দমদম জেল এবং অন্যান্য জেলগুলোতে ছড়িয়ে পড়া খবরে মাওবাদী বন্দিদের মধ্যে চর্চা, জল্পনা, ছায়ার জন্য সহানুভূতি, ব্রহ্মার জন্য স্বস্তি। মুখোমুখি পরিচয় নেই। তবু এক পার্টি, পরিবারের মতো। উল্টোদিকে, তীব্র আফসোস রাহুলের। সুনেত্রা হাতের মুঠোয়, পুলিশের থানায় ঢুকেও কাজ সেরে বেরিয়ে গেল! গোটা পুলিশ বিভাগ মিডিয়াতে কাঠগড়ায়। ত্রিপাঠীসাহেবও ক্রমশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। এত চাপ নেওয়া কঠিন।
২৬.
–এছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না?
থমথমে পরিবেশের মধ্যে বললেন মাস্টারমশাই অমিয়। অধ্যাপক সমরেশ বসে আছেন মাথা নীচু করে। নরেন মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে।
কমরেড বিশাল বললেন, ‘নাঃ। আর কিছু করার ছিল না। যা শুনলাম, তাতে আর অন্য কোনও উপায় ছিল না। ওখানে সুনেত্রা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঠিক করেছে। নিজের ধরা পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও সংগঠনের স্বার্থে যা করণীয়, ও করেছে। ছায়া বেঁচে থাকলে আর পুলিশের চাপ নেওয়ার মতো শারীরিক, মানসিক অবস্থায় ছিল না। দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বলে দিত যা জানে। আমি যা শুনলাম, ও যেহেতু কুসুমডিহার দিকটায় বেশ কিছুদিন ছিল, ও মুখ খুললে কমরেড ব্রহ্মা থেকে শুরু করে অনেকে বিপদে পড়ে যেত। সেই ঝুঁকিটা সুনেত্রা নেয়নি।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সুনেত্রা আছে। নিজেকে আড়ালে রেখে আবার কোনও অপারেশনে। পুলিশ এখন ওকে পাগলের মতো খুঁজবে। নিজেকে বাঁচানোটাই আপাতত সুনেত্রার সবচেয়ে বড় কাজ। আর ছায়া এভাবে চলে গেল বলে খারাপ লাগছে। কিন্তু ও কুসুমডিহার সংগঠনটাকে বাঁচিয়ে রেখে গেল। সব জেলে খবর দিয়ে দিচ্ছি, আমাদের লোক যেখানে আছে সেখানেই যেন কমরেড ছায়ার আত্মবলিদানের জন্য শহিদ মর্যাদায় শোকসভা হয়।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সমরেশ তাকালেন। বললেন, ‘সেই ঝুঁকিটা বড় ঝুঁকি হয়ে যেত। পার্টির ক্ষতি হত। তবে ছায়ার খোঁজ যদি আমরা খানিকটা সময় আগে পেতাম, তাহলে হয়তো কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’
বিশাল বললেন, ‘কমিউনিকেশন গ্যাপটা ফ্যাক্টর হয়ে গেল। খারাপ লাগছে।’
নরেন বলল, ‘আর শঙ্করবাবু?’
