে শুনেছি। সেই থেকেই নানা অপভ্রংশ পেরিয়ে শেষমেশ ওর নাম রুলি-তে এসে ঠেকেছিল কি না বলতে পারব না। রুলিকে আমি নিজের চোখে মোটা লোহার চাটু মাজবার কালে বেঁকিয়ে ফেলতে, এবং তারপর লজ্জা পেয়ে ‘এহেহেহে, দামি জিনিসটা তোর সঙ্গে আড্ডা মারতে গিয়ে বেঁকে গেল’ বলে ফের খেলাচ্ছলে টিপেটুপে সোজা করতে দেখেছি। এয়ারপোর্ট মোড়ের ধারে একবার রেললাইন পেরনোর সময় রেলগেট ফেলা দেখে রুলি সেটিকে তুলে ধরে তলা দিয়ে গলে যাওয়ার বদলে সামনের দিকে ঠেলে সরিয়ে পথ করে নেয়, যার ফলে গেটের খুঁটি গোড়া থেকে ভীত সমেত টুইস্ট করে গেছিল। স্টেশন মাস্টার বানোয়ারিলালজি সেইদিন অবধি ভারি মিষ্টি স্বভাবের এবং শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ ছিলেন, এবং বিহারি থিয়েটারে নিয়মিত শিবাজি-মার্কা দাড়িওলা লছমন বা প্রহ্লাদ সাজতেন– কেউ বিশেষ মাইন্ড করত না। এতদসত্ত্বেও সরকারি সম্পত্তির এহেন পরিণতি মানতে না পেরে তিনি একদৌড়ে স্কুলে এসে হেডস্যরকে কমপ্লেন করলেন– ‘আপলোগকা লেডিস স্টুডেন্টস্ হামারা রেলগেট তোড় দিয়া।’ রুলিকে কয়েক ঘা বেত মেরে স্যর ধমকে উঠলেন– ‘বল গেইট ভাঙছস কেইল্লিগা!’ রুলি ফুঁপিয়ে বললে ‘ভাঙিনি স্যর।’ তারপর বানোয়ারিলালজির মুণ্ডু তিন আঙুলে ধরে গোটা বডি-সহ তেলের শিশির মুটকি খোলার মতো প্যাঁচ মেরে দরজার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলেছিল– ‘এইরকম ঘুরিয়ে দিয়েছি, বাড়ি ফেরার সময় সোজা করে দেব।’ তা দিয়েছিল, মিথ্যে বলব না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
গোটা পরিবেশটাই ইংরেজ প্রভুদের ফেলে যাওয়া সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা মোতাবেক সেজে উঠত বলে কেউ কখনও ট্যাঁ-ফোঁ করার সুযোগ পায়নি। অফিসাররা সাধারণ এয়ারম্যানদের সঙ্গে চাকরবাকরদের মতো ব্যবহার করত, তাদের বউরাও কোলের খোকাদের দোল দেওয়ানো অবধি সবটাই বাপের জমিদারি ভেবে করিয়ে নিত। সে যাক। খেলা চুকলে এয়ারম্যানরা দল বেঁধে রোলারটাকে ফের একবার ওই পরিত্যক্ত জমিতে ঠেলে তুলে দিয়ে যেত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বানোয়ারিলালজি গোটা চাকরি জীবনে আর কখনও কোথাও কমপ্লেন জানাতে যাননি, এবং তারপর থেকেই নাকি দণ্ডায়মান অবস্থায় কথা-কাজের মাঝে প্রায়ই বোঁ করে অ্যাক্সিসের ওপর রোটেট করার মতো ঘুরে যেতেন নিজে থেকে, অনেকটা লাট্টুর মতো– তবে ডিউরেশনটা কম, এবং শোনা যায় বয়স বাড়ার সঙ্গে দু’-এক পাক মেরেই সামলে নিতে পারতেন। ডাক্তার বলেছিল হাইপারটেনশন, তবে ওঁর ঝগরুটে বউ দিনের বেলায় কলোনির কোয়ার্টারের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোগটির নানাবিধ ম্যানিফেস্টেশনের বর্ণনা দেশোয়ালি ভাষায় ইনিয়ে-বিনিয়ে যেরকম দিয়েছিল, তা সব রকমের চিকিৎসা শাস্ত্রকেই সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে। রুলির ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত অনেকানেক প্রেডিকশন সে আর্তনাদে ছিল– সেসব মূলত শাপ-শাপান্তের খাতিরে উচ্চারিত হলেও, নানারকমের ইঙ্গিতবাহী অঙ্গভঙ্গি সহকারে ফিমেল ফিজিওলজির যেরকম অসম্ভব পরিণতির ভবিষ্যদ্বাণী, গ্রাম্য মহিলাটিকে ক্রমশই ইউফোরিক করে তোলে, তা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক বলেই এখানে বর্ণিত হল না। নয়তো আমার আর কী!