বিশাল বললেন, ‘শুনলাম ভেঙে পড়েছে। ছায়ার শেষকৃত্যে ওকে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। এতদিন খোঁজহীন, তারপরে একেবারে ডেডবডি হিসেবে দেখাটা সত্যিই ধাক্কা লাগার মতো। আশা করি কমরেড শঙ্কর সামলে নেবে।’
–ছায়াকে আমরা সেভাবে নজরে আনতে পারলাম না কেন? অমিয়র প্রশ্ন।
–ওটা আমাদের ব্যর্থতা। আসলে জঙ্গলমহলের মেয়ে। শহরের দিকটায় আসতেও চায়নি। আমার ধারণা পুলিশের ভয়ে আত্মগোপনে ব্যস্ত ছিল, চাপটা নিতে পারেনি। ভালো কমরেডদের থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের আত্মীয়দের ওপর নির্ভর করছিল। সেটা কাজে লাগেনি। তারপর আবার কিছু কমরেডের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। মেয়েটা একা পড়ে গিয়েছিল। সেভাবে মদত পায়নি।’ বিশাল বললেন।
একটু থেমে আবার বললেন, ‘আমি যা শুনলাম ছায়া কিন্তু বিষ খেতে আপত্তিও করেনি। কোনও সিনক্রিয়েট করেনি। করলে ও বেঁচে যেত। ছায়া প্রকৃত কমরেডের মতো ওর দায়িত্ব পালন করেছে। তথ্য গোপনের দায়িত্ব। বুঝতে পারছিল ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছে। তাই সুনেত্রাকে কোঅপারেট করেছে।’
–ছায়াদিকে দেখার পর শঙ্করবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া গেল না?
–না, হয়ে ওঠেনি। কারণ ছায়া পুলিশের খাতায় ফেরার। যোগাযোগ করতে গেলে ধরা পড়ে যেত। তাছাড়া প্রথমে নাকি সুনেত্রাদের কাছেও ও নিজের আসল পরিচয় সেভাবে দেয়নি, সবটা বলেনি। যখন বলেছে, ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে।
–আর সুনেত্রা? অমিয়র কৌতূহল।
সমরেশ বললেন, ‘ওই প্রশ্নটা আর করেন কেন মাস্টারমশাই? ওর উত্তর শুধু কমরেড বিশালের কাছেই থাক। ওদের চলাফেরা নিয়ে সবাই আলোচনা নাই বা করলাম।’
বিশাল বললেন, ‘সুনেত্রা আছে। নিজেকে আড়ালে রেখে আবার কোনও অপারেশনে। পুলিশ এখন ওকে পাগলের মতো খুঁজবে। নিজেকে বাঁচানোটাই আপাতত সুনেত্রার সবচেয়ে বড় কাজ। আর ছায়া এভাবে চলে গেল বলে খারাপ লাগছে। কিন্তু ও কুসুমডিহার সংগঠনটাকে বাঁচিয়ে রেখে গেল। সব জেলে খবর দিয়ে দিচ্ছি, আমাদের লোক যেখানে আছে সেখানেই যেন কমরেড ছায়ার আত্মবলিদানের জন্য শহিদ মর্যাদায় শোকসভা হয়।
সমরেশ বললেন, ‘আর ব্রহ্মা? সর্বশেষ খবর কিছু বলা যাবে?’
বিশাল বললেন, ‘কুসুমডিহাতে তার কাজ সে করছে। হয়তো কিছুদিন পরে আরেক জায়গায় চলে যাবে। তবে বাঁশরীলালকে খতমের যে অ্যাকশন ব্রহ্মা করে দিয়েছে, ওকে লাল সেলাম। এক অ্যাকশনেই অনেক কাজ হয়ে গিয়েছে। মানুষ আমাদের পার্টির ওপর ভরসা করছে। পুলিশ যতই লাফাক, ব্রহ্মা ঠিক রেখেছে নিজেকে। তবে হ্যাঁ, এটাও বলতে হবে, ছায়া নিজেকে শেষ করে ব্রহ্মাকে ঠিক থাকতে সাহায্য করে গেল।
দমদম জেল এবং অন্যান্য জেলে ছড়িয়ে পড়া খবরে মাওবাদী বন্দিদের মধ্যে চর্চা, জল্পনা, ছায়ার জন্য সহানুভূতি, ব্রহ্মার জন্য স্বস্তি। মুখোমুখি পরিচয় নেই। তবু এক পার্টি, পরিবারের মতো।
উল্টোদিকে, তীব্র আফসোস রাহুলের। সুনেত্রা হাতের মুঠোয়, পুলিশের থানায় ঢুকেও কাজ সেরে বেরিয়ে গেল! গোটা পুলিশ বিভাগ মিডিয়াতে কাঠগড়ায়। ত্রিপাঠীসাহেবও ক্রমশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। এত চাপ নেওয়া কঠিন। তবে, এর মধ্যে একটাই কথা, যদি ওই মহিলা সত্যিই সুনেত্রা হয়, তাহলে অবশেষে তাকে দেখা গিয়েছে। মুখটা বোঝা গিয়েছে। কিন্তু তাকে খুঁজবে কোথায়? রাহুল সবরকম চেষ্টা চালাল। সুনেত্রা উধাও। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। বিরোধীরা সোচ্চার হল, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু। দু’-তিনজনকে সাসপেন্ড করতে হয়েছে। রাহুল অপরাধবোধে ভুগছে। এতদিন, এতবার সুযোগ পাওয়ার পরেও সে সুনেত্রাকে ধরতে পারল না। ত্রিপাঠীসাহেব ইঙ্গিত দিয়েছেন পুলিশ টিম বদল করবে। রাহুলকে সরানো হবে শিগগিরই।