এছাড়াও রুলি একাধিকবার যাদবজির বেকারির সব পাঁউরুটি ‘এগুলি বাসি, আর বিক্রি হবে না’ বলে খেয়ে ফেলেছিল। ওর হাত থেকে কেউ কোনও দিন কিছু ছিনিয়ে নিতে পারেনি– তবে সেভাবে কেউ চেষ্টা করেছিল বলেও শোনা যায় না। বাজার থেকে ফেরার পথে আমরা অনেকেই পয়সা ঝেড়ে ঝালমুড়ি বা সাড়েবত্রিশ-ভাজা টাইপের কিছু একটা চিবতাম। রুলি এক্সট্রা কিছু কিনত না। চাল কিনতে পাঠানো হলে তার থেকেই এক খাবলা তুলে হাসি মুখে মহানন্দে খেতে খেতে বাড়ি ফিরত। মানিকদা বোনের বিয়ে দিতে খামোখা মরিয়া হয়ে ওঠেনি।
রুলি নবাদাকে কী চোখে দেখত, বলা মুশকিল। ‘অখাইদ্য’ কোনও বস্তু ওকে আকৃষ্ট করেছে এমন অদ্ভুত কথায় সেকালে আমাদের বিশ্বাস ছিল না। তবে বাড়িতে ওর বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে এবং সম্ভাব্য পাত্রটি নবাদা একথা চেপে রাখা যায়নি। রুলিকে দেখতে মন্দ ছিল না। আমরা ভয় পেতাম ওর শারীরিক শক্তির কারণে। বিয়ের খবর পেয়ে ও সর্বক্ষণ একগাল হাসি মাখা মুখে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এবার, যারা কোনও সময় ওর অনিষ্ট সাধনের চেষ্টা করেছিল, তারা ভাবলে ‘হয়ে গেল, নিশ্চই টুঁটি টিপে পা দিয়ে পিষে মারার জবরদস্ত প্ল্যান ঠাউরেছে।’ যাদের সেরকম আতঙ্কের কারণ ছিল না, তারা আরও কঠিন ডিলেমায় পল্লে– ‘আমার দিকে তাকাইয়া হাসে ক্যান? আমি কী করসি?’
সেটা চৈত্রমাস ছিল কি না মনে নেই, তবে কানে-রেডিও নবাদাকে রুলি খোট্টার দোকানের আশপাশে কোথাও একটা ধরে নাকি ওই রকম হাসতে হাসতেই বলেছিল– ‘তোমারেও আমার খুবই পসোন্দো।’ নবাদা ঠিক এতটা আশা করেনি। একেই আমাদের ছোট মফসসল সেসময় নগার ফিনান্সিয়াল ভেঞ্চারের চোটে টালমাটাল– আগা সাহেব নামক সকলের প্রিয় কাবুলির বেশ কয়েক হাজার হাতিয়ে পগার পার হওয়ার পর জানা গেল, ওর টাকা ডবল করে দেওয়ার কিরে-কসম খেয়েছে হতভাগা। যে কাবুলিকে টুপি পরাতে পারে, সে কোন পর্যায়ের মহান ব্যক্তি, সে আলোচনায় বহু বিমর্ষ ব্যক্তিও যোগ দিয়েছিল। শোনা যায়, তাদের টাকাও জুয়ার আড্ডা থেকেই ডবল করার পরিকল্পনা ছিল নগার।
…ভয়বাংলা-র অন্যান্য পর্ব…
ভয়বাংলা পর্ব ২২: কখনও শিকারে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে নবাদা একরকম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল
ভয়বাংলা পর্ব ২১: তোমরা কথায় কথায় এমন পুলিশ ডাকো কেন?
ভয়বাংলা পর্ব ২০: ‘মালদা এলে ডেকে দেবেন দাদা, আমার আবার ভোরবেলাতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা ওব্বেস’
ভয়বাংলা পর্ব ১৯: দর্শকরা দ্রুত ঐতিহাসিক থেকে পৌরাণিকে সুইচ করতে পারত
ভয়বাংলা পর্ব ১৮: বাঙালি কি আদৌ জানে তালেগোলে সে কী হারাইয়াছে?
ভয়বাংলা পর্ব ১৭: বাঙালি জীবনের ভেজিটেরিয়ান হওয়ার ভয়
ভয়বাংলা পর্ব ১৬: বাঙাল হওয়া সত্ত্বেও যারা রাবীন্দ্রিক বাংলায় কথা কইত, তারা মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না
ভয়বাংলা পর্ব ১৫: গুষ্টিসুখের প্লেজারই অর্জি-নাল সিন
ভয়বাংলা পর্ব ১৪: কৈশোরে জাতের খোঁজ কেউ কখনও নিয়েছে বলে মনে পড়ে না
ভয়বাংলা পর্ব ১৩: নবনাৎসিগুলোর কাছে আর একটু সফিস্টিকেশন এক্সপেক্ট করেছিলাম মশাই
ভয়বাংলা পর্ব ১২: রাজসভায়, থুড়ি, লোকসভায় কেবল পাশা-খেলাটুকু হবে
ভয়বাংলা পর্ব ১১: আমাগো জয়ার বরের ফিগারটা দ্যাখোনের মতো হইসে
ভয়বাংলা পর্ব ১০: ভূতেরাও ঢিল ছোড়ে, মানুষও রেডি রাখে পাথরের স্টক
ভয়বাংলা পর্ব ৯: চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’-এর খুদে স্টোনম্যান জানলার শার্শি ভেঙেছিল খাবার জুটবে বলেই
ভয়বাংলা পর্ব ৮: ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা লোকেদের সংখ্যা আশ্চর্যরকম বৃদ্ধি পেল
ভয়বাংলা পর্ব ৭: প্রত্যেকেরই মনে হতে থাকে সে-ই অদৃশ্য ঘাতকের একমাত্র টার্গেট
ভয়বাংলা পর্ব ৬: হাতের নাগালে একখানা জলজ্যান্ত বন্দুক চালানো লোকই ছিল সহায়
ভয়বাংলা পর্ব ৫: স্টোনম্যানের একটুকরো খুনে স্টোন বাড়িতে থাকলেই সর্বরোগ থেকে মুক্তি!
ভয়বাংলা পর্ব ৪: ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর
ভয়বাংলা পর্ব ৩: বাঙালি ভূত-পেতনিরাও ভারি শুচিবায়ুগ্রস্ত!
ভয়বাংলা পর্ব ২: তবু সে দেখিল কোন ডাইনোসর!
ভয়বাংলা পর্ব ১: বাঙালির ভূতের ভয় যেন উত্তম-সুচিত্রার মতোই সাংস্কৃতিক