( চলবে)
…পড়ুন কুসুমডিহার কাব্য-এর অন্যান্য পর্ব…
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৫: ছায়ার মৃত্যুর খবর গেল শঙ্করের কাছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৪: মলিন চেহারার এই মহিলাকে ধরতে এত পুলিশ?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৩: শঙ্কর বারিকের স্ত্রী ছায়া মাহাতো ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২২: গুন্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাওবাদীরা, কুসুমডিহায় মনোবল বাড়ছে মানুষের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২১: কুসুমডিহা এক বুক আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২০: মানুষকে একজোট করতে চায় রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৯: দূত এবং দূতের দূত মারফত খবর গিয়েছে কুসুমডিহায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৮: টিলার ওপরের মহিলাদের নিয়ে পুলিশের কৌতূহল প্রবল
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৭: পল্টু জবার পিছনে খরচ বাড়িয়ে ইদানীং এদিক-ওদিক হাত পেতে ফেলছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৬: কমরেড ব্রহ্মা কতদিন পালিয়ে বেড়াবে?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৫: প্রতিমাকে পাওয়া গেল কুসুমডিহায়, মিথ্যে ধর্ষণের মামলায় ফাঁসি হয়েছে তাঁর বরের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৪: এখন খবরের শীর্ষে কুসুমডিহায় মাওবাদী হামলা আর কমরেড ব্রহ্মা
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৩: কমরেড ব্রহ্মা তাহলে যেখানেই থাকুন, কুসুমডিহার ওপর নজর রেখেছেন
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১২: থমথমে কুসুমডিহাতে টহল দিচ্ছে পুলিশ
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১১: ছদ্মপরিচয়ে কুসুমডিহাতে প্রবেশ পুলিশ ফোর্সের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১০: শান্ত কুসুমডিহা এখন হিংস্র হয়ে ফুঁসছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৯: কুসুমডিহাতে পুলিশ, নেতা, বুদ্ধিজীবী, মহিলা কমিশন, মিডিয়ার ভিড়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৮: জঙ্গলমহলের তল্লাট থেকে উত্তাপ ছড়াল কলকাতার মিডিয়াগুলির স্টুডিওতেও
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৭: কুসুমডিহাতেই দেখিয়ে দেব আমরা মরে যাইনি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৬: পরিচয় যত বাড়ছে, সুমিত অনুভব করছে এলাকা গরম হচ্ছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৫: পশ্চিমগড়ের মৃতদেহর খবর এখনও কলকাতা সংস্করণে জায়গা পায়নি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৪: সভা আর প্রচার মানেই বন্দুক ধরা নয়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৩: ‘বন্দুক হাতে নেওয়া প্রত্যেকটা মেয়েকে সমর্থন করি’
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২: সিস্টেমের দোষেই কুসমডিহাতে ফের অমঙ্গলের পদধ্বনি, সুমিতকে বোঝাল রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১: জঙ্গলমহলের কুসুমডিহার নতুন পোস্টমাস্টার সুমিত, জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারবে!